'লেখার টেবিলে লেখক নিঃসঙ্গতম ব্যক্তি'

>এ বছর কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন শাহাদুজ্জামান ও মোরশেদ শফিউল হাসান। এই দুই লেখকের সাক্ষাৎকার দিয়ে সাজানো হলো এই সংখ্যা
মোরশেদ শফিউল হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ
মোরশেদ শফিউল হাসান। ছবি: সুমন ইউসুফ

রাহেল রাজিব: পুরস্কার একধরনের মূল্যায়ন। এই মূল্যায়নের ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুই দিকই আছে। পুরস্কার একদিকে যেমন লেখক-শিল্পীর জন্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করে, তেমনি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটি লেখকের সৃষ্টিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্তও করতে পারে। এ বছর প্রবন্ধ শাখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন আপনি। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
মোরশেদ শফিউল হাসান: আমি একে একধরনের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি বলে মনে করি। প্রতিভা বা কাজের মূল্যায়ন সমকালে কতটা হয়, কিংবা হলেও সে মূল্যায়ন কালের বিচারে টেকে কি না এবং পুরস্কারের মানদণ্ডে তাকে বিচার করা যায় কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে; সব সময়ই থাকবে। তবে হ্যাঁ, পুরস্কারের একটা সামাজিক, আর্থিক ও প্রচারমূল্য আছে। যাঁরা এ পর্যন্ত আমার কোনো বই বা লেখা পড়েননি, হয়তো সামনেও পড়বেন না, তাঁরাও হয়তো পুরস্কারের কথা শুনে এবার একটু ফিরে তাকাবেন। এদিক থেকে পুরস্কারের গুরুত্ব তো অবশ্যই আছে। আমি সেভাবেই একে গ্রহণ করেছি।
তবে পুরস্কার পাওয়ার পর এখন আমার মধ্যে একধরনের ভীতিরও সঞ্চার হয়েছে। ভীতিটা এ কারণে যে এর মধ্য দিয়ে আমার কাছে অনেকের যে বাড়তি প্রত্যাশা তৈরি হতে পারে, সে প্রত্যাশা আমি পূরণ করতে পারব কি না? কেবল সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে অতৃপ্তি ও নিত্যনতুন আগ্রহই একজন লেখককে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সুতরাং পুরস্কার ও লেখকজীবন—দুটোকে আলাদাভাবে ভেবেই সামনে পা ফেলা উচিত বলে আমি মনে করি।
রাহেল: আপনার বেড়ে ওঠার সময়টি ছিল বেশ ঘটনাবহুল—গত শতকের ষাটের দশক। এ সময়ে এই ভূখণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলো তৈরি হয়েছে, যার তরঙ্গচক্রে আপনিও ছিলেন। এই রাজনৈতিক ঘটনাবলি কি আপনাকে লেখক হতে সাহায্য করেছে?
মোরশেদ: আমার শৈশব ও বাল্যকাল ষাট দশকের মধ্যেই পড়েছে। তারুণ্যেরও কিছুটা ষাট দশক, কিছুটা সত্তর দশকে। নিজে ছোটবেলা থেকে নানা ধরনের বই পড়তাম। আমি যখন চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই আমাকে পত্রিকা পড়ায় অভ্যস্ত করেছিলেন বাবা; এমনকি ইংরেজি পত্রিকাও। ওই বয়সে হয়তো বুঝতাম না, কিন্তু পড়ার চেষ্টা করতাম। আমার মা-ও বই পড়তেন। বিষাদ-সিন্ধুর কাহিনি থেকে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনার কথা আমি খুব ছোটবেলায় মনে হয় প্রথম তাঁর মুখ থেকেই শুনেছিলাম। প্রসঙ্গত বলি, আমার পরিবারে বা নিকট আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কাউকে অন্তত ওই সময়ে আমি লেখালেখি করতে দেখিনি। তবে বই পড়ার মাধ্যমে প্রগতিশীল রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হই। যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, সে সময় থেকেই ছাত্র সংগঠন করি। ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি।
তো, উনসত্তরের আন্দোলনের শুরুতে আসাদ হত্যার প্রতিবাদে স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে আমি স্কুল কর্তৃপক্ষের অসন্তুষ্টির কারণ হলাম। হেড স্যার বাবাকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘ও ভালো ছাত্র, আমরা আশা করছি ও স্ট্যান্ড করবে, তাই ওর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিলাম না।’ অবশ্য শেষ পর্যন্ত আমি স্ট্যান্ড করিনি।
রাহেল: লেখালেখির আগ্রহ সৃষ্টি হলো কীভাবে?
