জীবন, সময় ও রাজনীতি

ডেভিড হেয়ার। ছবি: সাইফুল ইসলাম
ডেভিড হেয়ার। ছবি: সাইফুল ইসলাম

অনলাইনে খোঁজ করলে এখন যে কারও সম্পর্কেই নানা তথ্য মেলে। ব্রিটিশ নাট্যকার, চলচ্চিত্র-চিত্রনাট্যকার, পরিচালক ও লেখক স্যার ডেভিড হেয়ার ঢাকা লিট ফেস্টে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে হবে এবং লিখতে হবে। অনলাইনে তাঁকে নিয়ে তথ্যের অভাব নেই। কিন্তু তাঁর ‘কাজের’ ব্যাপারে আমার ধারণা হচ্ছে, তাঁর লেখা চিত্রনাট্যের দুটি ছবি—ব্রিটিশ পরিচালক স্টিফেন ড্যালড্রি পরিচালিত রিডার আর ফরাসি পরিচালক লুই মালের ড্যামেজ। লিট ফেস্টে তিনি দুটি ‘টক’-এ কথা বলেছেন। সে দুটিও শোনার সুযোগ হয়নি। এই ছবি দুটি দেখার পুঁজি সম্বল করেই তাঁর সঙ্গে কথা বলা শুরু।
‘আমার নাট্যকার হওয়াটা খুবই আকস্মিক। আমি একটি ট্রাভেলিং থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম নির্দেশক হিসেবে। একদিন হয়েছে কি, নাটকের প্রদর্শনীর যখন মাত্র দিন পাঁচেক বাকি, তখন জানলাম যাঁর স্ক্রিপ্ট দেওয়ার কথা, তিনি সেটি দিচ্ছেন না। শেষ পর্যন্ত থিয়েটারের ভ্যানে টাইপরাইটার নিয়ে নিজেই লিখতে বসে গেলাম। ছোট একটি নাটক লিখলাম। মহড়া, মঞ্চস্থ—সবই হলো। শুরুটা এভাবে। আসলে আমি নিজেকে লেখক হিসেবে তখনো ভাবতে পারিনি। দীর্ঘ সময় আমি নিজেকে পরিচালক হিসেবেই দেখতাম।’
কেমন হয়েছিল সেই নাটক?
‘নাটকটি খুবই খারাপ হয়েছিল। কিন্তু এরপর তখনকার বিখ্যাত অনেক নাটকের কোম্পানি আমার কাছে নাটক চাইতে শুরু করে। আমিও সাহস করে লিখতে শুরু করি। বয়স মাত্র ২৩, আমার লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক স্ল্যাগ মঞ্চস্থ হয়। বলা যায়, সৌভাগ্যবশত এবং ঘটনাচক্রে আমি নাট্যকার বা লেখক হয়েছি।’
এই যে ঘটনাচক্রে আপনি নাট্যকার বা লেখক হলেন, এটা আপনার জীবনকে কী শিক্ষা দিয়েছে?
‘আমার মনে হয়, জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয় হচ্ছে কার মধ্যে কী যোগ্যতা বা ক্ষমতা আছে তা না জেনে পরে সেটি আবিষ্কার করা। আমি যে লিখতে পারব, তা আমি জানতামই না লেখা শুরু করার আগে। আমি লেখা শুরু করেছিলাম, কারণ আমাকে লিখতে হয়েছিল। তরুণদের উদ্দেশে তাই আমি সব সময়ই বলার চেষ্টা করি, কেউ লিখতে পারে কি না, সেটি তার একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত। এতে তো হারানোর কিছু নেই। ধরুন একজন চেষ্টা করল এবং বুঝতে পারল যে তার হবে না, এতে ক্ষতি কী!’
নাটক দিয়ে শুরু করলেও পরে আপনি সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, নিজেও সিনেমা বানিয়েছেন। শুরুটা সিনেমা দিয়ে হলো না কেন?
