মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর দলিল

একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা। ছবি: অমিয় তরফদার
একাত্তরের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা। ছবি: অমিয় তরফদার

মোট ছয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ-শিক্ষাবিদ রেহমান সোবহানের বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য বইটি মুক্তিযুদ্ধের দলিলস্বরূপ। এই বই না পড়লে মুক্তিযুদ্ধের একটি অধ্যায় আমাদের কাছে অজানাই থেকে যাবে। বইটি প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন প্রকাশক মতিউর রহমান, ‘এ বইয়ের লেখক অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং তার আগে-পরের ঘটনাপ্রবাহের একজন সাক্ষী হিসেবে সে সময়টিকে খুব কাছ থেকে অনুসরণ করেছেন। ইতিহাসের সেই পর্ব নির্মাণের সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। সেই অবস্থান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমি এবং যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই লেখাগুলোতে তুলে ধরেছেন।’ মতিউর রহমানের দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা এ বইয়ের আলোচনা করতে বসলে দেখব, রেহমান সোবহানের প্রথমা প্রকাশন প্রকাশিত বর্ধিত সংস্করণের এ বই সত্যিই বিরল গোত্রভুক্ত।

এ বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি’। লেখক তাঁর ভূমিকায় বলেছেন, লেখাটিকে তিনি শুধু পরিমার্জিতই করেননি, সংযোগ-বিয়োজনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ দিয়েছেন। একে নানাভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। বস্তুত যে বাঙালি জাতির স্বায়ত্তশাসন বা তার পরের ধাপ স্বাধীনতার বীজ, ভিত্তি বা শিকড় প্রোথিত ছিল রাজনৈতিক অর্থনীতির গভীরে, লেখক রেহমান সোহবান তার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছেন এই দীর্ঘ প্রবন্ধ মারফত। এমনকি দুই পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ছবি তুলে ধরতে গিয়ে যেসব সারণি ব্যবহার করেছেন তিনি, পরিসংখ্যান মারফত যেসব তথ্য তুলে ধরেছেন, তার পাঠ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে দুই পাকিস্তানের এক নাড়ির বন্ধনে আবদ্ধ থাকার কোনো সুযোগই ছিল না। এই নিবন্ধের উপ-অধ্যায়গুলোর শিরোনাম থেকেই তার কিছুটা আঁচ করা যাবে। যেমন ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা নিরূপণ’, ‘অর্থনৈতিক বঞ্চনা’, ‘কতিপয় ধারণাগত প্রশ্ন’, ‘আঞ্চলিক হিসাবে পৃথক্‌করণ’, ‘অর্থনৈতিক বৈষম্যের হিসাবনিকাশ’, ‘কাঠামোগত পরিবর্তনে ভিন্নতা’, ‘জীবন মানের বৈষম্য’, ‘অঞ্চলগুলোর উত্তরাধিকার’, ‘উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ব্যবসায়ী শ্রেণি’, ‘বাজার শক্তিগুলোর ভূমিকা’ ইত্যাদি। দীর্ঘ প্রথম অধ্যায়ে দুই পাকিস্তানের মধ্যকার চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের চালচিত্র তুলে ধরার পর রেহমান সোবহান ইতিমধ্যে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ টেনে এই মর্মে উপহার টানছেন যে ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার পর পাকিস্তান রাষ্ট্র বুঝতে পারে যে এই নেতৃত্বকে কিনে ফেলা যাবে না।’ সত্যিই সেটা তারা কোনোভাবেই পারেনি।

‘অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বশাসনে’ এবং ‘শত্রু অবস্থান থেকে আলোচনা’ শীর্ষক দুটি অধ্যায়ে লেখক সোবহান তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ও শাসনে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম নিতে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কীভাবে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক দর-কষাকষি করেছেন, তুলে ধরেছেন তার প্রায় বিস্তারিত বিবরণও।

চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বাংলাদেশের জন্য সমঝোতা বৈঠক’। অন্যান্য নিবন্ধের চেয়ে এই নিবন্ধে বর্ণিত ঘটনাদির সঙ্গে লেখক সবচেয়ে নিবিড়ভাবে জড়িত। শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার আলাপ-আলোচনা, ইয়াহিয়ার দ্বিমুখী চরিত্র এবং ফলস্বরূপ বাংলাদেশে নির্বিচারে বাঙালিদের নিধনযজ্ঞের ঘটনা লেখক তুলে ধরেছেন এই অধ্যায়ে। লেখক তাঁর দেখা ঘটনাদির বর্ণনা এমন জীবন্তভাবে তুলে ধরেছেন যে তার দালিলিক মর্যাদা অস্বীকার করার উপায় নেই। লেখক জানাচ্ছেন, ‘কারণ, আমি ছিলাম এই ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী এবং অংশগ্রহণকারী।’

পঞ্চম অধ্যায়ের শিরোনাম ‘মুক্তিযুদ্ধ দেশে-বিদেশে’। এই অধ্যায়ে লেখক তুলে ধরেছেন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের বিবরণ। আর এই অধ্যায়েই আছে দেশের মাটি থেকে শুরু করে বিদেশের মাটিতে লেখক রেহমান সোবহান স্বাধীনতাকামী অদম্য মানুষজনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কীভাবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, তার বিস্তারিত বিত্তান্ত। এই নিবন্ধের পাঠ সত্যিই এক বিরল অভিজ্ঞতা।

ষষ্ঠ অধ্যায় ‘বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়’। এটি লেখকের একটি বক্তৃতা। ফলে প্রাসঙ্গিক বিচারে এখানে এটি অধ্যায় হিসেবে সংযোজিত হয়েছে। লেখক তাঁর এই অধ্যায়ের মূল বক্তব্যের সারসংক্ষেপ করছেন এভাবে, ‘...সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রকে কল্পনা থেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার বঙ্গবন্ধুর যে ক্ষমতা ও ভূমিকা, তা-ই তুলে ধরা হয়েছে এখানে। এই কাজ শুধু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য রাজনৈতিক সংগ্রামে আমার যুক্ততার প্রতিফলন নয়; বরং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কার অভিজ্ঞতারও প্রতিফলন।’
আমরা যাঁরা সাধারণ পাঠক, শুধু তাঁদের জন্যই নয়, গবেষকদের জন্যও এ বই অবশ্যই জরুরি পাঠ্য।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য

রেহমান সোবহান

প্রচ্ছদ: অশোক কর্মকার, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০১৭

১৯২ পৃষ্ঠা, দাম: ৩৮০ টাকা।