প্রতিদিন মনে পড়বে

বারডেম হাসপাতালের পঞ্চম তলার প্রশস্ত করিডরে ভুতুড়ে আলোছায়া। কোথাও কেউ নেই। শুধু করোনারি কেয়ার ইউনিটের দরজার কাছে একটা টুলে বসে ঝিমাচ্ছে গাঢ় সবুজ ইউনিফর্ম পরা এক লোক। জোড়া হাঁটুর মাঝখানে দুই হাত, জড়সড়, যেন শীত লাগছে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে; তন্দ্রার আবেশে ঢুলছে।

আমি কাছে গিয়ে গলা খাঁকরে তার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হলো না, সে একইভাবে ঢুলতে থাকল। তার কাঁধের ওপর আলতো করে একটা হাত রাখলাম। এবার সে নড়েচড়ে উঠে বিকট এক হাই তুলে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমি বললাম, ‘ভাই, একটু ভেতরে যাব।’

‘পাকাঝি দকুমেন্ত’, ঘুমজড়ানো ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় বলল সে, খাঁটি রুশ ভাষায়: পরিচয়পত্র দেখা।

অনুনয়ের সুরে বললাম, ‘নাই, হারিয়ে ফেলেছি।’

সে আবার চোখ বুজতে বুজতে বলল, ‘তাহলে বাড়ি যা।’

হাত জোড় করে কাকুতিমিনতি করতে লাগলাম। সে বন্ধ চোখেই নির্বিকার কণ্ঠে বলল, ‘নি মিশাই, ইদি দামোই।’ বিরক্ত করিস না, বাড়ি যা।

হঠাৎ আমার খুব রাগ হলো, দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম, ‘এখ্ ব্লিয়াদ! বাখতিওর নাশোল্‌সা!’ শালা দারোয়ান আইছে!

গালি খেয়ে চোখ খুলে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘আরে, আমি কিসের বাখতিওর? আসল বাখতিওর তো গর্বাচভ।’

চেঁচামেচি শুরু করে দিলাম। ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে লেকচার দিতে লাগলাম: স্তালিন থেকে ব্রেঝনেভ পর্যন্ত সব জেনারেল সেক্রেটারিকে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী ডিকটেটর বলে নিন্দামন্দ করে চললাম। শেষে বললাম, এ দেশের প্রত্যেকটা দারোয়ান একেকজন স্তালিন—ঢুকতে দেবে কি দেবে না, সেটা তার মর্জি। এই জন্যই দেশটা রসাতলে যাচ্ছে।

লোকটার তবু ঘুম ছোটে না, আধবোজা চোখে বলল, ‘বকবক করিস না, বাড়ি যা।’

পকেট থেকে ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট বের করলাম। কিন্তু লোকটা দেখল না, তার চোখ বন্ধ। গলা খাঁকরে বললাম, ‘সিগারেট চলবে?’

লোকটা বন্ধ চোখেই বলল, ‘কুরিৎ নিলজা, এতা গোসপিতাল।’ ধূমপান নিষেধ, এটা হাসপাতাল।

‘ভালো কথা। তাহলে ভোদকা?’

আমি আমার কাঁধের ব্যাগ থেকে ভোদকার বোতল বের করলাম। লোকটা চোখ খুলে তাকাল। আবছা আঁধারে চকচক করছে তার তৃষ্ণার্ত দুই চোখ। হঠাৎ করোনারি কেয়ার ইউনিটের দরজা খুলে গেল। আমি জুতা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখি: সামনে রমনা লেক, পাড়ের গাছেরা লেকের পানিতে নিজেদের মুখ দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু পানির তিরতিরে ঢেউয়ে গাছেদের ছবিগুলো ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।

‘কী রে ববি, রাতে ঘুমাসনি?’

পেছন ফিরে দেখি দ্বিজেন কাকা: মুখে স্নেহভরা হাসি, রুপালি চুল বাতাসে উড়ছে।

‘কাকা, আপনার চুল বড় হয়েছে।’

তিনি কাছে এসে আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, ‘রাতে ঘুম হয়নি?’