‘আমি থিয়েটারে গিয়েছি, কারণ সিনেমায় যাওয়া তখন বেশ কঠিন ছিল। ষাটের দশকের ইউরোপের কথা চিন্তা করুন, তখন সিনেমার খুবই রমরমা অবস্থা, কিন্তু ব্রিটিশ সিনেমার অবস্থা সে সময় খুব ভালো নয়।’
এই সময়ের ব্রিটিশ নাট্যকারদের মধ্যে অন্যতম সেরা নাট্যকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন ডেভিড হেয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালে দক্ষতার সঙ্গে ব্রিটিশ সমাজের চিত্র ব্যঙ্গভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য পেয়েছেন খ্যাতি। রাজনীতিসচেতন লেখক তিনি। তাঁর লেখা নাটকগুলোতে বরাবরই সমসাময়িক প্রসঙ্গ ও রাজনীতি স্থান পেয়েছে। তৃতীয় বিশ্বে উন্নত বিশ্বের সাহায্য-সহায়তা, চীনের বিপ্লব, রেলওয়ের বেসরকারীকরণ এমনকি ইরাকযুদ্ধের সূচনা পর্বের কূটনীতিও তাঁর নাটকের বিষয়বস্তু। ১৯৭০ সালে স্ল্যাগ দিয়ে যাত্রা শুরুর পর তিনি সামনেই এগিয়েছেন। ১৯৭২-এ দ্য গ্রেট এক্সিবিশন এবং ১৯৭৪-এ নুকলে লেখার পর প্রতিভাবান নাট্যকার হিসেবে পরিচিতি পান। ব্রিটিশদের দ্বিধাগ্রস্ত গণজীবনের একজন বলিষ্ঠ সমালোচক তিনি।
আপনি নিজে মৌলিক নাটক লিখেছেন, আবার অনেক বিখ্যাত নাট্যকারের নাটকের রূপান্তর করেছেন। আপনি কি মনে করেন, এ ধরনের রূপান্তর লেখালেখির চর্চার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?
‘শুরুতে তরুণ লেখক হিসেবে আমি চাইতাম নিজের কথা বলতে। এমন কিছু করতে অনেক সময় লেগেছে আমার। লেখালেখি শুরুর বছর দশেক পর মনে হলো, এখন আমি আমার কথা বলতে পারছি, এমন কিছু লিখতে পারছি, যা আমার নিজের। আমার মনে হয় রূপান্তর একটা চর্চা হতে পারে। এটা করতে করতে নিজের যা বলার তা খুঁজে বের করার পথ আমি পেয়েছিলাম।’
রিডার, ড্যামেজ, বা দ্য আওয়ার্স-এর মতো আলোচিত ছবির চিত্রনাট্য লিখেছেন হেয়ার এবং এগুলো উপন্যাস থেকে করা। রিডার ও দ্য আওয়ার্স-এর জন্য ‘বেস্ট অ্যাডেপটেড স্ক্রিপ্ট’ ক্যাটাগরিতে অস্কারের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। নিজেও ছবি পরিচালনা করেছেন। সেগুলো নিজের এবং মৌলিক চিত্রনাট্যে করা।
‘আমি নিজে বেশ কিছু ছবি বানিয়েছি। আশির দশকে বানানো তিনটি ছবির কথা উল্লেখ করতে পারি। ওয়েলথব্যারি ছবিটি বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন বিয়ার পেয়েছে। বাকি দুটি হচ্ছে প্যারিস বাই নাইট ও স্ট্র্যাপলেস। এর পরপরই আমার বর্তমান স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় হয় এবং ছবি বানানো থেকে আমি সরে আসি। আমি ঘরে সময় দিতে চেয়েছি, আর সে-ও চায়নি যে আমি ছবি বানাই।
নাটক আর চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের মধ্যে পার্থক্য কীভাবে করেন?

ডেভিড হেয়ারের চিত্রনাট্যে রিডার ছবিতে কেট উইন্সলেট
ডেভিড হেয়ারের চিত্রনাট্যে রিডার ছবিতে কেট উইন্সলেট

‘মঞ্চের জন্য যখন নাটক লিখি, তখন তা একান্তই আমার। কিন্তু যখন সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য লিখি, তখন আসলে অন্যের জন্য লিখি। বলা ভালো, লেখার জন্য আমাকে ভাড়া করা হয়। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর আমি যা লিখেছি তারা তা পছন্দ করতে পারে, না-ও পারে। তারা বদলাতে পারে। এমনকি আমাকে বাদও দিতে পারে। সে কারণে থিয়েটার একজন লেখকের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। থিয়েটারে একজন লেখকের নিজের লেখার ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ থাকে। আর সিনেমায় বা টেলিভিশনে লেখার চেয়ে আপনি যা লিখবেন, তার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করাতে আপনাকে বেশি সময় দিতে হবে।’
উপন্যাস থেকে সিনেমার জন্য যেসব চিত্রনাট্য করেছেন, সেখানে কি হুবহু উপন্যাস অনুসরণ করে শুধু দৃশ্য অনুযায়ী সংলাপ লেখার কাজটি করেছেন? নাকি নিজের মতো করে কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন?
