প্রতীকী ভাষার খেলা

ইলেকট্রনিকস গণমাধ্যমে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের ‘টক শো’ অনুষ্ঠানে চলে সমসাময়িক ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ। তবে অনেক সময় সত্য উদ্‌ঘাটনের পাশাপাশি প্রকৃত ঘটনাও চাপা পড়ে পক্ষ-বিপক্ষের তর্ক-বিতর্কে। এসব ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করে প্রতীকী রসিকতায় ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন রিপন সাহা। তাঁর চিত্রজমিনে ক্ষমতার অপব্যবহার, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অসংলগ্ন বিষয় ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে।

কলাকেন্দ্রে এখন চলছে রিপন সাহার প্রদর্শনী। কিউরেটর ওয়াকিলুর রহমান। ‘দ্য এমপায়ার অব ড্রিম’ বা ‘স্বপ্নের স্বপ্নরাজ্য’ শিরোনামের প্রদর্শনীটি মূলত বিভিন্ন সময়ে শিল্পীর বিচিত্র চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ। শিল্পীর একই বিষয়-চিন্তার কাজগুলো সিরিজ অনুযায়ী সাজিয়েছেন কিউরেটর। বলা যায়, ফ্রেমহীন এই ক্যানভাসগুলো প্রদর্শনীতে নতুন মাত্রা দিয়েছে।

 ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘তবে’ ইত্যাদি অব্যয়গুলো বাক্যের পরে বসে বদলে দেয় প্রথম বাক্যের অর্থ। তার্কিকদের ব্যবহৃত এই শব্দগুলো নিয়ে ‘যদি কিন্তু তবে’ শিরোনামের সিরিজচিত্রে উগ্রবাদীদের উত্থান ও তাদের সহিংস কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে পশুর আকৃতি, অসুখী মুখাবয়ব, ধারালো অস্ত্র, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের প্রতীক চিহ্ন বিস্তারিত করেছেন রিপন। এই সিরিজচিত্রে স্ক্রলচিত্র কিংবা পটচিত্রের সাদৃশ্য পাবেন দর্শক।

.
.

প্রাচ্য চিত্রকলার রেখা, বহুকৌণিক দৃষ্টিকোণ, দ্বিমাত্রিকতা, প্রতীক, সাদৃশ্য, পাশ্চাত্যের পরাবাস্তবাদী ধরন, পপ আর্টের আঙ্গিক—সবকিছু একসঙ্গে ব্যবহারের চেষ্টা আছে রিপনের কাজে। তাঁর চেষ্টা স্বপ্ন ও বাস্তবতার সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনার। ফলে অলংকরণধর্মী, ব্যঙ্গাত্মক ও সরল রসিকতায় বিষয়ের সত্যকে সচিত্রকরণ করেছেন তিনি অতিরঞ্জিত উপস্থাপনায়।

বুদ্ধিবৃত্তিক বা ধারণা-প্রধান এসব সিরিজচিত্রের একটির শিরোনাম ‘ক্ষমতার সময়ে’। হাতকে ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বোঝাতে চেয়েছেন শিল্পী। এ ছবিতে হাতের আঙুলের ছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) তিনি ব্যবহার করেছেন ক্ষমতার প্রতীকী হিসেবে। এখানে হাত হয়ে ওঠে পশুর অবয়ব, আর হাতের আঙুল হয় পূর্ণাঙ্গ মানব শরীর। আবার কখনো মুষ্টিবদ্ধ হাতে বন্দী থাকে অসুখী মুখ।

বিস্মৃতিকে খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা মানুষের সহজাত প্রবণতা। স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে দুঃখ বা ভালো লাগার অনুভূতিকে পুনর্বার আবিষ্কার করে মানুষ। এই দর্শন পাওয়া যায় ‘ল্যান্ডস্কেপের খোঁজে’ ছবিতে। মানব চেতনার এমন ছোট ছোট দর্শনকে একত্র করে ‘বোধ’ শিরোনামের সিরিজচিত্র এঁকেছেন রিপন। এমন ছোট ছোট বোধের গল্প আছে তাঁর প্রতিটি ক্যানভাসজুড়ে। আবার ‘নিজস্ব আকাশ’ সিরিজে রয়েছে ফ্যান্টাসিও।

রিপনের প্রদর্শনীতে স্বপ্ন, আশা, ভালো-মন্দ, হতাশা, উৎসব, বিপ্লব, প্রতিবাদ শ্লেষ, অনাচার উঠে এসেছে প্রতীকী ভাষায়। দর্শকের সঙ্গে নিজের ভাবনার মেলবন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন শিল্পী। মানুষের প্রতীকী বহিরাবয়ব দিয়েই ভেতরের অভিব্যক্তিকে শনাক্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর কোনো কোনো কাজে পরিমিতিবোধের অভাব রয়েছে। অতি হাস্যরসাত্মক, কার্টুনধর্মী উপস্থাপনা ও মাত্রাতিরিক্ত সচিত্রকরণের কারণে চিত্রজগুণ ক্ষুণ্ন হয়েছে কোথাও কোথাও। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’, ‘কলাবাগানে স্বাগতম’ সিরিজচিত্রের কথা। কিন্তু আধুনিক করণ-কৌশল ব্যবহারের প্রচেষ্টা এবং পটচিত্রের মতো আলাদা আলাদা ফ্রেমে বন্দী বিভিন্ন ঘটনার সিরিজচিত্র দর্শকদের ভিন্নতর স্বাদ দেবে। ৬ মে শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি শেষ হবে ৩০ মে।