বললাম, ‘বায়ুচড়াটা বেড়েছে।’

তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, ‘চল হাঁটি।’

আমরা রমনা লেকের পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করলাম। একটু পরই কাকা বললেন, ‘তুই বদরুদ্দীন উমরকে জিজ্ঞেস করলি না কেন কোটি কোটি মানুষের প্রাণ যদি হয় বিপ্লবের মাশুল, তাহলে বিপ্লবের দরকার কী?’

‘কাকা, আপনি কিন্তু বুর্জোয়াদের মতো কথা বলছেন’, আমি বললাম, ‘ক্যাপিটালিস্ট প্রোপাগান্ডা মেশিন স্তালিনকে ডিমোনাইজ করতে এ রকম কথা গোড়া থেকেই বলে আসছে। কিন্তু ক্যাপিটালিজমের মাশুল তো সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের মাশুলের চেয়ে কোটি কোটি গুণ বেশি।’

‘ক্যাপিটালিজম আসলে কোনো ইজম না, স্পন্টেনিয়াসলি গড়ে ওঠা একটা সিস্টেম। হিউম্যান নেচারের সাথে ক্যাপিটালিজম খুব খাপ খায়। আল্টিমেটলি, মানুষ তো একটা প্রাণী, হিউম্যান এনিমেল। তার বেসিক ইন্সটিংক্ট হলো নিজেকে তুষ্ট করা। সেটা করতে যদি তার অন্য কাউকে ঠকাতে হয়, অন্যেরটা কেড়ে নিতে হয়, এমনকি অন্যকে মেরেও ফেলতে হয়, তাহলে সে তা-ই করার চেষ্টা করবে।’

‘কাকা, আমরা কিন্তু এখন আর ওয়াইল্ড কন্ডিশনে বাস করছি না। আমরা সভ্যতা গড়েছি, সারভাইবাল অব দ্য ফিটেস্ট জঙ্গলের নিয়ম, মানুষের সমাজে ওটা চলবে না।’

‘শোন, লেনিনের সহযোদ্ধাদের মধ্যে স্তালিন ওয়াজ দ্য ফিটেস্ট পার্টি লিডার। তাই তার হাতে কিরোভ মরেছে, বুখারিন মরেছে, কামিনিয়েভ মরেছে, জিনোভিয়েভ মরেছে, সব মরে শেষ হয়ে গেছে। এমনকি ত্রৎস্কি দেশ ছেড়ে পালিয়ে সুদূর মেক্সিকো গিয়েও রক্ষা পায়নি। অক্টোবর বিপ্লবের পর গ্রামে গ্রামে যে সোভিয়েতগুলো গঠন করা হয়েছিল, সেগুলোর নেতা হয়েছিল কারা, বলতে পারিস? সবচেয়ে দাপুটে লোকেরা; মদ্যপ, মারকুটে, বাটপার টাইপের লোকজন। কুলাকদের মারার জন্য, হোয়াইটদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য ওদেরই বেশি দরকার ছিল। দে ওয়ার দ্য ফিটেস্ট...।’

আকাশ-ছাওয়া গাছের সারির পাশ দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছি। দ্বিজেন শর্মার কথা থামছে না: ‘এই যে দুনিয়াজুড়ে অক্টোবর বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদ্‌যাপনের আয়োজন চলছে, সবাই কিন্তু সেলিব্রেশনের মুডেই আছে। উৎসব উদ্‌যাপনের ব্যাপার তো অবশ্যই। কিন্তু র‍্যাশনালি একটু চিন্তা করাও তো দরকার। ভেবে দেখা দরকার সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সমস্যাগুলো কী ছিল, কেন কিছুই টিকল না। টিকল না যে, না টেকাই কি অনিবার্য ছিল? এ রকম ব্যবস্থা কি আদৌ টেকার নয়? কিন্তু এসব কেউ ভাবছে না। সবাই শুধু নস্টালজিয়ায় ভুগছে।’

‘আপনার নস্টালজিয়া হয় না?’

‘খুব হয়। তুই মস্কো ছিলি ছয় বছর, আর আমি ছিলাম বিশ বছর। ভাবতে পারিস, একজীবনে বিশ বছর মানে কী?’

‘সোভিয়েত ইউনিয়ন যে আর নাই, মানে একদমই নাই, এ জন্য আপনার খারাপ লাগে না?’

