ইতিহাসের ইতিহাস

কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম

সৈয়দ আবুল মকসুদ

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০১৭, ১৬৬ পৃষ্ঠা

দাম: ৩৫০ টাকা।

গবেষক-প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য, যে বিষয়কে কেন্দ্র করেই তিনি গবেষণা করুন না কেন, তার নাড়ি-নক্ষত্রের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও তথ্য সংগ্রহে তাঁর নিরলস প্রয়াস পাঠককে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে দেয়।

তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাগমারী সম্মেলন: মওলানা ভাসানীর পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রাম শিরোনামের বইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রতি পৃষ্ঠায় তাঁর এই সুনিষ্ঠার ছাপ অঙ্কিত। বলেছেনও সে কথা তিনি এই বইয়ের ভূমিকায়, ‘কাগমারী সম্মেলনের হীরকজয়ন্তীতে প্রকাশিত হলেও ওই সম্মেলনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রাহ করা হয় আশির দশকের প্রথম দিকে। কিছু উপাদান আমার ভাসানীবিষয়ক অন্যান্য বইয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহার করেছি। এটি অপেক্ষাকৃত বিস্তারিত ভাষ্য। বহু বছর আগে দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রহ করা কাগমারীসংক্রান্ত কাগজপত্র আমার সংগ্রহ থেকে নষ্ট হয়ে গেছে, সে জন্য দুঃখ হয়। অবশিষ্ট যা আছে, তার ভিত্তিতেই এ বই।’

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস কাগমারী সম্মেলনের ঘটনাপরম্পরার বিবরণ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যেকোনো জাতি-রাষ্ট্রের ইতিহাস একরৈখিক কোনো ঘটনার সমাহার নয়। তার থাকে বহু বাঁক-ফেরা ঘটনা, থাকে উত্থান-পতনময়তা এবং এক ঘটনা থেকে নতুন আরেকটি ঘটনার উৎসগত ধারা। বাংলাদেশের অস্তিত্বের ইতিহাসে কাগমারী সম্মেলন তেমনি একটি ঘটনা। এখনো সেই ঘটনার আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। প্রাসঙ্গিক এ কারণেই যে কাগমারী সম্মেলন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অনেক কিছু নির্ধারণ করে দিয়েছিল, বিশেষত একটি রাষ্ট্রের আদর্শগত চরিত্র কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে।

কাগমারী সম্মেলনে ভাষণ িদচ্ছেন মওলানা ভাসানী, পাশে বসা সোহরাওয়ার্দী। ছবি: সংগৃহীত
কাগমারী সম্মেলনে ভাষণ িদচ্ছেন মওলানা ভাসানী, পাশে বসা সোহরাওয়ার্দী। ছবি: সংগৃহীত

মোট চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বইয়ে আছে মোট ২০টি উপ-অধ্যায়। আছে ভূমিকা, উপমক্রমণিকা, আলোকচিত্র, তথ্য নির্দেশ, সাক্ষাৎকার দেওয়া ব্যক্তিবর্গের নাম ও গ্রন্থপঞ্জি।

সময় ও তারিখ ছিল ১৯৫৭ সালের ৭, ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উদ্যোগে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সম্মেলন-৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন এবং ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক সম্মেলন। দুটি উপলক্ষে যোগ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর ও সাধারণ নেতা-কর্মীরা, ভারত, তখনকার পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সর্বস্তরের নেতৃস্থানীয় শিল্পী-সাহিত্যিকবৃন্দ। সাধারণ মানুষ মিলিয়ে সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ।

পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই তখনকার পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়। সৈয়দ মকসুদ সেই সময়পর্বের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন, ‘পূর্ব বাংলায় স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনাকারী যে মওলানা ভাসানী, তা তাঁর কোনো প্রতিপক্ষ ও শত্রুও অস্বীকার করেন না। পূর্ব বাংলা যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, সে কথা প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর মুখেই প্রথম উচ্চারিত হয়। আগে দুবার উচ্চারণ করলেও ১৯৫৭ সালের কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনে লক্ষাধিক মানুষের সামনে যেদিন তিনি শর্ত সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রতি ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন, সেদিন তা জনসাধারণ ও শাসকশ্রেণির মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে—পূর্ব বাংলার মানুষের মনে জন্ম দেয় স্বাধীনতা, স্বপ্ন, কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণির মধ্যে ভয়, ক্রোধ ও প্রতিহিংসা।’

এ রকম উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী যে সম্মেলনের চরিত্র, তার বিপরীতে আমরা, সৈয়দ মকসুদের বয়ানেই পাই ভিন্ন আরও ঘটনার ঘনঘটা। সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতার প্রশ্নে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবাধীন বিভিন্ন সামরিক চুক্তির বিরোধিতার প্রশ্নে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর ঘনীভূত বিরোধ বয়ে আনে সুদূরপ্রসারী পরিণতি। মকসুদ এ কথাও গোপন করেননি যে ভাসানীর এমন কিছু অনুসারী ছিলেন, যাঁরা ছিলেন কমিউনিস্ট। অর্থাৎ, তখনকার আওয়ামী লীগের ডান ও বামপন্থীদের মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে অল্পকালের ব্যবধানেই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। গঠন করেন একান্ত বামপন্থী তথা আড়ালে থাকা কমিউনিস্টদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। পরবর্তীকালে ন্যাপ দ্বিধাবিভক্ত হলেও আমাদের স্বাধীনতা বা মুক্তির সংগ্রামকে ছেড়ে যাননি মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ওপর থেকে এতটুকু আস্থা হারাননি তিনি।

এ বইয়ে আছে ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি (১৯৫৭) তারিখে অনুষ্ঠিত কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলনের সবিস্তার বিবরণ। তাতে অংশগ্রহণকারীদের নাম ও তাঁদের তৎপরতার বিবরণ। এবং এ অধ্যায় পড়ার পর মনে হয়, রাজনীতির পাশাপাশি কাগমারীতে সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক যে কর্মকাণ্ড হয়েছিল, এখনো তা দৃষ্টান্তস্থানীয়।

আমাদের জাতীয় ইতিহাসের দলিলে আরেকটি মূল্যবান দলিল সংযোজন করলেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। আমরা তাঁর কাছে এ জন্য গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।