আহমদ ছফার প্রশ্ন ও অনুসন্ধান

আহমদ ছফা ( ৩০ জুন ১৯৪৩—২৮ জুলাই ২০০১) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
আহমদ ছফা ( ৩০ জুন ১৯৪৩—২৮ জুলাই ২০০১) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ আরোপিত-বহিরাগত মত ও পথ অনুসারে পরিচালিত হয়। জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ‘স্বাধীন’ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে বহিরাগত বর্গের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মত জানানোর প্রবণতা এখানে খুবই প্রবল

জীবদ্দশায় আহমদ ছফাকে তরুণ সাহিত্যিক ও চিন্তককুল পছন্দ করত; এখনো করে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রবীণ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক সমাজের সমর্থন তিনি বোধ হয় অতটা পাননি। এর এক প্রমাণ এই যে সাহিত্যিক-বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের জন্য যেসব রাষ্ট্রীয়-প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা আছে, ছফার ভাগে তার খুব সামান্যই পড়েছিল। অবশ্য আহমদ ছফা কেন বাংলা একাডেমি বা অন্য অনেক পুরস্কার পাননি, সে প্রশ্ন এখন আর কোনো তাৎপর্য বহন করে না; যেমন তলস্তয়ের নোবেল পুরস্কার না পাওয়া তাঁর সাহিত্যিক বিবেচনার জন্য মোটেই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। কিন্তু ছফার ক্ষেত্রে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, প্রাতিষ্ঠানিক-রাষ্ট্রিক স্বীকৃতির অপ্রতুলতার বিচার-বিশ্লেষণ করার অন্য এক তাৎপর্য আছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতাকে যেমন চেনা যায়, ঠিক তেমনি ছফাকেও চিনে উঠতে সুবিধা হয়।

অথচ ছফা যে বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক দিকগুলোতে খুব বৈপ্লবিক কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা নয়। বায়ান্ন-উনসত্তর-একাত্তরনির্ভর বাংলাদেশের মূলধারার বয়ানে তাঁর নিঃসংশয় আস্থা ছিল। উনিশ শতকীয় রেনেসাঁসের গালগল্পে তিনি যথেষ্ট পরিমাণে বিশ্বাস করতেন, যদিও এ ব্যাপারে তাঁর এমন কিছু প্রশ্ন ছিল, যা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মূলধারায় খুব সুলভ নয়। চিন্তা, রাজনৈতিক তৎপরতা আর পদ্ধতির দিক থেকে তিনি মোটেই মার্ক্সবাদী ছিলেন না; কিন্তু সামাজিক স্তরবিন্যাস এবং অর্থনৈতিক হালচালের দিকটা বিবেচনার মধ্যে রাখতেন। সাহিত্যই করতেন তিনি; কিন্তু তাঁর সমবয়সী ঢাকার বিপুল-অধিকাংশ সাহিত্যিক তিরিশি নন্দনতত্ত্বের জোয়ারে যেভাবে ভেসে গিয়েছিলেন, ছফার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি। সাহিত্যকে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত কোনো নান্দনিক লোকের চর্চা মনে করতেন না। আহমদ ছফার একজন তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষক সলিমুল্লাহ খান একবার বলেছিলেন, ছফা উপন্যাসকে ‘উপন্যাসত্ব’ থেকে মুক্ত করেছেন। কথাটা গভীরভাবে মূল্যবান। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বর্তমান বিশ্লেষণে কেবল এ কথা বলাই যথেষ্ট হবে যে সাহিত্যচর্চা এবং সাহিত্য-বিবেচনার ক্ষেত্রে ছফার বিশেষত্ব ছিল।