‘শোন্‌, রাশিয়ার লোকজন এখন একটা কথা বলে: সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে, এই কথা ভেবে যে দুঃখ পায় না, তার হৃৎপিণ্ড নাই। আর যে ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন আবার জোড়া লাগানো সম্ভব, তার মগজ নাই।’

কেউ জোরে হেসে উঠল, মানে একদম অট্টহাসি।

ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখি, একটু দূরে একটা গাছের নিচে ঘাসের ওপর উবু হয়ে বসে আছেন খালি গায়ে লুঙ্গি পরা এক বুড়ো মানুষ। তাঁর এক হাতে একটা বেতের ডালা, আমাদের দিকে চেয়ে হাসছেন তিনি। আমরা পায়ে পায়ে তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনিও ডালাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর বুকের খাঁচাটা খুব স্পষ্ট, পাঁজরের হাড়গুলো গোনা যাচ্ছে।

তিনি বুঝতে পারলেন, আমাদের চোখেমুখে জিজ্ঞাসা। বললেন, ‘আমি রামভদ্রপুরের ভূমিহীন খেতমজুর নাইকি হেমব্রম। ডাক্তার আবদুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে আন্দামানে কয়েদ খেটেছিলাম। ইগোর কুজমিচ আমার সহযোদ্ধা।’

‘ইগোর কুজমিচ কে রে, ববি?’

‘লিগাচভ।’

তিড়িংবিড়িং লেজ নাচিয়ে উদয় হলো এক কাঠবিড়ালি। আমাদের থেকে হাত তিনেক দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল, লেজ উঁচিয়ে একদম স্থির, অপলক চোখে চেয়ে রইল আমাদের মুখের দিকে। নাইকি হেমব্রম তাঁর হাতের ডালাটা কাঠবিড়ালির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন। কাঠবিড়ালি পরপর কয়েকটা লাফ মেরে তাঁর পায়ের কাছে এসে দাঁড়াল, তিনি কোমর হেলিয়ে সামনে ঝুঁকে পড়ে ওটার মুখের সামনে ডালাটা ধরলেন। কাঠবিড়ালি ছোট্ট একটা লাফ মেরে উঠে পড়ল ডালায়।

নাইকি হেমব্রম হেসে আমাদের মুখের দিকে তাকালেন, বিদায় জানানোর ভঙ্গিতে একটা হাত নাড়ালেন এবং কাঠবিড়ালিসুদ্ধ ডালাটা এক কাঁধে নিয়ে ঘাসের ওপর দিয়ে পুবদিকে হেঁটে চলে গেলেন।

হঠাৎ টুংটাং শব্দে ঘণ্টা বেজে উঠল। আমরা পশ্চিম দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম লেকের ওই পারে, পার্কের দেয়াল পেরিয়ে যে রাস্তাটা মৎস্য ভবনের দিকে গেছে, সেদিক দিয়ে সবুজ রঙের একটা ট্রাম যাচ্ছে।

আমি বললাম, ‘কাকা, লিগাচভ মনে করেন, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন অনিবার্য ছিল না।’

কাকা বললেন, ‘একবার মেট্রোতে লিগাচভের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তখন তিনি পার্টি থেকে বেরিয়ে গেছেন। শুনেছি তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না, চলাফেরা করতেন মেট্রোতে, বাসে, ট্রামে। সৎ লোক, সন্দেহ নাই। কিন্তু তাঁর মতো সৎ নেতা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে নিশ্চয়ই বিরল ছিল। অধিকাংশই ছিল শেভারনাদজে-ইয়েলৎসিনদের মতো অসৎ।’

‘আর গর্বাচভ? গর্বাচভ কি সৎ লোক?’

‘মনে হয় অসৎ না। কিন্তু গ্লাসনস্ত-পিরিস্ত্রোইকা যে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকতে পারে, সেটা বেচারা বুঝতে পারেনি।’

‘আপনি বুঝতে পেরেছিলেন?’

