প্রকৃত শিক্ষার পথের খোঁজে

জিয়নকাঠি

প্রাণবন্ত শিক্ষার সন্ধানে

আবুল মোমেন

 প্রচ্ছদ: আবুল মনসুর

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

 প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০১৬ৎ

১২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২০০ টাকা

শিশু-কিশোরদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা, তাদের সুন্দর ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা নিয়ে বাংলাদেশে যাঁরা গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করেন এবং এ ব্যাপারে রীতিমতো সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ, চিন্তাবিদ-প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন তাঁদের একজন। তাঁর জিয়নকাঠি: প্রাণবন্তু শিক্ষার সন্ধানে বইটি আমার এই মন্তব্যকে বিন্দুমাত্র পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে না। এ বইয়ের ভূমিকাস্বরূপ ‘সামান্য কথা’য় তিনি খুবই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘উন্নত মানুষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি মূলত সাংস্কৃতিক বিষয়। এদিকে পাকেচক্রে আমরা শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য বানিয়েছি পরীক্ষায় ভালো ফল। কিন্তু পরীক্ষামুখী শিক্ষার ফলাফল হলো বিচ্ছিন্নতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা। সমাজে ক্রমাগত এ রকম মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকলে নানা চেহারায় সামাজিক সংকট প্রকট হতে থাকে। এর সমাধানের পথ হলো শৈশব থেকেই বাড়িতে ও শিক্ষাক্ষেত্রে শিশুদের সুস্থ মানবিক ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠতে দেওয়া। কারণ কেবল সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশই পারে সমাজকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে প্রাণবন্ত ও বিকাশমান রাখতে। সংস্কৃতি তাই শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত বিষয়। এদের আলাদা করার কোনো উপায় নেই।’

আবুল মোমেনের ওপরোক্ত বক্তব্যের রেশ ধরে আমরা যখন এ বইটি পড়তে শুরু করি, ধাপে ধাপে স্পষ্ট হতে থাকে তাঁর ভাবনার মূল সুরটি। মোট চারটি অধ্যায়ে বিভক্ত এ বই আয়তন বা কলেবরে ছোট হলেও, ছোট নয় লেখকের ভাবনার গভীরতা ও বিস্তৃতি। প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘শিশু’, ‘দ্বিতীয় অধ্যায় ‘স্কুল’, তৃতীয় অধ্যায় ‘সংস্কৃতি’ এবং চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘পরিশিষ্ট’; আদতে ‘পরিশিষ্ট’-এর মাধ্যমেই বইটির উপসংহার টানা হয়েছে।

‘শিশু’ অধ্যায়টি শুরু করা হয়েছে শিশুর একেবারে জন্ম থেকে বেড়ে ওঠার বিবরণের মাধ্যমে। এতে স্থান পেয়েছে ‘শৈশবের আদিপর্ব’, ‘শিশুর দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর’, ‘মানব-শৈশবের বৈশিষ্ট্য’, ‘আবেগ ও আচরণ’, ‘মানবিক গুণাবলির উন্মেষ’, ‘জীবনসংগ্রাম থেকে জীবনসাধনা’, ‘শিশুর জীবনে খেলার গুরুত্ব’ শিরোনামের উপ-অধ্যায় থেকে তার ‘শাস্তির প্রসঙ্গ’ ইত্যাদি। ‘শিশু’ পাঠ করলেই বোঝা যাবে আবুল মোমেন বিষয়ের উৎসমুখ থেকেই অগ্রসর হয়েছেন। এবং তিনি এ অধ্যায়ের উপসংহার টানছেন এই বলে, ‘...শিশুশিক্ষা হচ্ছে অনেকাংশে একটি সাংস্কৃতিক কাজ।’ তাঁর এই উচ্চারণের ওপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি ‘শিশু’ অধ্যায়ে এমন সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য যা অবশ্যপাঠ্য। যে শিশু ভবিষ্যতের কর্ণধার হবে, তাকে মানুষ করতে হলে তার শৈশব থেকে কৈশোরকাল পর্যন্ত অভিভাবকদের কী ধরনের যত্ন নিতে বা উপায় অবলম্বন করতে হবে, এ অধ্যায়ে আছে তার পূর্ণ বিবরণ।

‘স্কুল’ অধ্যায়টিকে বাদ দিয়ে হতে পারত না এ বই। এটি একটি অনিবার্য অধ্যায়। মোট ২০টি উপ-অধ্যায়ে বিভক্ত এই অধ্যায়ে লেখক বলেছেন সন্তানকে স্কুলে দেওয়ার ব্যাপারে অভিভাবকদের প্রস্তুতির কথা, শিশুদের মনস্তত্ত্ব বোঝার গুরুত্বের পাশাপাশি তুলে ধরেছেন চলমান শিক্ষার স্বরূপ এবং এর প্রেক্ষাপটে অভিভাবকদের করণীয় সম্পর্কেও দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। আলোচ্য অধ্যায়ে তুলে ধরা হেয়েছ আরও কিছু বিষয়, যার পাঠ অভিভাবকদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ অধ্যায়ে বলা হয়েছে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের গুরুত্ব প্রসঙ্গেও। গঠনমূলক সমালোচনা রয়েছে চলমান শিক্ষাব্যবস্থার। সুস্থ ও সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থার রূপ কেমন হওয়া উচিত, লেখক এখানে বলেছেন সে কথাও।

 ‘সংস্কৃতি’ অধ্যায়ে বলেছেন, ‘আমাদের বিদ্যা ও বিদ্যালয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিশুরাই হলো প্রাণের কারিগর। অভিভাবক ও শিক্ষকেরা যুগপৎ ওদের সখা ও সহচর এবং সতীর্থ অগ্রদূত, পদপ্রদর্শক।’ আবুল মোমেন আরও বলছেন, ‘সেই সঙ্গে বিদ্যালয়ের রাগের পারদ নামাতে হবে। বিদ্যাচর্চা থেকে ভয় তাড়াতে হবে। আনন্দ, কৌতূহল আর উপভোগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।’

শিশুশিক্ষা সহজ নয়। ভবিষ্যতে মানুষ গড়ার কারিগর যাঁরা হবেন, তাঁদেরও শিখতে হয় প্রতিমুহূর্তে। আবুল মোমেনের এ বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন সে শিক্ষাই দেয় আমাদের।