যাত্রা হলো শুরু

সন্তানের সঙ্গে বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত
সন্তানের সঙ্গে বব ডিলান। ছবি: সংগৃহীত
বব ডিলানের আত্মজীবনী ক্রনিকলস: ভলিউম ওয়ান প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। এর প্রথম অধ্যায় ‘মার্কিং আপ দ্য স্কোর’-এ ১৯৬১ সালে নিউইয়র্কে প্রথম পৌঁছানোর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। সেখানকার সংগীতজগতের নানাজনের সঙ্গে তাঁর পরিচয়, বন্ধুত্ব, নতুন গানের সূচনা—এমন নানা গল্পে ভরপুর অনবদ্য এ অধ্যায়ের কিছু অংশের অনুবাদ করেছেন আশিস আচার্য

লু লেভি ছিলেন লিডস মিউজিক পাবলিশিং কোম্পানির কর্ণধার। আমাকে ট্যাক্সিতে করে একদিন নিয়ে গেলেন ওয়েস্ট সেভেন্টিথ স্ট্রিটের পাইথিয়ান টেম্পলে। দেখালেন একটি ছোট্ট রেকর্ডিং স্টুডিও। সেখানে বিল হ্যালি অ্যান্ড হিজ কমেটস ব্যান্ড দলের ‘রক অ্যারাউন্ড দ্য ক্লক’-এর রেকর্ড হয়েছিল।

তারপর গেলাম ফিফটি এইটথে জ্যাক ডেম্পসির রেস্তোরাঁ এবং ব্রডওয়েতে। তিনি নামকরা বক্সার, আমরা হাত মেলাই। ডেম্পসির বলতে লাগলেন, ‘তুমি তো বড্ড রোগা। হুম, ওজন তো কিছুটা বাড়াতে হবে। ঠিক হয়ে যাবে, ভেবো না...।’

‘ও বক্সার নয়, জ্যাক, গীতিকার। আমরা ওর গান বের করব।’

‘ও, তাই নাকি, বেশ...আশা করি একদিন শুনব তোমার দু-একটা গান। গুড লাক।’

বাইরে তখন বাতাস বইছিল, আকাশে মেঘেদের লড়াই, রাস্তায় লাল বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছিল তুষারকণার ছড়াছড়ি। ব্যস্ত শহরের কোনো কিছুই আমায় টানছিল না। লিডস মিউজিক কোম্পানির সঙ্গে একটা চুক্তি সই করলাম। লু আমাকে অগ্রিম ১০০ ডলার দিলেন ভবিষ্যতের রয়্যালটির অংশ হিসেবে।

জন হ্যামন্ড আমাকে কলাম্বিয়া রেকর্ডসে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিই লুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন, আর তাঁকে বলেন যেন আমার দিকে খেয়াল রাখেন। হ্যামন্ড আমার মাত্র দুটি মৌলিক গান শুনেছিলেন। হয়তো আন্দাজ করে নেন, আমার এমন কম্পোজিশন আরও আছে।

লুর অফিসে আমি গিটার খুলে বাজাতে লাগলাম। সেখানকার দেয়ালে নামীদামি সব ব্যান্ড দলের ছবি টাঙানো। লু আমাকে বললেন, হ্যামন্ডের অনেক আশা তোমার ওপর। জহুরির চোখ তাঁর, বড় বড় প্রতিভা খুঁজে বের করেছেন। বিলি হলিডে, টেডি উইলসন, চার্লি ক্রিশ্চিয়ান, ক্যাব ক্যালোওয়ে, বেনি গুডম্যান, কাউন্ড বেজি, লাওনেল হ্যাম্পটন প্রমুখ তো হ্যামন্ডেরই আবিষ্কার।