মোরশেদ: লেখালেখির অনুপ্রেরণা ওই বইপড়া ও সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণের মধ্য দিয়ে এসেছে। তা ছাড়া তখন মনে করতাম, লেখালেখি দিয়ে যদি সমাজ বদলানো যায়। আমি হয়তো ভালো মিটিং-মিছিল করতে পারব না। কিন্তু লেখার মধ্য দিয়ে মানুষকে সচেতন করতে, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারব। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রী বা বামধারার সাহিত্য পড়ে তখন আমাদের মধ্যে এই বোধ সঞ্চারিত হয়েছিল। আজ সে বোধটা আর আমার মধ্যে তত প্রবল নয়। তবে এখনো মনে করি, শুধু লিখে সমাজ বদলানো যায় না ঠিক, কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নেওয়া ও জনসচেতনতা সৃষ্টির দিক থেকে শিল্পসাহিত্য একটা বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
রাহেল: উনসত্তরের প্রবল জাতীয়তাবাদী প্রেক্ষাপটের বাস্তবতায় পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা ও আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে আপনার ভেতর যে রাজনৈতিক চেতনা গড়ে উঠল, সেটা কি জাতীয়তাবাদী চেতনা?
মোরশেদ: ব্যক্তিগতভাবে আমি কখনো জাতীয়তাবাদী ছিলাম না, এখনো নই। সে সময়ের পটভূমিতে একটা উদার, অসাম্প্রদায়িক বাঙালিত্বের বোধ কাজ করত। তবে সর্বোপরি ছিল প্রগতিশীল মানবিক চেতনা। সমাজে বৈষম্য-বঞ্চনার ব্যাপারটি আমাকে পীড়িত করত। একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন আমাকে সমাজবাদী চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট করে। এখনো ওই স্বপ্ন রয়ে গেছে।
রাহেল: তরুণ বয়সে কোন লেখকরা আপনার চিন্তাজগতে প্রভাব রেখেছিলেন?
মোরশেদ: আমাদের সময় স্কুল-কলেজ ও পাড়ায়-মহল্লায় প্রতিবছরই রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তী হতো। এখন যা আর হয় না। কোথাও কোথাও রবীন্দ্র-নজরুলের সঙ্গে একসঙ্গে পালিত হতো সুকান্তজয়ন্তীও। প্রধানত বামধারার ছাত্র ও শিশু-কিশোর সংগঠন এবং সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোই ছিল এর উদ্যোক্তা। সে সময় ‘খেলাঘর’ ছিল একটি শক্তিশালী সংগঠন। আমি ‘খেলাঘর’ করিনি, সরাসরি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। তো, নজরুল ও সুকান্তের কবিতা প্রথম দিকে আমাকে বেশ নাড়া দেয়। পরে রবীন্দ্রনাথ গভীর প্রভাব ফেলেছেন আমার চিন্তাচেতনার ওপর। ওই সময় আমাদের দেশে রুশ সাহিত্য আসতে শুরু করেছে। ম্যাক্সিম গোর্কি ও রাশিয়ান অন্য লেখকদের উপন্যাস-গল্প এবং বিপ্লবীদের জীবনকথা পড়ছি। পড়ছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা বই। কিছু বই যা নিষিদ্ধ বলে শুনেছি, তা-ও তখন প্রায় সহজলভ্য, যেমন ছোটদের অর্থনীতি, ছোটদের রাজনীতি, যে গল্পের শেষ নেই প্রভৃতি। এগুলো এবং আরও নানা কমিউনিস্ট সাহিত্য গোগ্রাসে গিলেছি তখন। আমার চিন্তাজগৎকে এগুলোও কমবেশি প্রভাবিত করেছে।
রাহেল: আপনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। আপনার দুটি পরিচয়—শিক্ষক ও লেখক। তবে লেখক হলেও লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার প্রাবন্ধিক পরিচয়টিই বড়। পুরস্কারও পেলেন প্রাবন্ধিক হিসেবে। আপনার সাহিত্যচর্চার শুরু কি প্রবন্ধের মাধ্যমে?
