'নজরুল সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করা কঠিন'

>

কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনকে নতুনভাবে দেখেছেন গবেষক গোলাম মুরশিদ। বিদ্রোহী রণক্লান্ত নামে লিখে শেষ করেছেন নজরুলের নতুন একটি জীবনীগ্রন্থ। বইটি অচিরেই বের হবে প্রথমা প্রকাশন থেকে। এই আলাপচারিতায় সেই নজরুল-জীবনীর প্রসঙ্গ ছাড়াও আছে তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহিত হাসান

মুহিত হাসান: যত দূর নজরে এসেছে, নজরুল বিষয়ে আপনার প্রথম প্রবন্ধ বের হয় ১৯৬৮ সালে পূর্বমেঘ পত্রিকায়, ‘পরাজিত দুই বিদ্রোহী সৈনিক: মাইকেল ও নজরুল’ নামে। এরপরের বছর লিখলেন আরেকটি প্রবন্ধ—‘নজরুল সাহিত্যে রবীন্দ্র-প্রভাব’। তখনকার প্রচলিত নজরুল-চর্চার ধারা থেকে দুটি লেখাই অনেকটা আলাদা ধরনের। এখন নজরুল-জীবনী লিখছেন। একটি ভিন্ন রকমের, বৃহদাকারের নজরুল-জীবনী লিখবেন, কবে থেকে আপনার এমন পরিকল্পনা?

গোলাম মুরশিদ: ১৯৯৯ সালে নজরুলের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে যখন আমি বিবিসি বাংলার জন্য বারো পর্বের একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করি, তখন তাঁর সম্পর্কে আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মে। সেই অনুষ্ঠানমালার নাম ছিল ‘অঞ্জলি লহ মোর’। সেখানে নজরুলকে নানাভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম। ওই সময় থেকেই আমি ‘সিরিয়াসলি’ নজরুল-চর্চা শুরু করি। একটা দৃষ্টান্ত দিই, নজরুলসংগীত সম্পর্কে আমার খুব স্পষ্ট ধারণা ছিল না। নজরুলসংগীত শোনার জন্য যে কান বা রুচি দরকার, তা-ও আমার ঠিক তৈরি হয়নি। আমি তখন প্রায় আড়াই শ ঘণ্টা শুধু নজরুলের গান শুনি। ফলে নজরুলগীতির অন্তর্গত মর্ম বুঝতে শুরু করি। তখন এমন কয়েকটা গান চিহ্নিত করেছিলাম, যে গানগুলো সম্পর্কে এর আগে কেউ বিশেষভাবে কিছু লেখেননি। রচনাকাল মিলিয়ে এসব গানের মধ্যে আত্মজৈবনিক উপাদানও আমি দেখতে পাই। ‘মেঘে মেঘে অন্ধ অসীম’ গানটির কথাই ধরি। বিবিসিতে কাজ সেরে রাতে বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় গানটি শুনতে শুনতে মনে হলো, এটা তো তাঁর ছেলে বুলবুলের মৃত্যু নিয়ে লেখা! কিন্তু এ গানের সঙ্গে যে বুলবুলের স্মৃতির যোগ আছে, সে কথা আগে কেউ বলেননি। যা হোক, বিবিসির ওই অনুষ্ঠানে আমি নজরুলসংগীত নিয়ে যা বলেছিলাম, সেসবের মধ্যে অনেক নতুন পর্যবেক্ষণ ছিল। তখন থেকেই আমি ভাবছিলাম, নজরুলের জীবন নিয়ে একটা বড় কাজ করব।