‘না। আমরাও পারিনি। কেউই বুঝতে পারেনি। রোন্যাল্ড রিগ্যান আর তার সিআইএও না। আমরা ভেবেছিলাম, সমাজতন্ত্রের ভুলত্রুটিগুলো শুধরানো হবে, আমলাতন্ত্রের আবর্জনা দূর হবে, স্ট্যাগনেশন কেটে যাবে।’

ভীষণ লম্বা-চওড়া মধ্যবয়সী এক লোক আমাদের পাশ কেটে যাচ্ছিল, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আমি যদি ভুল না শুনে থাকি, আপনারা স্ট্যাগনেশন নিয়ে আলাপ করছিলেন?’ কথাগুলো সে বলল স্পষ্ট বাংলায়, কিন্তু কোনো বাঙালি এভাবে বাংলা বলে না। লোকটা ভীষণ ফরসা, তার চুল আলকাতরার মতো কালো, চোখের মণি বিড়ালের মতো কটা। নিশ্চয়ই বিদেশি। ভাদ্র মাসের গরমেও তার পরনে কালো স্যুট-টাই। ডান হাতে সোনালি হাতলওয়ালা ওয়াকিং স্টিক।

‘হ্যাঁ, আমরা সোভিয়েত সোশ্যালিজমের স্ট্যাগনেশনের কথা বলছিলাম।’

 ‘কী? কী বললেন? সোভিয়েত সোশ্যালিজম? ফুহ্!’

লোকটা এমন তাচ্ছিল্যের সুরে কথাগুলো বলল যে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, ‘কে আপনি? কোত্থেকে এসেছেন?’

‘ভোলান্দ। নামটা নিশ্চয়ই আপনাদের পরিচিত?’

আমি দ্বিজেন শর্মার দিকে চেয়ে বললাম, ‘কাকা, শুনেছেন ভদ্রলোক কী বলে?’

কাকা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘শুনেছি, চল যাই।’

আমরা লোকটাকে এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। সে আমাদের পিছু পিছু আসতে আসতে বলল, ‘কাল বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসবেন। ওখানে দারুণ ম্যাজিক দেখানো হবে।’

আমি কাকার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘কাকা, লোকটা চিওর্নি মাগ, ব্ল্যাক ম্যাজিকের ওস্তাদ! মনে নাই, মস্কোর ভেরিয়েতে থিয়েটারে কী কাণ্ড ঘটিয়েছিল?’

‘ইনসমনিয়ায় তোর মাথাটা একদম গেছে। বাসায় যা, ঘুমা।’

‘মিস্টার শর্মা, ঘুম প্রয়োজন আপনার।’ পেছন থেকে তির্যক সুরে বলে উঠল লোকটা।

কাকা ভ্রুক্ষেপ করলেন না। আমরা লেকের ধার দিয়ে দক্ষিণ দিকে হেঁটে চললাম। কিছু দূর এগোনোর পর পেছন ফিরে তাকালাম আমি। লোকটাকে আর দেখতে পেলাম না। একটু পর লাল টাইলের পায়ে চলা চিকন পথটা বেঁকে গিয়ে পুবমুখী হলো, আমরা পুবদিকে এগিয়ে চললাম। আমাদের ডান পাশে লেকটাও পুবদিকে মোড় নিয়েছে। এখানে লেকের পানি উজ্জ্বল, পাড়ের গাছগুলো দূরে দূরে, তাদের ছায়া লেকের পানিতে পড়েনি।

কিছু দূর এগোনোর পর আবার সেই লোক। লেকের কিনারে একটা শানের বেঞ্চে বসে আছে। একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে লেকের দিকে। বেঞ্চটা আমাদের চলার পথের ধার ঘেঁষেই। আমাদের যেতে হবে তার পিঠের একদম কাছ দিয়ে। মনে হয় সে জন্যই তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজেন কাকার ভ্রু বিরক্তিতে কুঁচকে উঠল। কিন্তু আমরা হাঁটা থামালাম না। চুপচাপ লোকটাকে অতিক্রম করে গেলাম। সে নিশ্চয়ই টের পেল, কিন্তু যেমন স্থির হয়ে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল।

একটু পর আমাদের পথটা ফুরিয়ে গেল। রমনা লেকও এখানে এসে শেষ হয়েছে। কোণে একটা শিউলিগাছ দাঁড়িয়ে আছে, তার গোড়ার কাছে শানবাঁধানো বেঞ্চ দেখে কাকা বললেন, ‘চল ওখানে একটু বসি।’