মোরশেদ: না, প্রায় আর সবার মতোই কবিতা দিয়ে আমার শুরু। তবে আমার প্রথম প্রকাশিত রচনা ছিল একটি গল্প, নাম ‘ভুল’। আমি যেখানে পড়তাম, চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, সেই স্কুলের বার্ষিকীর নাম ছিল কিশোর, তাতেই গল্পটা ছাপা হয়। এটি আকারে বেশ বড় ছিল, ফলে সে বছর স্কুল ম্যাগাজিনে একটিই গল্প ছাপা হয়েছিল।
রাহেল: মোরশেদ শফিউল হাসান এই নাম ছাড়া হাসান শফি নামেও লেখালেখি করেন আপনি। এ নামে আপনার বইও আছে। লেখক হিসেবে একাধিক নাম নিয়েছেন কেন?
মোরশেদ: হাসান শফি নামে আমি সাধারণত সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বা রাজনৈতিক প্রসঙ্গ নিয়েই লিখে থাকি। একসময় সরকারি চাকরি করতাম বলে এই নামটা নিতে হয়েছিল। তেমনি নারীবাদী লেখার জন্য আমার অন্য নাম। তবে এসব নাম গ্রহণের পেছনেও কিছু গল্প বা ঘটনা আছে। যেমন একটা ঘটনার কথা বলি, আমার হাসান শফি নামটি গ্রহণের পেছনে ছফা ভাইয়ের (আহমদ ছফা) একটা ভূমিকা আছে। সেটা এরশাদ শাসনামল, সদ্য রাষ্ট্রধর্ম ঘোষিত হয়েছে। তাঁর ও কাজী আকরম হোসেন সম্পাদিত উত্তরণ পত্রিকার বিশেষ ঈদ সংখ্যায় আমার ‘ইসলাম ও মৌলবাদ’ প্রবন্ধটি ছাপার সময়, তিনিই আমার চাকরিগত নিরাপত্তার কথা ভেবে নামটি বদলে দিতে বলেন।
রাহেল: প্রবন্ধের বাইরেও কবিতা ও উপন্যাস লেখেন আপনি। দু-তিন বছর আগে আপনার একটি উপন্যাস বেরিয়েছে—একাত্তর। এত দেরিতে উপন্যাস লেখায় এলেন কেন?
