অপারেশন আম-কাঁঠাল

দুপুর গড়াতেই বিপদ! কার? আম-কাঁঠাল বাহিনীর। গাছের ওপর থেকে হাত ফসকে নেইল কাটারটা পড়ল অবসরপ্রাপ্ত জেলার আলী হোসেনের পেটে। গরমে তিনি ঘরে ঘুমাতে পারেন না। চামড়ায় জ্বালাপোড়া করে। মাথা গরম হয়ে যায়। মাথা গরম হলেই বাধে গন্ডগোল! কী বলতে কী বলে ফেলেন তার ঠিক-ঠিকানা নেই। চোখেও ডবল দেখা শুরু করেন। এই সেদিনও মাথা গরম হয়ে যাওয়ার পর সব ডবল দেখতে শুরু করেছিলেন। মাথায় জবা ফুলের তরল ঘষলেন কয়েকজন। তাতেও কাজ হয় না দেখে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেই ওলট-পালট বকা শুরু করলেন। ডাক্তার সাহেব বললেন, ‘আচ্ছা, আপনি আগে এই চেয়ারটায় বসুন। তারপর কথা বলুন।’ জেলার আলী হোসেন বলেন, ‘কোন চেয়ারটায় বসব ডাক্তার সাহেব?’ ডাক্তার বলেন, ‘চেয়ার তো একটাই।’

‘আমি যে দুটি দেখছি।’ জেলার সাহেবের কথা শুনে ডাক্তার হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, যেকোনো একটায় বসে পড়ুন।’ আর বসতে গিয়েই ধপাস! যেখানে চেয়ার নেই সেখানেই বসে পড়লেন জেলার সাহেব। তারপর ডাক্তার ঘুমের ট্যাবলেট দিলেন। এক ট্যাবলেট খেয়ে দুই দিন ঘুম দিয়ে উঠে আজ এসে শুয়েছিলেন প্রিয় দুধচিনি আমগাছের গোড়ায়। ঢাকার পল্টনের ভাই ভাই বন্দুক ঘর থেকে কেনা বন্দুকটাও পাশে। বিশাল পিঁপে সাইজের পেটটা ওপরে দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে ছিলেন। আর তখনই পড়ল নেইল কাটার! ছুরিটা বের করাই ছিল। একটুর জন্য পেট লিক করেনি। গন্ডারের চামড়া বটে! তবে লেগেছে খুব। তা আন্দাজ করা যায় জেলার সাহেবের চোখে চোখ রাখতেই! জেলারদের চোখ এমনিতেই লাল মোরগফুলের মতো ফুটে থাকে। সেই চোখে যদি রাগ মেশে তবে তো কথাই নেই! হম্বিতম্বি না করে অধিক শোকে পাথর হয়ে চোখ খুলে গাছের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।

ওদিকে গাছের ওপরে যারা, তাকিয়ে রইল তারাও। চোখের পলক পড়ে না কারও। তারপর? জেলার সাহেবের চোখের পলক পড়ার আগেই একে একে ব্যাঙ লাফ দিয়ে থপাস করে একেকজন পড়তে থাকল নিচে। জেলার সাহেব তাকিয়ে আছেন। তাকিয়েই আছেন। একজন হাতের লবণ-মরিচ ছুড়ে দিল জেলারের লাল চোখে। ওরে মা-আ-আ-গো, বা-বা-গো-ও-ও বলে চেঁচাচ্ছেন তিনি। ওদিকে পালিয়ে গেল তারা।

তবে পালাতে পারল না তারা। এম এম তারা। মানে মঞ্জুর মুহসিন তারা। অপারেশন আম-কাঁঠাল বাহিনীর কাছে সে মদন মোহন তারা নামে পরিচিত। খুবই সহজ-সরল ছেলেটা। পড়ালেখা ছাড়া আর কিছুই পারে না! তাকে দলে ভেড়াতে চায়নি কেউই। তবু সে কেঁদেকেটে ঢুকেছে। তারপর থেকেই গন্ডগোল! যার-তার হাতে ধরা পড়ে যায়। কিছুদিন আগেও ধরা পড়েছিল এই জেলার সাহেবের কাছেই। ছক্কা মেরে জানালার গ্লাস ভেঙে দেওয়ার মামলায় জরিমানা হয়েছে ওদের। সবার টিফিনের টাকা আর স্কুল থেকে পাওয়া মঞ্জুর মুহসিন তারার বৃত্তির টাকা জেলারের হাতে তুলে দিয়ে রেহাই পেয়েছিল। সেদিন রাফি তাকে দলের মাঝখানে বসিয়ে বলেছিল, ‘তোকে দেখলেই বোঝা যায়, কিছু কিছু প্রাণী কেন নিজেদের বাচ্চাকাচ্চা খেয়ে ফেলে!’ সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। সে ফের বলে, ‘তোরে দলে না রেখে খেয়ে ফেলাই উচিত আমাদের! ভাগ্যিস তোর বাবা-ভাই কেউ হই না আমরা, নাহয় খেয়েই ফেলতাম!’

এমন কথায় কান্নাকাটি শুরু করে মঞ্জুর মুহসিন তারা। একেবারে হেঁচকি উঠে যায়। তারপর বলে, ‘আর একবার সুযোগ দিয়ে দেখ। তখন বুঝিয়ে দেব; হুম!’ দলের সবাই তাকে সুযোগ দিতে রেখে দিল। আর সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে সে! ধরা পড়েছে আজও। তাকে হাতে ধরে চেঁচাচ্ছেন জেলার সাহেব। তবে চোখ খুলতে পারছেন না লবণ-মরিচের যন্ত্রণায়। এই সুযোগটা কাজে লাগাল দলের অন্য সদস্যরা। চারদিক থেকে এসে কাতুকুতু দিয়ে মঞ্জুর মুহসিন তারাকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভোঁ-দৌড়! জেলার সাহেব হাতড়ে হাতড়ে মাটি থেকে বন্দুকটা তুলে নিয়ে ফাঁকা আওয়াজ করলেন। এখানেও গন্ডগোল! বুলেট গিয়ে লাগল গাছে। অমনি ধপাস; আম পড়ল মাথায়। টাক মাথাটা থেঁতলে যাওয়ার দশা! পেট, চোখ আর মাথা নিয়ে নাজেহাল দশা!

ওদিকে আম-কাঁঠাল বাহিনী আরেকটা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সেখানেও হয়তো জেলার সাহেবের মতো কেউ ওত পেতে বসে আছে। গাছে উঠলেই ধরবে। তবে পাহারাদার থেকে বাঁচার যথেষ্ট কায়দা আবিষ্কার করে ফেলেছে ওরা এত দিনে। গ্রীষ্মে ছুটির ঘণ্টা পড়ে আম-কাঁঠালের। তাই ওরা দল বেঁধে আম-কাঁঠাল অপারেশনে নামে। ক্লাসের ফার্স্টবয়কে সঙ্গে নিয়ে আজ এ-পাড়ায় তো কাল ও-পাড়ায়। এ সময়টায় কক্সবাজার, বান্দরবান, সুন্দরবন বেড়ানোর লোভ নেই ওদের। সে জন্য তো সারা বছর পড়েই আছে। হোমওয়ার্ক করে না কেউ। তা করেই কী লাভ; ছুটি শেষে স্কুলে গেলেই তো নতুন রুটিন আর নতুন স্যার! বড়রা কবে বুঝবে এসব?