উড়োচিঠি

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

সে একসময় গেছে পৃথিবীতে, যখন চিঠি বলে এক রহস্যময় বস্তু মানুষের জীবনে নিত্যসহচর ছিল। আবার এমনও একসময় গেছে যখন দুর্গম গ্রামাঞ্চলে চিঠি যেত কালেভদ্রে। যে কারণে কোনো নিঝুমপল্লিতে কেবল একটি চিঠির কারণে শোরগোল পড়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। কত দুস্তর পথ ভেঙে আশ্চর্য প্রহেলিকার মতো সেই চিঠি গিয়ে পৌঁছাত! আর যত ভারহীন-ওজনহীনই হোক, যে মানুষটি সেটি বয়ে আনতেন, সেই বিখ্যাত ডাকহরকরাও কি ছিলেন কম প্রহেলিকাময়!

 সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘উড়োচিঠি’ গল্পটি আবার পড়তে গিয়ে কথাগুলো মনে এল। কবে কোথায় প্রথম পড়েছিলাম মনে নেই, তবে আবার পড়তে গিয়ে গা শিরশির করে উঠল সেই প্রথমবারের মতো।

‘সেই যেবার কালুডিহিতে পেত্থম ডাকের পিওন এল...’ গল্পের মূল জায়গাটা এখান থেকে শুরু। গাঁয়ে ডাকপিওন আসা যে বড় ঘটনা, এ বাক্যটিতে তা প্রচ্ছন্ন নেই। গাঁয়ের মানুষ ডাকপিওনের কথা শুনেছে, চোখে দেখেনি। সেবারই প্রথম তারা সেই রহস্যপুরুষের দেখা পেল। গাঁয়ে সাড়া পড়ে গেল। গল্পে বর্ণনাটা এ রকম—‘আসমা এই বিস্ময়কর আকাশ ও পৃথিবীর অনেক অজানা জিনিসের সঙ্গে ডাকের পিওন এবং চিঠির কথাও শুনেছে। সে নাকি চিঠি নিয়ে আসে অচিন মুল্লুক থেকে। আর চিঠিতে থাকে খবর। খবর কথাটা কিন্তু সোজা নয়। খবর মানেই সাংঘাতিক কিছু—যা তুমি জানো না, ভাবোনি, টেরও পাওনি। যা তোমার ওপর হঠাৎ এসে হামলা করে। ঝড়ের মতো। গাছের ওপর বাজ পড়ার মতো। বন্যার মতো। কালুডিহির সেই আদিম পৃথিবীতে চৈত্রের অবেলায় আসমা তারপর শিউরে উঠেছিল। আর তার দিকে আড়চোখে চাইতে চাইতে ডাকপিওন গাঁয়ে ঢুকেছিল। কালুডিহিতে সাড়া পড়ে গিয়েছিল।’

 গাঁয়ে তো ঢোকা হলো। তারপর? গাঁয়ের মাঝখানে বিশাল বটের ছায়ায় তেপায়া টুল পেতে তার বসার ব্যবস্থা হয়েছে। ভিড় জমানো মেয়ে-পুরুষের বিশ্বাস হতে চায় না চোখের সামনে যাকে দেখছে সে সত্যিই সেই রহস্যমানব, যার কথা এত দিন কেবল শুনেই এসেছে। এতকাল তারা কল্পনাই করেছে, কে এই ডাকপিওন, কেমন তার চেহারা, কী খায়, কী পরে, থাকেই-বা কোথায়? সে কি মানুষ না অন-মানুষ? আর কে-ইবা দেয় তাকে চিঠি? পায় কোথায়?

 লোকটাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে তাদের অবিশ্বাস বাড়ে ছাড়া কমে না। কিছুতেই মেলে না কল্পনার সঙ্গে। এ তো তাদেরই মতো দেখতে। রোদেপোড়া চোখেমুখে ক্লান্তি, ধুলোমলিন পা, মাথায় উষ্কখুষ্ক পাকা চুল, নাকটা লম্বা ও মোটাসোটা, কান দুটো বড়সড়। তবে ঠোঁটের ওপর প্রকাণ্ড গোঁফে বেহুলা পালার চাঁদ সওদাগরের সঙ্গে মিলটুকুই যা খানিকটা বৈশিষ্ট্যময়। তাকে খাতির করে যখন গুড়-পানি দেওয়া হলো, খাওয়ার ধরন দেখে তাদের আরও হতাশা জাগল। সত্যিই এ সেই! কিন্তু সে যে অচিন মুল্লুকের মানুষ বা অন-মানুষ, সে পরিচয় আড়াল থাকল না যখন সে কাঁধে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগটা কোলে নিয়ে ভেতর থেকে, যেন জাদুবলে, হলদে টানটান চৌকো কাগজ বের করে বলল, চিঠি। ঘিরে ধরা জটলার জোড়া-জোড়া চোখে তখন পলক পড়ে না। এই তবে চিঠি! পরপরই সে যেই চিঠির ঠিকানা মেলাতে খাকি শার্টের পকেট থেকে চশমা বের করে নাকে চড়িয়ে কানে ‘দড়ি’ জড়াতে লাগল, ‘বিস্ময়-উৎকণ্ঠা-আশা-নিরাশায় স্তব্ধ লোকগুলো এবার চশমা দেখতে লাগল।’

 চিঠিটা কালুডিহিতে এসেছে খড্ডা নামের কোথাকার কোন গ্রাম বা শহর থেকে। লিখেছে মামোদ আলী নামের কেউ তার বড় ভাই আমোদ আলীকে। এলাহি ভরসা দিয়ে শুরু হয়ে চিঠিতে করুণ আর্তি তাকে যেন শিগগির নিয়ে যাওয়া হয় কালুডিহির পৈতৃক ভিটায়, সে গুরুতর অসুস্থ, বাঁচার আশা নেই। চিঠিতে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেল তাতে যেন ধাঁধা। পত্রলেখক কে এই মামোদ আলী আর আমোদ আলী, যাকে লেখা সে-ইবা কে? ঠিকানায় যখন ভুল নেই, দুই ভাই নিশ্চয় এ গাঁয়েরই সন্তান, হয়তো বহু বছর দুজন গ্রামছাড়া, এ ওর খবর রাখেনি। খোঁজ খোঁজ। এ ওকে জিজ্ঞেস করেছে, তর্ক করছে। মীমাংসায় পৌঁছাতে পারছে না। যত ধাঁধা, যত ধূম্রজালই ছড়াক চিঠি, একটা বিষয় লোকজনের কাছে পরিষ্কার—তাদেরই গাঁয়ের সন্তান, তাদেরই এক আপনজন মহাবিপদে পড়ে খবর পাঠিয়েছে। যাকে পাঠিয়েছে তার পাত্তা মিলুক না মিলুক কী এসে-যায়, তারা আছে না? মোষের গাড়ি আছে না? আর তেজি মোষ? কিসের অভাব?

