'বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নীরব যোদ্ধা'

রবিউল আফতাব
রবিউল আফতাব


রাইফেল রোটি আওরাত
উপন্যাসের লেখক আনোয়ার পাশার স্মৃতি ও কীর্তি নিয়ে কথা বলেছেন তাঁর ছেলে রবিউল আফতাব। জানিয়েছেন পাণ্ডুলিপি থেকে এ উপন্যাসটি কীভাবে বই হয়ে উঠল, সেই গল্পও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসউদ আহমাদ

মাসউদ আহমাদ: ১৯৭১ সালে আপনার বয়স ছিল ছয় বছর। বাবার কথা কতটুকু মনে পড়ে?

রবিউল আফতাব: বাবাকে নানাভাবে মনে আছে। বাবার হাত ধরে স্কুলে যেতাম। প্রথম স্কুলে ভর্তি হতে গিয়েছি বাবার সঙ্গে। শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, বয়স কত? আমি মজা করে বললাম, চৌদ্দ। স্কুল কর্তৃপক্ষ তখন আমাকে ভর্তি নিতে চাননি। বাবা বলেছিলেন, ছেলের মুখ দেখেও তো বোঝা যায়, সে কতটুকু। তখন আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর। ১৯৭০ সাল। তো, তাঁরা আমাকে ভর্তি করালেন। আমরা সে সময় ঈশা খাঁ হলে থাকতাম। বাবার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতাম, কাবাব খেতাম সেখানে গিয়ে। বাবা রেডিওতে কাজ করতেন। তিনি যখন অফিস শেষে বাসায় ফিরতেন, সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা, তুমি এত ছোট হয়ে রেডিওতে কীভাবে ঢোকো? আমার বড় ভাই ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্র। তাঁকে খুব উৎসাহ দিতেন বাবা। ঢাকায় একবার চাঁদের মাটি এনেছিল। বাবা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন, মনে আছে।

আদতে বাবা ছিলেন খুব মানবিক মানুষ। আমাকে কোনো দিন বকা দেননি। মানুষকে ভালো বাসতেন। সর্বদা আশার আলো ছড়াতেন। দেশ নিয়ে ধনাত্মক চিন্তা করতেন। মানুষকে কাছে টেনে নিতেন স্বভাবজাত কারণেই।

মাসউদ: ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর তুলে নিয়ে যাওয়া হলো আনোয়ার পাশাকে। সেই সময়ের কথা বলুন, আপনি কী দেখেছেন?

রবিউল: তখন তো চারপাশে ভীতিকর পরিবেশ। মানুষ কথা কম বলে। ভয়ে থাকে। বাবা একটা টাইপ রাইটার কিনেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের লিফলেট চারদিকে ছড়িয়ে দেবেন বলে। কিন্তু সেই সুযোগ আর পাননি। তিনি যেভাবে পেরেছেন, পরিবার ও মুক্তিবাহিনীর পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। লেখার মাধ্যমে সেই সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে সরব হয়েছেন।

মনে আছে, ১৪ ডিসেম্বর সকালে বাসায় কেউ কড়া নাড়ছিল। তখন আমরা বারান্দায় ক্যারমবোর্ড খেলছিলাম। হঠাৎ দরজায় শব্দ। সময়টা খুব খারাপ ছিল। বাবার বন্ধু ইংরেজির শিক্ষক রাশীদুল হাসান আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতেন। নাশতা করতেন বা এমনিতেও আসতেন। সেদিনও তিনি ছিলেন আমাদের বাসায়। তো, কড়া নড়ার শব্দ শুনে আমার খালাতো ভাই দরজা খুলে দেয়। আমি দেখলাম, বাসার নিচে একটা লাল বাস এসেছে। সেখান থেকে কিছু বন্দুকধারী লোক নামছে। একটু পরে বাসায় এসে তারা রাশীদুল হাসান সাহেবকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? তিনি বললেন, আমি, রাশীদুল হাসান। তারা বলল, এখানে আনোয়ার পাশা কে? বাবা এগিয়ে গিয়ে বললেন,Ñআমি। তারা ডায়েরি দেখে দুজনকেই আলাদা করে নিল। বাবার কাছে তারা গামছা চাইল। গামছা না পেয়ে বাবার গায়ের চাদর খুলে নিয়ে দুজনের চোখ বেঁধে ফেলল এবং নামিয়ে নিয়ে গেল নিচে। ততক্ষণে আমরা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখছি আর কাঁদছি। তারা বাবাকে নিয়ে যেতে যেতে ফাঁকা গুলি করে। ভয়ে আমরা সরে যাই। নিচে গিয়ে তারা সবাইকে গাড়িতে তোলে এবং নিয়ে চলে যায়। পরে জানা গেল, বাবাকে রমনা থানায় রাখা হয়েছে। আরও পরে জানলাম, মিরপুরে নিয়ে গিয়ে সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে।

মাসউদ: আনোয়ার পাশার সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত। এটি লেখা হয়েছে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময়। একে মুক্তিয়ুদ্ধের প্রথম প্রামাণ্য দলিলও বলা যাবে। প্রশ্ন হলো, বই আকারে এটি কীভাবে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথমে?

রবিউল: বাবা সব সময় খাতায় লিখতেন। আমরা সবাই জানতাম, তিনি লেখালেখি করেন। তো, রাইফেল রোটি আওরাত-এর পাণ্ডুলিপিটি খাবারের মিটসেফের ভেতরে লুকানো ছিল। সেটা প্রথমে খুঁজে পান বাবার বন্ধু ড. কাজী আবদুল মান্নান সাহেব। তিনিই এটা বই হিসেবে বের করার উদ্যোগ নেন। বর্ণ মিছিল থেকে বইটি প্রথম বের হয়।

মাসউদ: এই বইয়ের কিছু অংশ বঙ্গবন্ধুকে পড়ে শুনিয়েছিলেন ড. মান্নান। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বলেছিলেন, এটা ইংরেজিতে বের করার জন্য?

রবিউল: বইটির একটি প্রকাশনা উৎসবও করা হয়। মান্নান সাহেব বইটি বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেন এবং কিছু অংশ পড়েও শোনান। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, এমন একটা তপ্ত পরিবেশে যে মানুষ এত সুন্দর বই লিখতে পারেন, সেটা তো অনেক বড় ব্যাপার। তিনি বলেন, বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করতে। পরে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় রইফেল রোটি আওরাত-এর ইংরেজি অনুবাদের সংস্করণ। অনুবাদ করেছিলেন কবীর চৌধুরী।

মাসউদ: রাইফেল রোটি আওরাত সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত। বইটির জন্য ১৯৭২-এ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন আনোয়ার পাশা। এ উপন্যাসটিই তাঁর সবচেয়ে আলোচিত সাহিত্যকীর্তি। কিন্তু এর বাইরেও তো তাঁর অনেক সাহিত্যিক কাজ রয়েছে, যেগুলো আলোচনার বাইরে থেকে যায়।

রবিউল: আপনি একটা চমৎকার প্রসঙ্গ তুলেছেন। নিