ছুটি রে ছুটি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ছুটি পেয়েই ছুটল ছুটি। ছুটিকে ছুটি দিয়েছেন বাবা। ছুটির বাবা বসে থাকেন মেঘের ওপর। আর তাকিয়ে থাকেন নিচে। দেখেন, কার কখন ছুটি দরকার। কারও ছুটি দরকার হলেই, ছুটি দিয়ে দেন ছুটিকে। আর ছুটিও ছুটি পেয়ে ছুটে গেল। কোথায় গেল?

প্রথমে গেল রায়ানদের স্কুলে।

সবার আগে স্কুলেই ছুটে যায় ছুটি। ছেলেপুলেদের জন্য ভারি মায়া ওর। আহারে! পুরো ছয়টা দিন ক্লাস আর হোমওয়ার্ক করে করে ওরা ক্লান্ত। একদিন যদি ছুটির দেখা না মেলে, তবে কি চলে?

উঁহু, চলে না।

ছুটি আসে। ছেলেপুলেরা কী যে খুশি হয়! ক্লাসঘর থেকে হই হই করতে করতে বেরোয়। ছুটিকে পেলে কার না ভালো লাগে? রায়ানও ছুটি পেয়ে ভীষণ খুশি। আহা, আগামীকাল ছুটি!

এরপর ছুটি যায় রায়ানের বাবার অফিসে।

সারা সপ্তাহ এটা ওটা করে করে হাঁপিয়ে ওঠেন রায়ানের বাবা। ছুটি পেয়ে তিনিও খুশি। কিন্তু...

রায়ানের ছুটি সহ্য হয় না রায়ানের বাবার। ছুটির দিনেও বইখাতা দিয়ে বসিয়ে দেন রায়ানকে।

ছুটির ওপর খুব রাগ হয় রায়ানের। রাগের চোটে গণিতে ভুল করে। ইংরেজি ট্রান্সলেশনে ভুল করে। বাংলায় কবির নাম মনে পড়ে না। ধেৎ! ছুটির দিনে কেউ পড়তে বসে?

কত দিন রায়ান ভেবেছে, ছুটিটা একই দিনে কেন আসে? একদিন বাবার অফিসে আর অন্যদিন ওর স্কুলে এলে কী হতো!

রায়ানের ভাবনাটা কেমন করে যেন বুঝে ফেলল ছুটি। এক ছুটে ছুটি গেল তার বাবার কাছে। বলল, ‘বাবা, আমি দুদিন ছুটি চাই।’

ছুটির বাবাও তখন ছুটি কাটাচ্ছিলেন। আজ আর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে না। উফ! সারা সপ্তাহ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকা কি চাট্টিখানি কথা! ঘাড় ব্যথা হয়ে যায়।

এক গোছা তুলো মেঘ জোগাড় করেছেন বাবা। মাথার নিচে মেঘের তুলো দিয়ে একটু আরাম করবেন শুয়ে শুয়ে। আর তখনই ছুটিটা এল!

গম্ভীর গলায় বাবা বললেন, ‘দুদিন ছুটি দিয়ে কী করবে?’

ছুটি বলল, ‘একদিন বাবাদের ছুটি দেব। আরেক দিন ছেলেপুলেদের।’

‘কেন?’

‘নইলে যে ছেলেপুলেদের ছুটি মেলে না। ছুটির দিনেও ওদের রেহাই নেই। বই-খাতা নিয়ে বসতে হয়।’

বাবা বললেন, ‘কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়!’

‘কেন?’

‘সপ্তাহে ছুটির দিন একই হওয়ার নিয়ম। দুই হওয়ার নিয়ম নেই।’

‘নিয়ম কি ভাঙা যায় না?’

‘না।’

‘তাহলে উপায়?’

বাবা বললেন, ‘সেটা তুমিই বের করে নাও বাছা। আমি এখন ঘুমোলাম। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না। দেখছ না আমি ছুটি কাটাচ্ছি!’

বলেই আয়েসে চোখ বুজলেন বাবা।

২.

রাগে গজগজ করতে লাগলেন রায়ানের বাবা। দাঁত কিটমিট করে বললেন, ‘এত্ত ভুল! এত্ত ভুল! পুরো সপ্তাহ যা যা করেছ আজ সবকিছু রিভিশন করবে।’

এবার কেঁদে ফেলল রায়ান। বারান্দায় গিয়ে একবার দেখে এসেছে, সামনের রোডের মনিররা খেলতে যাচ্ছে। ছুটির দিনে একটু আধটু ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে হয়। নইলে কি আর চলে?