ক্রনিকলস: ভলিউম ওয়ান-এর প্রচ্ছদ
ক্রনিকলস: ভলিউম ওয়ান-এর প্রচ্ছদ

কলম্বিয়া তখন শীর্ষস্থানে, প্রথমেই সেখানে প্রবেশের সুযোগটা ছিল দারুণ। লোকসংগীত বা ফোক মিউজিক দিয়ে যাঁরা শুরু করতেন, দ্বিতীয় সারির রেকর্ডিং প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল তাঁদের অবলম্বন। আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমটাই ঘটেছে বলতে হবে। হ্যামন্ড ছিলেন অসাধারণ। প্রখর দৃষ্টি দিয়ে তিনি আমার ভাবনার জগৎটা দেখতে পেরেছিলেন। বললেন, আমার মধ্যে তিনি ঐতিহ্যবাহী ধারার প্রতিনিধিকে দেখেছেন—ব্লুজ, জ্যাজ ও ফোক প্রভৃতি মিউজিকের।
নতুনত্ব বলতে খুব বেশি কিছু ছিল না। মার্কিন সংগীত তখন যেন কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছিল, পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে ষাটের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত। জনপ্রিয় সব রেডিওতেও তখন একঘেয়ে স্থবিরতা। দ্য বিটলস, দ্য হু অথবা দ্য রোলিং স্টোনের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত এমনই চলছিল। এই দলগুলো গানের ভুবনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করল, জীবনে দিল নতুন উত্তেজনার ছোঁয়া।
তখন আমি নিরেট ফোক গান করতাম। তবে বাণিজ্যিকতার দিকে ঝুঁকিনি। হ্যামন্ড বললেন, ‘তুমি প্রতিভাবান তরুণ। যদি সেই প্রতিভার খেয়াল ও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারো, ভালো করবে। আমি তোমাকে তুলে ধরব, তোমার গান রেকর্ড করব। তারপর দেখব, কী হয়।’
এটুকুই পর্যাপ্ত ছিল আমার জন্য। অনেক কাজ পেয়ে গেলাম, চুক্তিও সই করলাম। হ্যামন্ড একদিন তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রচার বিভাগের বিলি জেমসকে ডেকে বললেন, আমাকে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
বিলির বেশভূষা ভালো। দেখে মনে হয়, ইয়েল থেকে এসেছেন। মাঝারি উচ্চতা, ঢেউখেলানো কালো চুল। আমি তাঁর সঙ্গে গেলাম। নিজের অফিসের ডেস্কে গিয়ে খাতা-পেনসিল হাতে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কোত্থেকে এসেছি। বললাম, ইলিনয় থেকে। লিখলেন তিনি। তারপর প্রশ্ন, আমি কখনো অন্য কোনো কাজ করেছি কি না। তাঁকে বললাম, ডজন খানেক। বেকারির ট্রাক চালাতাম একসময়।
সব লিখে নিচ্ছিলেন বিলি। জিজ্ঞেস করলেন, অন্য কিছু?
একসময় নির্মাণশ্রমিক ছিলাম।
কোথায়?
ডেট্রয়েটে।
ঘুরে বেরিয়েছেন চারপাশে?

হ্যাঁ।

আমার পরিবারের কথা জানতে চাইলেন তিনি, তাঁরা কোথায় থাকেন? বললাম, জানি না। অনেক দিন আগেই গত হয়েছেন।

আপনার জীবনটা কেমন ছিল বাড়িতে?

বললাম, আমাকে বের করে দিয়েছিল।

বাবা কী করতেন?

ইলেকট্রিশিয়ান।

মা?

গৃহিণী।

কী ধরনের গান করেন আপনি?

লোকসংগীত।

কী ধরনের লোকসংগীত?

বিলিকে বললাম, এসব প্রশ্ন আমার অপছন্দ। এড়িয়ে যেতেই ভালো লাগবে।

তিনি পাত্তা দিলেন না। উত্তর চাই-ই। প্রশ্ন করলেন, কীভাবে এখানে পৌঁছেছি।

বললাম, মালবাহী ট্রেনে চড়ে।

যাত্রীবাহী নয়?