‘উপন্যাস থেকে আমি যখন সিনেমার জন্য চিত্রনাট্য তৈরি করি, তখন আমার কাছে এর কাঠামোটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ সাধারণ ছবির ক্ষেত্রে আপনি দেখবেন যে দর্শক একটি ছবির প্রথম ভাগ বেশ উপভোগ করলেও বাকি অংশ তেমন উপভোগ করে না। একজন চিত্রনাট্যকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে শুরুর মতো শেষটাকেও উপভোগ্য রাখা। একটি চলচ্চিত্রের উত্তেজনাকর শুরুর বিষয়টি খুবই সহজ কিন্তু উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শেষ করার কাজটি খুব কঠিন। ছবির চিত্রনাট্য লেখার ক্ষেত্রে আমি সবচেয়ে বেশি সময় দিই ছবির কাঠামোটি কী হবে সেই ভাবনায়। সংলাপ লেখার কাজ আমার কাছে খুব সহজ একটি বিষয়।’
নিজের দেশ ব্রিটেনে হেয়ারের প্রিয় পরিচালক আলফ্রেড হিচকক। তাঁর কাছে হিচকক একজন চৌকস নির্মাতা, যাঁর ছবিতে বৈচিত্র্য আছে। হিচককের মাস্টারপিস ছবিগুলো যুক্তরাষ্ট্রে বানানো হলেও তাঁকেই তিনি সবচেয়ে মহান ব্রিটিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে বিবেচনা করেন। ফরাসি পরিচালক লুই মালের ড্যামেজ ছবির চিত্রনাট্য হেয়ারের লেখা—এ তো জানা হয়েছে আগেই। ফরাসি পরিচালকদের মধ্যে তিনিই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। ‘লুই মালের ছবিতে কাজ করতে পারাটা আমার কাছে স্বপ্নপূরণের মতো।’ তাঁর পছন্দের ফরাসি পরিচালকদের মধ্যে আরও রয়েছেন অঁরি জর্জ ক্লুজো। তাঁর ওয়েজেস অব ফিয়ার হেয়ারের প্রিয় ছবির একটি।
আপনি একজন রাজনীতিসচেতন ও রাজনীতিমনস্ক লেখক। ব্রিটেনের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ব্রেক্সিটকে কীভাবে দেখেন?
‘এটা পুরোপুরি অভিবাসন-সংক্রান্ত একটি বিষয়। কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তিত ব্রিটিশরা এ কাজ করেছে। লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসা অভিবাসীদের সস্তা শ্রমের কারণে ব্রিটিশদের কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে এমন ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে যে অভিবাসীদের ঠেকাতে হবে এবং বিদেশিদের জন্য সীমান্ত বন্ধ করতে হবে। আমরা দেখছি, এখন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প এ কাজই করতে চাইছেন। ব্রিটিশরা মনে করছে, ভূমধ্যসাগর পার হয়ে আসা সিরীয় বা লিবীয়রা তাদের সম্পদে ভাগ বসাবে। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করেছে মূলত সীমান্ত বন্ধ করতে।’
এটা ব্রিটেনের জন্য কতটুকু ভালো হলো?
‘এটা বিপর্যয়কর একটি ব্যাপার। ধনীরা তাদের সম্পদে গরিবদের কতটুকু ভাগ বসাতে দেবে, সেটাই এই শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বৈশ্বিক পুঁজিবাদ বর্তমানে ব্যাপক অসাম্যের সৃষ্টি করেছে। বিশ্বে যে ১০০ কোটি মানুষ ভালো অবস্থায় আছে, তারা খারাপ থাকা বাকি ৬০০ কোটি মানুষ থেকে দূরে থাকার জন্য দেয়াল তুলছে। কারণ, তারা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তাদের সম্পদের ভাগ দিতে চায় না। এটা সংঘাত সৃষ্টি করবে।’
বাংলাদেশ ও ঢাকায় তো এবারই প্রথম, কী অভিজ্ঞতা হলো?
‘আমি ঢাকায় আসতে চেয়েছি। এ ধরনের আরও কিছু উৎসবে আমার দাওয়াত ছিল। কিন্তু আমি এখানে আসার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। কারণ, অন্য কোনো কারণে হয়তো আমার এখানে আসার সুযোগ হতো না। আমি অল্প সময়ের জন্য এসেছি; ঢাকার বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি, কিন্তু শহরটি আমি উপভোগ করেছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে পশ্চিমের অনেকেরই ধারণা এমন যে এটা একটি গ্রামীণ সমাজ। কিন্তু টের পেলাম, ঢাকা কোটি নাগরিকের এক প্রাণবন্ত শহর।’