আর ঠিক তখুনি বাবার মোবাইল বেজে উঠল। কার সঙ্গে যেন আলাপ করলেন বাবা। রায়ান খেয়াল করল, বাবার মুখটা মলিন হয়ে গেল।

ছুটে এলেন মা। জানতে চাইলেন, ‘কার ফোন?’

বাবা বললেন, ‘আর বোলো না, অফিস থেকে ফোন এসেছে। এক্ষুনি যেতে হবে।’

মুখটা ভার করে মা বললেন, ‘ছুটির দিনেও?’

 ‘হুঁ।’

চটপট তৈরি হয়ে চলে গেলেন বাবা।

রায়ান এখন কী করে? বাবা যে কাজগুলো দিয়ে গেছেন, সেগুলো করতেই হবে। নইলে বাবাকে অসম্মান করা হয়। মন দিয়ে কাজগুলো করার চেষ্টা করল রায়ান। কিন্তু কেন যেন মন বসাতে পারছে না। ছুটির দিনে কি পড়ায় কারও মন বসে?

খানিক পরে কলবেলের শব্দ। দরজা খুলেই রায়ান অবাক। বলল, ‘বাবা!’

বাবার মুখ হাসি হাসি। মা ছুটে এলেন কে এসেছে দেখার জন্য। বাবাকে দেখে মায়ের মুখটাও ঝলমল করে উঠল খুশিতে। মা জানতে চাইলেন, ‘যাওনি?’

বাবা বললেন, ‘না। একটু আগে আবার জানাল আসার দরকার নেই। কাজটা আগামীকাল করলেও চলবে। আর গিয়েও তো কাজে মন বসাতে পারতাম না। ছুটির দিনে কি কারও কাজে মন বসে?’

মা বললেন, ‘তা তো ঠিকই।’

রায়ান তখনো পড়ায় মন বসানোর চেষ্টা করছিল। হঠাৎ বাবা এসে রায়ানের পিঠে হাত রাখলেন। বললেন, ‘থাক রায়ান। ছুটির দিনে আর পড়তে হবে না। ছুটির দিনে আবার কিসের পড়া? তোমার ছুটি।’

অবাক চোখে বাবার দিকে তাকাল রায়ান। ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না। চেঁচিয়ে উঠল, ‘সত্যি!’

হাসি হাসি মুখে বাবা বললেন, ‘সত্যি।’

 ‘হুররে...’

বলেই বই-খাতা বন্ধ করে ছুটল রায়ান। আজ ও ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে পারবে। যেতে যেতে বলল, ‘ধন্যবাদ ছুটি।’

৩.

খেতে বসে রায়ান তো অবাক। মা আজ এত রান্না করেছেন! ছুটির দিন বলে কথা। রায়ান আর বাবার ছুটি মানেই কি মায়ের ছুটি? বরং ওদের ছুটির দিনে মায়ের কাজ থাকে অনেক বেশি। এই যে আজ এত রান্না করেছেন।

মাঝে মাঝে বিশেষ দিনেও ছুটে আসে ছুটি। এই যেমন ভাষা দিবস, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, পুজোর দিন, ঈদের সময় তো কয়েক দিন, বড়দিনের সময়, বৌদ্ধ পূর্ণিমার দিন। কিন্তু মায়ের কাছে একদিনও আসে না। না বিশেষ দিনে, না সপ্তাহে একদিন। রাতুলের মা অফিসে যান। সপ্তাহে একদিন ছুটিও পান অফিসে। কিন্তু বাসায় ছুটি পান না। ছুটির দিনে বাসায় বরং অনেক কাজ থাকে তাঁর।

আর রায়ানের মা? তিনি তো অফিস করেন না। সারা সপ্তাহ ধরে কাজ করেন। একদিনও ছুটি নেই।

খেতে খেতে রায়ান বলল, ‘মা, ছুটির সঙ্গে কি তোমার কখনো ঝগড়া হয়েছিল?’

কথা শুনে বাবা-মা দুজনই অবাক। মা বললেন, ‘মানে!’

রায়ান বলল, ‘আমরা তো সপ্তাহে একদিন ছুটি পাই। কিন্তু তুমি? তুমি তো ছুটি পাও না। কেন?’

এর কোনো জবাব নেই মায়ের কাছে। তাই জবাব দিতে পারলেন না।

রায়ান ভাবে, মনে হয় ছুটির সঙ্গে মায়েদের কোনো এক কালে ঝগড়া হয়েছিল। নইলে মায়ের কাছে ছুটি আসে না কেন? আচ্ছা, ছুটির সঙ্গে মায়ের ঝগড়াটা কি মিটিয়ে ফেলা যায় না?