 তত্ত্বতালাশে একসময় বেরিয়ে পড়ল এক পেড়ো ভিটার খবর, রোজ দুপুরে যেখানে জোড়া ঘুঘু-ঘুঘুনী কাঁদতে আসে, আর এ-ও যে ওখানেই বসত ছিল বহু বছর আগে এক বোবা-কালা হতদরিদ্র মহিলার, যে জন্ম দিয়েছিল যমজ দুই ছেলের—এরা সেই দুজন। গ্রাম ছেড়ে দুজন কোন মুল্লুকে ঠাঁই গেড়েছে কেউ খোঁজ রাখেনি। একজনের খবর তবে মিলল চিঠিতে, খড্ডা না কোথায় বাস, অসুখে শয্যাগত, সে এবার ফিরতে চায়। চিঠিতে মরার আগে গ্রামে নিজ ভিটাতে ফেরার আকুতি। ব্যস, সাজসাজ পড়ে গেল কালুডিহিতে। গাড়ি সাজাও, তেজি মোষ, সঙ্গে কোদালও, পথে ক্ষেতের আল কেটে রাস্তা বানিয়ে তবে ছোটানো হবে গাড়ি। এসবের মধ্যে আসমা নামের যে যুবতী প্রথম আবিষ্কার করেছিল ডাকপিওনকে, সবার সামনে ঘোষণা দেয়, মামোদ আলী গ্রামে ফেরার পর প্রথম পথ্যির দিন সে তার পোষা মুরগি টুকটুকিকে আন্না (রান্না) করে খাওয়াবে। শরীরে রক্ত বাড়বে।

 একটা চিঠি, উড়োই বলা চলে, এত জোর! সভ্যতার আগ্রাসী যাত্রায় চিঠি খুন হয়ে গেছে। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অসামান্য কারুকর্মে চিঠি নামের এক টুকরো কাগজ সেই কোন কাল থেকে সভ্যতার আলো-হাওয়াহীন গণ্ডগ্রামে মানুষের উৎকণ্ঠা, আনন্দ, উত্তেজনা ও অপার কৌতূহলের স্বারকই হয়ে ওঠেনি, এক বিস্ময়কর যূথবদ্ধতার স্থাপত্যও হয়ে আছে।

 চিঠি নিয়ে যুগ যুগ ধরে কত গান, কবিতা পৃথিবীর কত ভাষায়ই না রচিত হয়েছে! অমর সব গান, কবিতা। আমরাও সংগীতে, কাব্যে চিঠিকে অমর করেছি নানাভাবে। কথাসাহিত্যের প্রসঙ্গে এলে হাতের কাছে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রীর পত্রর গোটা গল্পটাই তো চিঠি। বিশ্বসাহিত্যে ‘এপিস্টোলারি’ উপন্যাস নামে একটা বিশেষ ঘরানার আধিপত্য ছিল এক কালে, যাতে চিঠির ভূমিকাই ছিল মুখ্য। চিঠি, রোজনামচার মাধ্যমেই মূলত আখ্যানকে পল্লবিত করা হতো। অষ্টাদশ শতকে ইংরেজ উপন্যাসিক স্যামুয়েল রিচার্ডসনকে বলা হয়ে থাকে এ ধারার জনক। তাঁর জনপ্রিয় উপন্যাস পামেলা এ ধারায় রচিত। খ্যাত-অল্পখ্যাত অনেককেই পাওয়া যাবে যাঁরা এ জাতীয় উপন্যাস লিখেছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে নাম করা যায় দস্তয়ভস্কি ও সোলবেলোর। পুওর ফোক নামে দস্তয়ভস্কির স্বল্পপরিচিত উপন্যাসটি গড়ে উঠেছে দুটি দরিদ্র চরিত্রের চিঠি আদান-প্রদানের ওপর। সোলবেলোর উপন্যাস হারজগও চিঠিভিত্তিক।

 এ তো গেল চিঠি নিয়ে গান, কবিতা ও আখ্যানচর্চা। তবে চিঠির বিষয় ছাড়াও চিঠি জিনিসটাই যে বিপুল রহস্য নিয়ে লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে, মানুষের মনের সংগোপন কুঠুরিকে চকমকি ঠুকে আন্দোলিত করতে পারে তা মুস্তাফা সিরাজের মতো আর কে পেরেছেন জানা নেই। আজ চিঠিই যখন পৃথিবী থেকে উঠে গেছে, ‘উড়োচিঠি’ গল্পটাকে কল্পজগতের রূপকথা ভাবলে বলার কিছু নেই। আজ চিঠি ব্যাপারটাই যেন গুজব—উড়ো তো বটেই।