বদলে দিয়েছে জীবন

প্রায় ২১৩.৩৩ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে এই ইপিজেড। এখানে ১৯০টি প্লটের মধ্যে ১৫৪টি প্লটে ২৪টি দেশি–বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কারখানা আছে। এখানে ৩৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

নীলফামারীর নিম্ন আয়ের মানুষ কয়েক বছর আগেও কাজের সন্ধানে কুমিল্লা, ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতেন। অনেকে কাজের অভাবে অনাহার–অর্ধাহারে দিন কাটাতেন। সংসারে ছিল নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। তবে উত্তরা ইপিজেড চালু হওয়ার পর তাঁদের অনেকের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। ইপিজেডের এলাকায় হয়েছে ব্যাপক উন্নয়ন। ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় চাকরি করে অনেকেই হয়েছেন স্বাবলম্বী।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের মঙ্গা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে উত্তরা রপ্তানী প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ইপিজেড) আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রায় ২১৩.৬৬ একর এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে এই ইপিজেড। এখানে ১৯০টি প্লটের মধ্যে ১৫৪টি প্লটে ২৪টি দেশি–বিদেশি কোম্পানির কারখানা আছে। ওই ২৪টি কোম্পানির মধ্যে ১১টি বিদেশি।এখানে ৩৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।সবুজ প্রকৃতির মধে৵ গড়ে ওঠা এই ইপিজেডে শ্রমিক অসন্তোষ নেই। নেই চাঁদাবাজি। এখানে রয়েছে দক্ষ জনশক্তি, রয়েছে সুন্দর কর্মপরিবেশ। এ কারণে দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন বেশি। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে কলকারখানা, বাড়ছে শ্রমিকের চাহিদাও।

স্থানীয় সূত্র জানায়, উত্তরা ইপিজেড চালু হওয়ার পর থেকে নীলফামারীতে রাস্তা নির্মাণসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। মানুষের জীবন বদলে গেছে। বেড়েছে জমির দাম। ১০–১৫ বছর আগেও যেখানে প্রতি বিঘা জমি তিন থেকে চার হাজার টাকায় বিক্রি হতো, সেখানে এখন প্রতি বিঘা জমি ১০ থেকে ১২ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কারখানার কর্মীরা দলে দলে প্রবেশ করছেন ইপিজেডে। কেউ বাইসাইকেলে, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ ইজিবাইকে, আবার কেউ হেঁটে। পেছন ফিরে তাকানোর সময় যেন কারও নেই। সকাল আটটার মধ্যে প্রায় সব কারখানার কর্মীরা ঢুকে যান তাঁদের নিজ নিজ কর্মস্থলে। কাজের শেষে বিকেল চারটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত একইভাবে বের হতে থাকেন বিভিন্ন কারখানার কর্মীরা। তখন চলে তাঁদের ঘরে ফেরার প্রতিযোগিতা।

কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা বলছেন, এখানে বেতন, উৎসব ভাতা, মাতৃত্বকালীন সুবিধাসহ শ্রমিকদের পাওনা সঠিক সময়ে পরিশোধ করা হয়। এ কারণে এখানে শ্রমিক অসন্তোষ নেই।

বিকেল তিনটার দিকে ইপিজেড গেটের সামনে জড়ো হতে থাকে ইজিবাইক, ভ্যান ও রিকশা।

এ সময় কথা হয় ভ্যানচালক আজিনুর ইসলামের (৩৫) সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর বাড়ি জেলা সদরের চড়াইখোলা ইউনিয়নের বেঙমারী গ্রামে। স্ত্রী কমলা বেগম প্রায় পাঁচ বছর ধরে ইপিজেডের একটি কারখানায় কাজ করছেন। প্রতিমাসে স্ত্রীর আয় হয় ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা। ইপিজেড তাঁদের বাড়ি থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন তিনি সকালে স্ত্রীকে দিয়ে যান এবং বিকেলে নিতে আসেন। স্ত্রীকে কারখানায় আনা–নেওয়ার সময় ওই এলাকার অন্য শ্রমিকেরাও আসেন তাঁর ভ্যানে। এতে আজিনুরের প্রতিমাসে বাড়তি আয় হয় ছয় থেকে সাত হাজার টাকা।

জেলার জলঢাকা উপজেলার কাঁঠালী ইউনিয়নের পূর্ব কাঁঠালী গ্রামের রোজিনা আক্তার (২০) বলেন, এখানে চাকরি করে সংসার ভালোভাবে চলছে, নারীদের কর্মসংস্থান হয়েছে, মর্যাদাও বেড়েছে।

ইপিজেডের পাশে গড়ে ওঠা মোল্লা ট্রেনিং সেন্টারের মালিক নূর ইসলাম বলেন, উত্তরা ইপিজেডকে ঘিরে এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়েছে। এখানে বেশ কিছু প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মেস রয়েছে। এসব মেসে পুরুষ ও নারী শ্রমিকেরা থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শতে৴ ইপিজেডের এক কর্মকর্তা বলেন, এই ইপিজেডে ২১৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছেন ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছর এখান থেকে ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এই ইপিজেডের কারখানাগুলোতে তৈরি পোশাক, পরচুলা, কফিন, চশমা, খেলনা গাড়ি, চামড়ার ব্যাগ, জুতাসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি হয়।

উত্তরা ইপিজেডের কারখানাগুলোতে চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় ইপিজেডের বাইরে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু শিল্পকারখানা। সেখানেও কাজ করছেন হাজার হাজার নারী–পুরুষ শ্রমিক। এ বিষয়ে নীলফামারী জেলা শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি মো. মারুফ জামান বলেন, উত্তরা ইপিজেডের ইতিবাচক প্রভাবে এ অঞ্চলে ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে। ইপিজেডকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তাতে করে পরোক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে।

উত্তরা ইপিজেডের মহাব্যবস্থাপক মোছাম্মৎ নাহিদ মুন্সি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষ অনেক শান্তিপ্রিয়, কর্মদক্ষ ও বিনয়ী। এ কারণে দেশি–বিদেশি উদ্যোক্তারা এই ইপিজেডের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন বেশি। স্থানীয় সাংসদ আসাদুজ্জামান নূর সার্বক্ষণিক ইপিজেডের খোঁজখবর রাখেন।

এ বিষয়ে আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘২০০১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইপিজেড প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী সময়ে আমরা যখন বিরোধী দলে গেলাম, তখন আট বছর এই ইপিজেড বন্ধ ছিল। ২০০৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এই ইপিজেড নতুন করে জীবন ফিরে পায়। ইপিজেডের কারখানাগুলোর ৬০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। এই নারীদের উন্নয়নে আমাদের অর্থনীতিতে একটা বড় উন্নয়ন হয়েছে।’

এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন নাহার বলেন, বেকার সমস্যা দূরীকরণে উত্তরা ইপিজেড ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।