না।

আমি বিলির চারপাশ ও পেছনে অন্য অনেক কিছু দেখতে লাগলাম। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এখনকার সংগীতজগতের কার মতো নিজেকে মনে করি আমি?

বললাম, সে রকম কেউ নেই। সত্যি কথা বলতে, আমি অন্য কারও মতো হতে চাই না।

আসলে মালবাহী ট্রেনে চড়ে নিউইয়র্কে যাইনি আমি। চার দরজার একটা সেডান গাড়িতে করে মিডওয়েস্ট থেকে সোজা শিকাগোয়। সেখান থেকে নানা জায়গা পেরিয়ে ওহাইও, ইন্ডিয়ানা, পেনসিলভানিয়া—২৪ ঘণ্টার যাত্রা। একপর্যায়ে জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজের ওপর দিয়ে পৌঁছাই নিউইয়র্কে। দরজা খুলে বাইরে নেমে টের পাই বাতাসে তুষারের শীতল ঝাপটা।

অবশেষে নিউইয়র্কে এলাম। এখানে সেই শিল্পীরা থাকেন, যাঁদের গান কেবল রেকর্ডেই শুনেছি। ডেভ বেন রংক, পেগি সিগার, এড ম্যাককার্ডি, ব্রাউনি ম্যাকগি, সনি টেরি, জশ হোয়াইট, দ্য নিউ লস্ট সিটি র‍্যাম্বলার্স, রেভারেন্ড গ্রে ডেভিস...। এই শহরই আমার নিয়তি গড়ে দিয়েছে। যখন পৌঁছলাম, চারপাশে প্রচণ্ড ঠান্ডা। পুরো শহর তুষারে মোড়ানো। মনটা শক্ত রাখতে পেরেছিলাম। বরফের মতো জমে থাকা সেই মহানগরে কাউকেই আমি চিনতাম না। তবে টের পাচ্ছিলাম, সবকিছু বদলে যাবে শিগগির।

নিউইয়র্কের একটি ক্যাফেতে গান গাইছেন বব ডিলান, ১৯৬২
নিউইয়র্কের একটি ক্যাফেতে গান গাইছেন বব ডিলান, ১৯৬২

গ্রিনউইচ ভিলেজের কেন্দ্রে ম্যাকডুগাল স্ট্রিটের একটা ক্লাব ছিল ক্যাফে হোয়ায়। নিচু ছাদ, মৃদু আলোয় বড় ডাইনিং হলের মতো চেয়ার-টেবিল পাতানো। পানশালা নয়। মধ্যদুপুরে খুলত সেটা। বন্ধ হতো ভোর চারটায়। কেউ আমাকে বলে দিয়েছিল ওখানে গিয়ে ফ্রেডি নেইল নামের একজন গায়ককে খুঁজতে। তিনি দিনের বেলায় ক্যাফে হোয়ায় গাইতেন। সেখানে গিয়েই তাঁকে পেয়ে গেলাম। চমৎকার মানুষ। জিজ্ঞেস করলেন, কী করি। বললাম, গাইতে এবং গিটার ও হারমোনিকা বাজাতে পারি।
ফ্রেডি বললেন, তাঁর সঙ্গে হারমোনিকা বাজাতে। প্রস্তাবটা ছিল আমার জন্য বড় আনন্দের, ওই শীতল শহরে। তিনি প্রায় ২০ মিনিট ধরে বাজালেন। তাঁর দলের অন্যদের বিভিন্ন নির্দেশনাও দিলেন। তিনি ছিলেন ওই ক্লাবের বিনোদন দেখভাল করার দায়িত্বে। কয়েক বছর পর তিনি লিখেছিলেন সেই জনপ্রিয় গান, ‘এভরিবডি’স টকিং’। আমি তাঁর সঙ্গী হলাম। এভাবেই নিউইয়র্কে বাজাতে শুরু করলাম নিয়মিত।
ক্যাফে হোয়ায় আমার পছন্দের গায়িকা ছিলেন ক্যারেন ডাল্টন। গিটারও বাজাতেন। ডেনভারের কাছে একটা ক্লাবে আগেও একবার তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কয়েকবার একসঙ্গে গেয়েছি আমরা।
ফ্রেডের সঙ্গে কাজ করার একটা বড় সুবিধা ছিল, মজাদার সব খাবারের স্বাদ নিতে পারতাম। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর হ্যামবার্গার তখন খুব খেতাম। দিনের বেলায় কখনো কখনো রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরঘুর করতাম টাইনি টিম (বব ডিলানের বন্ধু) আর আমি। নোবার্ট নামের বাবুর্চিটি আমাদের নিরাশ করত না।
এভাবেই নিউইয়র্কের নানা রাস্তাঘাট, ক্লাব, সংগীতশিল্পী এবং অন্য লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকি। গায়ক ভ্যান রংকের সঙ্গেও আলাপ হয়। এক শীতল দিনে টম্পসন অ্যান্ড থার্ডের কাছে হালকা তুষারধারার মধ্য দিয়ে ভেসে আসা রোদে তাঁকে দেখি। মনে হচ্ছিল, বাতাসই বুঝি তাঁকে আমার দিকে নিয়ে আসছে। আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলাম। কিন্তু তিনি দাঁড়ালেন না। আমিও নিশ্চুপ রইলাম। তাঁর গানের সঙ্গে বাজাতে ইচ্ছে করছিল আমার। আসলে সবার জন্যই ইচ্ছে করত। তখনো তো আমি একটা ঘরে বসে শুধু নিজে বাজাইনি। সব সময় অন্যদের সঙ্গেই তো বাজাতে হতো। হয়তো আপনি বলবেন, আমি জনসমক্ষে বাজানোর ফলেই ভালো রপ্ত করতে পেরেছিলাম।