আমরা লেকের দিকে মুখ করে পাশাপাশি বসলাম। লেকের ওপর খোলা আকাশটা দুধের মতো ফরসা হয়ে উঠল। শিউলিগাছ থেকে টুপ টুপ করে ফুল ঝরে পড়তে লাগল আমাদের গায়ে, মাথায়, পায়ের কাছে। আমি ফুল কুড়াতে শুরু করব বলে হাত বাড়াতেই কাকা বললেন, ‘থাক থাক, ধরিস না। হাতের ছোঁয়া পেলেই ফুলগুলো মিইয়ে যাবে। বসে থাক চুপচাপ। বোঁটা থেকে ফুল খসে পড়ার শব্দ শুনতে পাবি।’

আমি সুবোধ বালকের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। সত্যিই বোঁটা থেকে ফুল খসার শব্দ কানে বাজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের আশপাশের মাটি অজস্র শিউলি ফুলে ঢাকা পড়ে গেল। অপূর্ব মিষ্টি গন্ধে ভরে উঠল চারপাশ।

কাকা চুপচাপ লেকের পানির দিকে চেয়ে আছেন। তাঁর মুখমণ্ডল আকাশের মতো ফরসা হয়ে উঠেছে। হঠাৎ লক্ষ করলাম, শিউলিগাছটা থেকে পেঁজা তুলোর মতো তুষার ঝরতে শুরু করেছে। লেকের ওপরের আকাশ থেকে ভেসে ভেসে নামছে রাশি রাশি তুলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তুষারে ছেয়ে গেল রমনা উদ্যানের সমস্ত গাছপালা। মনে হলো, গাছগুলো তুলো দিয়ে বানানো। আমাদের হাঁটু পর্যন্ত জমে উঠল তুষার। লাল টাইল বিছানো যে পায়ে চলা পথ দিয়ে আমরা হেঁটে এসে এখানে বসেছি, সেই পথ এখন শীতের মস্কোর লেনিনস্কি বার্চবনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া পথ।

খুব ঘন হয়ে তুষার ঝরছে। কাকার রুপালি চুলভরা মাথাটা এখন এক তুলোর বল।

‘কাকা, আপনার ঠান্ডা লেগে যাবে। চলেন বাসায় যাই।’

‘বীরেন চট্টোপাধ্যায় নিউমোনিয়ায় মরেনি, জানিস তো?’

‘বারডেমের আইসিইউ নাকি আরও ভয়ংকর সব জীবাণুর বাসা। সব জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট।’

‘বীরেন চট্টোপাধ্যায় যে উদ্দেশ্যে মস্কো এসেছিলেন, সেই একই উদ্দেশ্যে আমিও এসেছিলাম। তাঁর দুর্ভাগ্য, স্তালিন তাঁকে মেরে ফেলেছে, আমার সৌভাগ্য গর্বাচভ আমাকে মারবে না।’

‘মারবে না মানে? গর্বাচভ তো সমাজতন্ত্রেরই বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। প্রগ্রেস-রাদুগায় আপনারা যাঁরা আছেন, সব্বাইকে পথে বসিয়ে দেবে। টের পাচ্ছেন না?’

‘তাই বলছিস? তাহলে ননীদাকে তো আর বাঁচানোই যাবে না।’

 ‘শুধু আপনার ননীদা? গর্বাচভ যেদিন টিভিতে শেষ ভাষণটা দেবে, যেই মুহূর্তে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সবচেয়ে বড় দেশটা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে কত হাজার মানুষ সুইসাইড করবে, কল্পনা করতে পারেন?’

‘দরকার নাই, দরকার নাই। সুইসাইড করার দরকার নাই। এক সোভিয়েত এক্সপেরিমেন্টই সভ্যতার শেষ কথা না। মানুষের সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার-শোষণ-বঞ্চনা দূর করার চেষ্টা চলতেই থাকবে। তুই কেন ভাবিস, মানবজাতিকে এসব থেকে উদ্ধার করার দায়িত্ব শুধু আমাদের একার?’