এর আগে অবশ্য আমি ‘বিবিধের মধ্যে ঐক্য’ শিরোনামে নজরুল সম্পর্কে একটা বড় প্রবন্ধ লিখি। সেখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, একেক সময় নজরুল যে নিজের একেক রকম পরিচয় দিচ্ছেন, সেই পরিচয়টা আসলে ঐক্যসূত্রে গাঁথা। তিনি ইসলামি গান লিখেছেন, বৈষ্ণবদের কীর্তন লিখেছেন,আবার বৈষ্ণবদের সঙ্গে নিদারুণ শত্রুতার সম্পর্ক যাদের সেই শাক্তদের শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। এটা কি নিছক গ্রামোফোন কোম্পানির ফরমাশ থেকে? নাকি এর মধ্যে কোনো সূত্র আছে? আমি খেয়াল করলাম, একটা সূত্র ঠিকই আছে। সেই সূত্রটা ভক্তির ভক্তিগুণে তিনি এমনও লিখেছেন, ‘শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম’। অর্থাৎ যে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে এত তিক্ততা, সেই দুই ধারাকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছেন। জানি না, আমার আগে কেউ এই ভক্তিবাদের ঐক্যসূত্রটির বিষয় খেয়াল করেছেন কি না।

যাকগে, আমি বছর চারেক আগে নজরুল-জীবনীর কাজ বেশ শক্ত হাতেই ধরি। বিবর্তনমূলক অভিধান-এর প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পুরোটা সময় এখানেই দিয়েছি। তো, মাঠে নেমে খেয়াল করলাম, তাঁকে নিয়ে কাজ করা সহজ নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে আশার ছলনে ভুলি লিখতে গিয়ে আমি বহু নতুন তথ্য আবিষ্কার করেছিলাম। কিন্তু নজরুল সম্পর্কে নতুন তথ্য আবিষ্কার করা খুব কঠিন। তার কারণ মাইকেল যে সমাজের বা মানসিকতার লোক ছিলেন, নজরুল তো ঠিক সে রকম ছিলেন না। বাঙালি মুসলমান সমাজে যথাযথ তথ্য লিপিবদ্ধ রাখার প্রবণতাও তখন দুর্লক্ষ্য।

গোলাম মুরশিদ। ছবি: খালেদ সরকার
গোলাম মুরশিদ। ছবি: খালেদ সরকার

মুহিত: মাইকেল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে যেমন দেশ-বিদেশ ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, নজরুলের বেলায় তেমনটা সম্ভব হয়নি?

মুরশিদ: না, সেটা হয়নি। কারণ, নজরুল একটি তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের মধ্যেই বসবাস ও ঘোরাফেরা করেছেন। এবং সেই এলাকার মধ্যে তাঁকে নিয়ে সমকালে যত হইচই হয়েছে, তত লেখা হয়নি। নজরুল সম্পর্কে লিখিত তথ্য তাই আমি খুব বেশি পাইনি। যা পেয়েছি, তা দিয়ে তাঁর জীবনীর ও চরিত্রের কোনো নতুন দিক সেভাবে উন্মোচিত হয় না। যেমন নজরুল একবার ভোটে দাঁড়িয়ে হেরে গিয়েছিলেন সে তথ্য অনেকেরই জানা, কিন্তু তিনি কত ভোট পেয়েছিলেন তা কেউ লেখেননি। সেই তথ্য আমি খুঁজে বের করেছি। এখন তিনি ভোট এক শই পান কি এক হাজারই পান, তা দিয়ে তাঁর জীবনের কোনো বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করা যায় না। এ-জাতীয় তথ্য আমি বেশ কিছু পেয়েছি, কিন্তু সেটাকে আমি তাৎপর্যপূর্ণ বলব না। বরং বিশ্লেষণের দিক থেকে আমি অভিনব কিছু করার চেষ্টা করেছি, এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি। নজরুলকে আমি যেভাবে দেখেছি, তাঁর সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ হাজির করেছি তা একদমই নতুন। পুরোনো তথ্য নতুন করে বিচার-বিশ্লেষণ করেছি।

মুহিত: সে ক্ষেত্রে পুরোনো অনেক তথ্যের অসারতাও আপনার চোখে ধরা পড়েছে নিশ্চয়ই?