মোরশেদ: সত্যি কথা যদি বলি, মুক্তিযুদ্ধ বা ওই সময়কে নিয়ে লেখা অনেকগুলো গল্প-উপন্যাস, যার কিছু পাঠকপ্রিয়ও হয়েছে, পড়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আমি বইটি লিখেছি। এটা উপন্যাসের শর্ত কতটা পূরণ করতে পেরেছে জানি না। মাত্র নয় মাস স্থায়ী হলেও, আমাদের মুক্তিযুদ্ধও তো পৃথিবীর আর দশটা যুদ্ধ-বিপ্লবের মতো যুদ্ধই ছিল। যুদ্ধের যেমন একটা বীরত্বের দিক রয়েছে, তেমনি আছে নিষ্ঠুরতা, বীভৎসতার দিকও। আর যুদ্ধের প্রথম বলি হলো মানবতা। সব যুদ্ধের বেলাতেই কথাটা সত্য। কোথাও সাধারণ মানুষ যুদ্ধ চায় না, এ দেশে আমরাও চাইনি। যুদ্ধটা বলতে গেলে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ত্রিশ লাখ শহীদের সবাই বুক পেতে গুলি নেয়নি। বীরত্বের পাশেই ছিল কাপুরুষতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অনেক কাহিনি। আমরা এই সময়ের ভেতর দিয়ে এসেছি। অনেক কিছুরই আমরা প্রত্যক্ষদর্শী। ফলে বই পড়ে আমাদের সময়টা সম্পর্কে জানতে, বুঝতে হয়নি। এখন দেখি সবাই উপন্যাসের বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু সময়টা কিংবা যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণার অভাবেই হোক বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একধরনের বীরগাথা রচনার তাগিদ থেকেই হোক, তাঁরা অনেক সময় একাত্তর নিয়ে একধরনের কল্পকাহিনি রচনা করছেন। বিখ্যাত লেখকের এমন উপন্যাসও আমি পড়েছি, যেখানে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধারা পোলাও-কোরমা ও পায়েস খেয়ে, কেক কেটে অপারেশনে বেরোচ্ছেন। তারপর অপারেশন শেষে ফোন করে বাড়িতে তাঁদের সাফল্যের খবর দিচ্ছেন। এসব গালগল্পের মধ্যে দিয়ে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে যেন একধরনের ‘অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। যেখানে শিক্ষিত ও শহরবাসী কিছু মুক্তিযোদ্ধাই নায়ক। এর বিপরীতে আমার ছোট্ট উপন্যাসটিতে আমি চেষ্টা করেছি অল্প কয়েকটি রেখায় মুক্তিযুদ্ধের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে। চেষ্টাই বলব, নিজের লেখা সম্পর্কে এর বেশি কিছু বলা উচিত হবে না।
রাহেল: অনেকে আজকাল বলেন, তরুণ লেখকেরা এখন প্রবন্ধ সাহিত্যে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। বাস্তবতা কি আদতেই এমন? যদি এমন বাস্তবতা হয়, তবে বাস্তবতাটি এমন হলো কেন?
মোরশেদ: তরুণেরা প্রবন্ধ লিখছেন না এমন নয়, তবে তা প্রধানত একাডেমিক চরিত্রের। চাকরি ও পদোন্নতির প্রয়োজন থেকে। উদ্ধৃতি-কণ্টকিত ও প্রায় দুষ্পাঠ্য এসব রচনা সাধারণত পাঠক আকর্ষণ করতে পারে না। পরীক্ষা পাস বা অনুরূপ প্রয়োজন ছাড়া কেউ বিশেষ পড়েনও না। চিন্তার মৌলিকত্ব, বক্তব্যের স্বচ্ছতা এবং ভাষার সারল্য ও দীপ্তিসম্পন্ন প্রবন্ধ প্রায় লেখাই হচ্ছে না। আমাদের মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা মনে হয় এর জন্য বহুলাংশে দায়ী।
রাহেল: লেখালেখির বাইরে একজন লেখকের জন্য আর কোনো কিছুকে কি জরুরি মনে করেন?
মোরশেদ: একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে লেখক অনেক কিছুই করতে পারেন। অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। তবে লেখার টেবিলে একজন লেখক হলেন পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম ব্যক্তি। দল বেঁধে, গোষ্ঠী বানিয়ে বা সংগঠনের জোরে কখনো বড় বা ভালো লেখক হওয়া যায় না। একজন প্রকৃত বা সৎ লেখকের জন্য তাই একা হওয়ার শক্তি ও সাহস অর্জন করাটা জরুরি।