বরফের ওপর ভারী বুটের শব্দ কানে এল। আমরা এদিক-ওদিক তাকালাম। ধবধবে সাদা পটভূমির যে পথ দিয়ে আমরা হেঁটে এসে এখানে বসেছি, সেই পথের শেষ মাথায় দুটো কালো মনুষ্যমূর্তি, ঘন তুষারপাতের মধ্যে তাদের দেখা যায় কি যায় না। তবে বোঝা যাচ্ছে, একজন বেশ লম্বা-চওড়া, অন্যজন তার চেয়ে খাটো এবং সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়া। দুজনের হাতেই ওয়াকিং স্টিক। তারা হেঁটে আসছে আমাদের দিকে। খাটোজন সামনে ঝুঁকে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, বোঝা যাচ্ছে লোকটা বয়স্ক।

আমরা একদৃষ্টিতে তাদের দিকে চেয়ে রইলাম।

তারা আমাদের থেকে হাত দশেক দূরে থাকতেই কাকা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘আরে, এটা তো ভ্লাদিমির ইলিচ!’

আমিও দেখলাম: হ্যাঁ, লেনিনই বটে এবং তাঁর পাশের দশাসই লোকটাকেও চিনতে পারলাম। সেই ভোলান্দ: চিওর্নি মাগ, দিয়াভোল, অশুভর অবতার।

আমরা তাঁদের দিকে এগিয়ে গেলাম, লেনিনও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আমাদের দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলেন, তাঁর পাশে অশুভ ভোলান্দ। মুখোমুখি থামার পর কাকা লেনিনকে রুশিতে সম্ভাষণ জানালেন, আমিও তার পুনরাবৃত্তি করলাম। ভ্লাদিমির ইলিচ হেসে আমাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। কাকা ভোলান্দের দিকে একবারও তাকালেন না। ভোলান্দ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আমি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় তার মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম: এখন তাকে অনেকটা স্তালিনের মতো দেখাচ্ছে।

‘ভ্লাদিমির ইলিচ, আমার কিছু জিজ্ঞাসা ছিল।’ কাকা লেনিনকে বললেন।

লেনিন স্মিত হাসলেন: ‘জানি। আপনি ভুলে গেছেন। ১৯২২ সালে আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি বিপ্লব করেছেন পাঁচ বছর হয়ে গেল। সুখী, সুন্দর, ন্যায্য একটা সমাজ গড়ে তুলতে আর কত বছর লাগবে? আমি আপনাকে বলেছিলাম, রাতারাতি ক্ষমতা দখল করা যায়, কিন্তু মানুষকে বদলানো খুব কঠিন। মানুষ রাতারাতি বদলায় না। দুই-চার প্রজন্মেও খুব একটা বদলায় না।’

দ্বিজেন কাকা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবেন, তখনই ভোলান্দ বাম হাত তুলে বাতাসে পট করে তুড়ি মেরে বলল, ‘এনাফ, মিস্টার শর্মা!’ সঙ্গে সঙ্গে দুজনই গায়েব হয়ে গেল। শুধু শর্মা শব্দটা বাতাসে প্রতিধ্বনির মতো বেজে চলল।

‘আইসিইউ ১২ নম্বর বেডের পেশেন্টের অবস্থা ভালো না। আপনারা আসুন।’

‘স্যার, এত রাত্রে কোথায় যাবেন?’

‘হাসপাতালে যেতে হবে, গেট খোলেন।’

ইস্কাটন থেকে হাতির ঝিলের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ঘড়িতে রাত আড়াইটা। স্কয়ার হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে নিশ্চয়ই তিনটা বেজে যাবে। কিন্তু সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে পৌঁছতেই বেলা আড়াইটা বেজে গেল। সেখানে আমাকে থামালেন আমার বাবা।

‘কই যাস? আমার সঙ্গে আয়।’

‘কোথায়, বাবা?’

‘শ্মশানে। তোর কাকাকে পোড়াবি না?’

আকাশ ভেঙে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।

সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরের পাশে চিতা জ্বলে উঠল। বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। জ্বলন্ত চিতার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ওই মানুষটাকে তোর মনে পড়বে। প্রতিদিন মনে পড়বে, দেখিস।’