মুরশিদ: এর আগে যাঁরা নজরুল-জীবনী লিখেছেন তাঁরা যেকোনো তথ্যকেই সত্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। নজরুল তো প্রচণ্ড প্রাণবন্ত চরিত্রের মানুষ ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর সম্পর্কে সমকালে অনেক গুজব ছড়িয়েছিল। সেই সবগুলো গুজবকে তাঁরা সত্য বলে মেনে নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু আমি প্রত্যেকটা তথ্য যাচাই করেছি, দেখেছি তা সত্য কি না। যেসব তথ্য সত্য নয়, সেসব সম্পর্কে স্পষ্ট করে প্রমাণসমেত লিখেছি। বিরাজমান সব তথ্য, লেখা ও প্রচলিত জীবনীগ্রন্থ ঝাড়াই-বাছাই করে নজরুলের মূল্যায়ন করার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত নজরুলের যেসব জীবনী বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে, সেসবের মধ্যে বীরপূজার একটা স্পষ্ট প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। কখনো নজরুলের ধর্মপরিচয়ের কারণে, কখনো-বা তিনি ‘জাতীয় কবি’ বলে। আমি তাঁকে অকারণে বড় করতে চাইনি, ছোটও করতে চাইনি। তিনি যা, তা-ই নিরাসক্তভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এখানে একটা কথা বলতে চাই, নজরুল বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বিভিন্ন বইপত্রে, এমনকি সরকারি প্রকাশনায় তাঁর নামের পাশে ‘জাতীয় কবি’ লেখা হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি যে বাংলাদেশের জাতীয় কবি, এ-সংক্রান্ত কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন আমি খুঁজে পাইনি।

মুহিত: নতুনভাবে নজরুল-জীবনী লেখার প্রয়াস নেওয়ার পর আপনাকে কি কোনো বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। যতটা জানি, কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে...।

মুরশিদ: সে রকম কিছু ঘটনা তো ঘটেছেই বলে শুনতে পাই। হুমকি-ধমকি দেওয়া থেকে আরম্ভ করে আমার বিরুদ্ধে চিঠি লেখা, বিবৃতি, সই-সংগ্রহ—সবই নাকি হয়েছে। কিন্তু আমি এসবের পরোয়া করিনি। এসব তিক্ততা বা নীচতার সঙ্গে লড়াইয়ের কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।

মুহিত: কেউ কেউ জীবনীটির পূর্বপ্রকাশিত দু-একটি অধ্যায় পড়ে টিপ্পনী কেটেছেন এই বলে যে এর মধ্যে ‘আমিত্ব’ রয়েছে...।

মুরশিদ: আমাকে যদি নতুনভাবে বিশ্লেষণ করে নজরুল সম্পর্কে কোনো কথা বলতে হয়, যা আগে কখনো বলা হয়নি, তাহলে তো তা এভাবেই বলতে হবে যে ‘এই তথ্যটি প্রচলিত আছে, কিন্তু আমার ধারণা যে সেটি উক্ত কারণে সঠিক নয়।’ আর কীভাবে বলব! আর এটা যে বৈশ্বিকভাবে রীতি-পদ্ধতি হিসেবে অস্বীকৃত, তা-ও নয়।

মুহিত: আপনার মাইকেল-জীবনীর শিরোনাম ছিল আশার ছলনে ভুলি। আর এই প্রকাশিতব্য নজরুল-জীবনীর শিরোনাম বিদ্রোহী রণক্লান্ত। দুটো নামের মধ্যেই আছে বিষণ্নতার সুর। তাঁদের জীবনের ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির কথা মাথায় রেখেই কি এমন শিরোনাম বেছে নিয়েছেন? নাকি তাঁরা বাঙালি সমাজকে যেভাবে দেখতে চেয়েছিলেন, তা আর হয়নি—তাই এমন নাম নির্ধারণ?