এটুকু বিশেষত্ব যেকোনো সাহিত্যধারা বা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বৃহত্তর পরিধির মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্যে এঁটে যাওয়ার কথা। ছফা যে আঁটেননি, নানা ধরনের অস্বস্তি তৈয়ার করেছেন, তা থেকে দুটি জিনিস বোঝা যায়। বোঝা যায়, ছফা প্রশ্নাকুল ছিলেন। কিছু প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন, যেগুলো প্রচলিত মিথে বুঁদ হয়ে থাকা কাঠামোর জন্য সুখকর নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ শোচনীয়ভাবে সংকীর্ণ। একমাত্রিক। ভিন্নমতের সামান্য আলামত পেলেই তাকে রুখে দিতে চায়। ঢেকে দিতে চায় অনুল্লেখ আর অস্বীকৃতির চাদরে। অবশ্য ছফা যদি তাঁর এই ভিন্নমতগুলো নিয়ে নীরবে সাহিত্যচর্চা করে যেতেন, তাতে অন্যরা হয়তো খুব একটা গোসসা হতেন না। কিন্তু ছফার ক্ষেত্রে তা হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন এ বঙ্গের অতি-তৎপর বুদ্ধিজীবীদের একজন। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার মধ্যে আগুন ছিল, বিরোধ ছিল, আর ছিল দেশ ও জনগোষ্ঠীর জন্য সদা জাগ্রত কল্যাণের বোধ। তাঁর সমস্ত কাজ এবং কথা অবিমিশ্র সত্য আর সততার আকর—এমন কোনো সিদ্ধান্ত প্রচার করা আমাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার যে আলাদা মেজাজ ছিল, সে কথাটা জোর দিয়ে বলা দরকার।

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রধান লক্ষণ কী? ছফা নিজে একবার এই বুদ্ধিজীবী সমাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এই বলে যে বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন স্বাধীনতার পরেও তাঁদের মত অনুযায়ী চললে বাংলাদেশের উন্নতি হবে না। তিনি অবশ্য কথাটা তত্ত্বীয়-প্রায়োগিক দিক থেকে ব্যাখ্যা করে বলেননি। কিন্তু তাঁর কথার সারবত্তা অস্বীকার করার জো নেই। বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ আরোপিত-বহিরাগত মত ও পথ অনুসারে পরিচালিত হয়। জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে ‘স্বাধীন’ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরিবর্তে বহিরাগত বর্গের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মত জানানোর প্রবণতা এখানে খুবই প্রবল। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চার অপ্রতুলতা এর প্রধান কারণ। চর্চায় ও গবেষণায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের খামতি থাকার কারণে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী-সমাজ খুব সহজেই আরোপিত-বহিরাগত সিদ্ধান্ত ও বর্গের খপ্পরে পড়ে যায়। ছফার কালে এসবের উৎস ছিল অংশত পশ্চিম, আর শ্রেষ্ঠাংশে কলকাতা। একালে কলকাতার ভাগ বোধ হয় খানিকটা কমেছে; কিন্তু ধরনটা খুব বেশি বদলায়নি। ছফা, আগেই বলেছি, অন্য অনেক ব্যাপারের মতো এ ক্ষেত্রেও বিপ্লবী বা আমূল পরিবর্তনবাদী ছিলেন না। কলকাতার সাংস্কৃতিক ভোগ্যপণ্যে বা বুদ্ধিবৃত্তিক মিঠাই-মন্ডায় তিনি কখনো বিরাগ দেখাননি। কিন্তু কলকাতার কারখানায় প্রস্তুত ধারণাগুলো তিনি বাছবিচার না করে হুবহু ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার এক পা ছিল ইতিহাসের গভীরে, অন্য পা বর্তমানের বাঁকাত্যাড়া বাস্তবতায়। আমি এখানে আহমদ ছফার ইতিহাস-অনুধ্যানের দুটি মাত্র উদাহরণ দেব।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্তের ছোট কিন্তু তীক্ষ্ণ অ্যালিগরি তিনি দাখিল করেছেন তাঁর ওঙ্কার উপন্যাসে। উপন্যাসটির নান্দনিকতা আর রাজনৈতিকতার বয়ান এখানে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নয়। আমরা শুধু স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটা ছোট দিকে ছফার মনোযোগের কথা বলব। যারা পাকিস্তান আন্দোলন করেছিল, যারা পাকিস্তানের তেইশ বছর ক্ষমতার মধু আহরণ করেছিল, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষের লড়াই-সংগ্রামকারীদের পার্থক্য কতটা? কোন কোন স্তরে? পার্থক্যটা কখন সূচিত হয়েছিল? ছফা তাঁর বাস্তব ও কাণ্ডজ্ঞান থেকেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে পার্থক্যটা মৌলিক নয়। তার মানেই হলো, ‘প্রগতি’ ও ‘প্রতিক্রিয়াশীলতা’র বাইনারিতে ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করার যে প্রভাবশালী রেওয়াজ বাংলাদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত, তার ঐতিহাসিক ভিত্তি খুবই নড়বড়ে। অন্তত জনগোষ্ঠীর বাস্তব তৎপরতা থেকে তা প্রমাণ করা মুশকিল।

ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক অবস্থান বাংলাদেশের মূলধারার চর্চা থেকে খুব বেশি দূরবর্তী মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছে
ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক অবস্থান বাংলাদেশের মূলধারার চর্চা থেকে খুব বেশি দূরবর্তী মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছে

তাহলে পার্থক্যটা সূচিত হলো কবে? ছফার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর শুধু প্রস্তুত নয়, খুব জরুরিও বটে। ফারাকটা তৈরি হয়েছে মুক্তি-উন্মুখ মানুষের অংশগ্রহণে ঘটা নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। তখন বহু কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ সম্ভাব্য বাস্তবতা সম্পর্কে হুঁশিয়ার হয়েছে, অনেকেই ভোল পাল্টে জনগণের মন-জয়-করা রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মূল্যবোধজনিত বা আদর্শিক কারণে বিচ্ছিন্নভাবে হয়নি; বরং জন-উপলব্ধি ও জন-তৎপরতা নতুন আদর্শের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাকে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে। বা বলা দরকার, যারা তা করতে পেরেছে, তারাই জনগণের পক্ষে থাকতে পেরেছে। বিপুল সুবিধাবাদী মধ্যবিত্ত বাস্তবতার চাপে সে রূপরেখায় দাখিল হতে বাধ্য হয়েছে। এ বিবরণী ছফার জন্য জরুরি ছিল। কারণ, ছফা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেবল জনযুদ্ধই মনে করতেন না, একে এই অঞ্চলের গণমানুষের হাজার বছর ধরে চলা মুক্তিসংগ্রামের সফল পরিণতি হিসেবেই দেখতেন। সেই পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে তিনি বর্তমানকে কীভাবে মেলাতেন, তার একপ্রস্থ নজির দেওয়া যাক।

বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে ছফা কেবল পাকিস্তান পর্বেই নিজেকে সীমিত রাখেননি। তাঁর অসংখ্য লেখা প্রমাণ করে, অন্তত আর্য-অধিগ্রহণের কাল থেকে তিনি ব্যাপারটা বুঝতে চেয়েছেন। নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ [১৯৯৫] গ্রন্থভুক্ত ‘স্মরণ: দীনেশচন্দ্র সেন’ প্রবন্ধে দীনেশচন্দ্রকে পড়তে গিয়ে সে কথাই সংক্ষেপে লিখেছেন। এ প্রবন্ধে আহমদ ছফা খেয়াল করেছেন, বাংলার লোকসাহিত্য, পল্লিসমাজ এবং লোকসংস্কৃতিকে দীনেশচন্দ্র সেনের মতো অতটা হৃদয়গ্রাহী করে আর কেউ গ্রহণ করেননি। কিন্তু ছফার চিন্তার কেন্দ্রে ছিল জাতি ও রাষ্ট্র, জাতিরাষ্ট্র। ফলে শুধু সংস্কৃতিপ্রেম—তা লোক হোক আর নাগরিক হোক—তাঁর প্রশংসার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তিনি দীনেশের যাবতীয় চর্চার মধ্যে আবিষ্কার করেছেন বঙ্কিমচন্দ্রের এক কাউন্টার-থিসিস। বাঙালির মধ্যে সাবালক রাষ্ট্রচিন্তক হিসেবে ছফার কাছে বঙ্কিমের মূল্য ছিল। কিন্তু ওই রাষ্ট্রচিন্তায়, ছফার মতে, গুরুতর গলদ ছিল। কারণ বঙ্কিমের নির্ভরতা ছিল সংস্কৃত সাহিত্য, ব্রাহ্মণ্যবাদ, গীতা, বেদ ইত্যাদির ওপর। এগুলোর নিরিখেই তিনি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তা খাঁড়া করেছিলেন। বিপরীতে দীনেশের অবলম্বন শাস্ত্র নয়, সমাজ; ধর্ম নয়, মানুষ। ‘সে মানুষ হিন্দু না মুসলমান, এটা তাঁর ধর্তব্যের বিষয় ছিল না’। ফলে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর কালের উপকরণ ব্যবহার করে, তাঁর মেধা ও কর্মক্ষমতা ব্যবহার করে হিন্দু সমাজকে ‘গোটা বাঙালী জাতীয়তার প্রেম থেকে সরিয়ে’ একটা ‘উল্টো ভিত্তির উপর দাঁড়’ করিয়েছিলেন। আর দীনেশচন্দ্র যেন কাজ করেছিলেন বঙ্কিমের গোটা প্রকল্পের বিপরীতে। ছফার কাছে সে কাজের মূল্য অপরিসীম। কারণ দীনেশের কাজেও তিনি রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যতের পরিকল্পনা দেখেছিলেন; আর তাঁর কাজের ‘পন্থা’ মনে হয়েছিল অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক ও মানবিক।