তারপর গ্যাসলাইট নামের ক্যাফেটির প্রতি আগ্রহী হলাম। ভ্যান রংক সেখানে বাজাতেন, গাইতেন। আমি কেন পারব না? এটির তুলনায় আশপাশের অন্য কফি হাউসগুলো ছিল ম্লান। আমি যতটা বেশি পারি বাজাতে আরম্ভ করলাম। বাছাইয়ের কোনো সুযোগ ছিল না।

এক বন্ধু আমার পরিবারের কথা জানতে চাইলে বলেছিলাম, নানির (মায়ের মা) কথা। আভিজাত্য ও সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে তিনি ছিলেন এক চমৎকার মানুষ। একবার আমাকে বলেছিলেন, কোথাও পৌঁছানোর পথে সুখ পাওয়া যায় না; বরং সুখটাই সেই পথ।

তিনি আমাকে সহানুভূতিশীল হতে বলেছিলেন। কারণ চলার পথে যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হবে, তাঁরা প্রত্যেকেই তো একেকটা কঠিন লড়াই করছেন।

একসময় আমি গ্যাসলাইট থেকে ডাক পেলাম। মিলস ট্যাভার্নের বাইরে থার্মোমিটারের পারদ নামতে নামতে শূন্যেরও ১০ ঘর নিচে চলে গিয়েছিল। বাতাসে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসও জমে যাচ্ছিল। কিন্তু তবু আমি শীত অনুভব করছিলাম না। অনাগত চমৎকার রাত্রিগুলোর জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিলাম, সন্দেহ নেই। আমি কি প্রতারিত হতে পারি? সম্ভবত না। মনে হয় না, প্রতারিত হওয়ার মতো পর্যাপ্ত কল্পনা আমার ছিল। কোনো মিথ্যে আশাও তো ছিল না। আমি অনেক দূর থেকে এসেছিলাম। আর আমাকে যেতেও হবে অনেক দূর অবধি। কিন্তু এখন নিয়তির খেলা দেখানোর সময়। মনে হচ্ছিল, সে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে। আর আশপাশে কেউ নেই।

 (ঈষৎ সংক্ষেপিত)