মুরশিদ: সমাজের প্রতি তাঁরা কী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন, সেটা চিন্তা করে আমি নাম দিইনি। তাঁদের জীবনের ব্যক্তিগত যে ট্র্যাজেডি, তার কথাই বলতে চেয়েছি। ‘আশার ছলনে ভুলি’ শব্দ তিনটি দিয়ে যেমন মাইকেলের জীবনকথার সারমর্ম বলা যায়। জীবনে তিনি যা কিছু করেছেন, আশার ছলনে ভুলেই করেছেন। আর নজরুল-জীবনীর এই নাম নির্ধারণের নেপথ্যে যে ভাবনা ছিল, তা এমন, নজরুল নিজেকে একসময় বিদ্রোহী বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্রোহের প্রথম দুই-তিন বছর প্রকৃত বিদ্রোহীর মতোই আচরণ করছিলেন। তবে ১৯২৭ সালের শুরু থেকে তিনি পরাজিত হতে থাকলেন, পরাজিত হলেন দারিদ্র্যের কাছে। দারিদ্র্যের কাছে পরাজিত হয়ে তিনি রণক্লান্ত হলেন, রণে ভঙ্গ দিলেন। যার জন্য ১৯২৭ সালের মে মাসে নওরোজ পত্রিকায় তিনি চাকরি নিলেন একটি শর্ত মেনে। শর্তটি হচ্ছে, তিনি যা কিছু লিখবেন তার সবই ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হবে। কোনো স্বাধীনচেতা লেখক বা কবি এ রকম দাসত্ব-দশা মেনে নিয়ে চাকরি সাধারণত করবেন না। কিন্তু নজরুলের মতো বিদ্রোহীও সেই বশ্যতা স্বীকার করে নিলেন। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে নওরোজ ছেড়ে যোগ দিলেন সওগাত-এ। এবারে বেতন বেড়ে হলো দেড় শ টাকা। আর বিনিময়ে সেই একই রকম শর্ত। এভাবেই নজরুলের পরাজয়ের শুরু। সেই পরাজয় আরও বিস্তৃত হলো যখন তিনি ১৯২৯-৩০ সালে গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান লিখতে শুরু করলেন। তখন গান লিখতে গিয়ে তো নিজের মনের মধ্যে কী প্রেরণা আসছে, তা তিনি চিন্তা করছেন না। অন্তরের এই ভাব থেকে আমি এই গানটি লিখব—এমনটি কি আর ঘটছে? তখন তাঁর কাছে নিছক ফরমাশ দেওয়া হতো। কবি সে সময় লিখছেন অন্যের ফরমায়েশে—এর চেয়ে বড় পরাজয় আর কী হতে পারে? তবে তাঁর লেখা অধিকাংশ গানই যে রসোত্তীর্ণ ও চমৎকার হয়েছে, তা নিয়ে আমার দ্বিমত নেই, থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু আত্মিক পরাজয় স্বীকার করেই তিনি এই ক্ষেত্রে এসেছিলেন। এ কারণেই আমি বলেছি, তিনি বিদ্রোহী ঠিকই, কিন্তু রণক্লান্ত। পরাজিতও বটেন।

মুহিত: নজরুলকে নিয়ে আপনার লেখা সেই প্রথম প্রবন্ধের শিরোনামটাই আবার মনে আসছে, ‘পরাজিত সৈনিক’। ষাটের দশকের সেই ভাবনাটাই আবার ফিরে এল তাহলে?

মুরশিদ: অনেকটা তা-ই। তবে সেবারে কথাটা কম বয়সে না বুঝে লিখেছিলাম। এবারে বুঝেশুনে ব্যাখ্যাসমেত লিখলাম। আমি বইটার নাম কী হবে তা নিয়ে অনেক দিন ধরে চিন্তা করেছি। সাধারণত সব সময় আমি ধারণাগত নাম দিয়ে থাকি। ভেবেচিন্তে যখন ঠিক করলাম, বইটার নাম হবে বিদ্রোহী রণক্লান্ত, তখন লেখার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গেল। আমি তাঁকে এই ধারণা দিয়েই ব্যাখ্যা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে ‘বিবিধের মধ্যে ঐক্য’ শিরোনামটা নিয়েও ভেবেছিলাম। কারণ এই কথাটাও তাঁর সম্পর্কে আগাগোড়া খাটে। নজরুলকে আমরা নানান রূপে দেখে থাকি। তিনি কখনো বিদ্রোহী, কখনো প্রেমিক, কখনো কবি, কখনো গীতিকার, কখনো বৈষ্ণব বা শাক্ত, কখনো মুসলিম—এর মধ্যে একটা মিল কী করে পাওয়া যায়? কোথায় মিল আছে? সবই কি পাগলামি? নাকি পাগলামির ঊর্ধ্বে কোনো ‘কনসেপ্ট’ দিয়ে তাঁকে দেখানো যায়? আমি সেই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।