এখানে বঙ্কিমচন্দ্র আর দীনেশচন্দ্র সম্পর্কে ছফার যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেওয়া হলো, তাতে তাঁর ‘রাজনৈতিকতা’র পরিচ্ছন্ন প্রকাশ আছে। উনিশ শতকের কলকাতায় প্রভাবশালী ডিসকোর্স হিসেবে হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সংস্কৃতিচিন্তার যে প্রবল প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল, তার বিশোধনের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু আমরা জোর দিতে চাই তাঁর ‘পন্থা’র ওপর। দেখা যাচ্ছে, বঙ্কিমচন্দ্র ইউরোপীয় শিক্ষার বরাতে ‘সোনালি অতীতে’র ভারতীয় ক্ল্যাসিক ব্যবহার করে বর্তমানের জন্য যে দাওয়াই দিচ্ছেন, তা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। অপছন্দের দাওয়াই যে উৎপাদিত হলো, তার জন্য ছফা বঙ্কিমের চিন্তার ‘পন্থা’কেই দায়ী করছেন। ব্যাপারটা অন্তত অংশত ছফার নিজের কর্ম ও চিন্তাপদ্ধতি বুঝতে সাহায্য করে। ছফা বর্তমান জনগোষ্ঠী নিয়ে কাজ করেছেন। সে জনগোষ্ঠীর মুক্তি রাজনৈতিক চিন্তা ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই হবে—তাতে তাঁর কোনো সন্দেহ ছিল না। এর প্রয়োজনে তিনি পশ্চিমা রাষ্ট্রের বিকাশ পর্যবেক্ষণ করেছেন, কলকাতার সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদান বিছড়িয়ে দেখেছেন, আর দূর গভীর পর্যন্ত তত্ত্ব-তালাশ করেছেন। ওগুলোর বরাতে কোনো আদর্শ বা মান প্রতিষ্ঠা করে বর্তমানকে ভালো বা খারাপ হিসেবে সাব্যস্ত করা তাঁর ‘পন্থা’ ছিল না। তবে ইতিহাসের গভীর থেকে বা জনজীবনের বিপুল বিস্তার থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। তাই তাঁর সিদ্ধান্ত সমসাময়িক বা জ্যেষ্ঠ অনেকের চেয়ে আলাদা হয়েছে।