১৯৩০-এর আগ পর্যন্ত যে কবি নজরুলকে আমরা পাই, তার মধ্যে ঐক্যসূত্র হলো প্রেম। প্রেমের জন্য একই সঙ্গে তিনি বিদ্রোহী ও প্রেমিক। যোগসূত্রটা এখানেই। আর তিরিশের দশকে এসে যে নজরুলকে পেলাম, সেই নজরুল হচ্ছেন ভক্তিবাদী। আগেই যেমনটা বলেছি, এই ভক্তির ঐক্যসূত্রের কারণেই তিনি তখন ইসলামি গান থেকে আরম্ভ করে শ্যামাসংগীত—সবই লিখেছেন।

মুহিত: এই জীবনী লিখতে মোট কত দিন সময় লাগল?

মুরশিদ: শুরু করেছিলাম ২০১৩ সালের মাঝামাঝি। সেই হিসেবে বছর চারেক তো লেগেছেই। ধারণা করছি নির্ঘণ্টসহ বইটি পাঁচ শ পৃষ্ঠার মতো হবে। তো, পুরোটা লিখে ফেলার পর রেডিওর পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফাইন টিউনিং’ করা, তা করতেও অনেকটা সময় নিয়েছি। আমার ধারণা, বিদ্রোহী রণক্লান্তর গদ্য আশার ছলনে ভুলির তুলনায় অনেক বেশি পরিশুদ্ধ। অনেক বেশি সহজও। আমি গল্প বলার ভঙ্গিতে জীবনী লিখি। আমার সব লেখা অবশ্য তা-ই। সবাই যাতে বুঝতে পারে এমন গদ্যে লিখি। বুঝতে না পারলে তো লেখার অর্থ নেই কোনো। বইটি যেন সবার কাছে বোধগম্য হয়, পাঠমধুর হয়, সেই চেষ্টা করেছি। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আমি খুব বেশি পাইনি, কিন্তু লেখনীর এই বোধগম্যতার কারণে পাঠকদের অপরিসীম সমাদর পেয়েছি সব সময়।

মুহিত: সামনে আপনার নতুন পরিকল্পনা কী? নতুন করে কারও জীবনী লেখার কথা কি ভাবছেন?

মুরশিদ: আর জীবনী লিখব না। আমি বরং ভেবেছি, বাংলার স্থাপত্য নিয়ে একটি বই লিখব। আমি প্রকৌশলী নই, স্থপতিও নই। কিন্তু বাংলার স্থাপত্য নিয়ে আমার আগ্রহ বহুদিনের। বর্ণনামূলক ইতিহাস আমি লিখতে চাই না। শাসনামল ভেদে বাংলার স্থাপত্যশৈলীর রীতিতে কী কী পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে কেউ সেভাবে লেখেননি। আমি স্থাপত্যরীতির এই প্রবহমান পরিবর্তন নিয়ে লিখতে চাই। এর মধ্যে বাঙালিত্ব কীভাবে ফুটে উঠেছে, দেখানোর চেষ্টা করব তা-ও। এ ছাড়া সব বয়সী পাঠকের জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একটি পাণ্ডিত্য-বর্জিত প্রাঞ্জল ইতিহাস এবং বাংলা গানের একটি ইতিকথা রচনা করার আকাঙ্ক্ষাও মনের মধ্যে রয়েছে।