আগেই বলেছি, ছফার বুদ্ধিবৃত্তিক বা সাহিত্যিক বা ঐতিহাসিক অবস্থান বাংলাদেশের মূলধারার চর্চা থেকে খুব বেশি দূরবর্তী মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছে। এর এক কারণ মূলধারার সংকীর্ণতা। অন্য গুরুতর কারণ, ছফা মিথকে প্রশ্রয় দিতে চাননি, যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন করতে চেয়েছেন। বিপরীতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ মূলত মিথেই বসত করেন, লেখালেখির মধ্যেও মিথকেই জোরালো করেন। এ প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ পরে দেব। আপাতত এর পরিণাম সম্পর্কে বলি। বুদ্ধিজীবীর ‘স্বাধীন’ সত্তা তৈয়ার হয় ‘সত্য’ উদ্‌ঘাটনের দায়বদ্ধতায় এবং গণমানুষকে সম্বোধন করতে পারার ক্ষমতায়। এ দুইয়ের অভাব ঘটলে বুদ্ধিজীবী—কথা এবং কলমের শক্তি আছে যেহেতু আবশ্যিকভাবে দলীয় প্রচারকের কোঠায় দাখিল হবেন। বাংলাদেশে এ জাতীয় বুদ্ধিজীবীর সংখ্যাধিক্য এ কারণেই। ছফা যে একবার সিপাহিবিদ্রোহেরইতিহাস লিখেছিলেন, তার প্রতীকী মূল্য অপরিসীম। বোঝা যায়, তিনি ইতিহাসকে গোঁজামিলের অন্ধকারে রাখতে চাইতেন না। পরিচ্ছন্ন করতে চাইতেন। এ পরিচ্ছন্নতা আসলে বর্তমানকে পাঠ করার জরুরি শর্ত। আমাদের বর্তমান প্রস্তাব বোঝার জন্য একবার সাতচল্লিশের প্রসঙ্গ টানব।

বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে সাতচল্লিশ এক অন্ধকার এলাকা। বিভাগপূর্ব ইতিহাস, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম মিলিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ বয়ান তৈরির উচ্চাভিলাষ খুব সামান্যই দেখা গেছে। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্ব, দেশবিভাগ, মুসলিম লিগ, পাকিস্তান ইত্যাদি সম্পর্কে ভাবাবেগ-প্রধান ও বিশেষণ-কণ্টকিত মন্তব্য যথেষ্ট উচ্চারিত হয়। ‘দুই জাতি’র ভিত্তিতে বাংলাদেশে বহু সাতচল্লিশ-পূর্ব ইতিহাস প্রণীত হয়েছে। বলা হয়েছে, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস বাঙালির হিন্দু থেকে আলাদা। তার অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আলাদা। এভাবে ‘দুই জাতি’র ভিত্তিতে সমস্ত বিবরণী প্রস্তুত করে ‘সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বে’র ভিত্তিতে দেশভাগ হয়...ইত্যাদি। আহমদ ছফা তাঁর জীবনের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ‘তত্ত্ব’ যদ্যপিআমারগুরুতে সম্ভবত প্রধানত এই গোঁজামিলের নিরসন করে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বয়ান উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন, তেইশ বছরের ব্যবধানে একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠী দুইবার মুক্তির লড়াই লড়েছে—এতে কোনোভাবেই লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং অনুপ্রাণিত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান আছে। তিনি কোনো একরৈখিক বয়ান চাননি—চেয়েছেন পরিচ্ছন্নতা, চেয়েছেন সামঞ্জস্য। যাঁরা মিথে ভর করে ‘আদর্শবাদী’ থাকতে চান, তাঁদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ তৈরি হওয়ার এ-ও এক কারণ।

ছফার লেখালেখিতে, তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় বর্তমানময়তা আছে, আছে ইতিহাসের পরিচ্ছন্নতা। তৃতীয় উপাদান গণমানুষের প্রতি অঙ্গীকার, এবং তা রাজনৈতিক অর্থে। ছফার আরও ছিল সাহস। তাঁর ক্ষেত্রে এ সাহস এসেছে ইতিহাসবোধ থেকে, অঙ্গীকার থেকে। ছফার উত্তরসূরি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় নিয়োজিত তরুণের সংখ্যা রীতিমতো উল্লেখযোগ্য। তাঁদের অনেকেই সাহসের সমাচার পেয়েছেন, অনুমান করি, ছফার কাছ থেকে। তাঁরা লড়ছেন বিদ্যমান কাঠামোর সঙ্গে। প্রভাবশালী বয়ান আর ক্ষমতাকাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধও করছেন। কিন্তু তাঁদের অনেক প্রশ্ন, তাঁদের অনুসন্ধান যথেষ্ট গভীরতা বা বিস্তৃতি পাচ্ছে না বলেই মনে হয়। সম্ভবত অঙ্গীকারের অভাব আছে, আরও গোড়ায় আছে পরিচ্ছন্ন ইতিহাসবোধের অভাব।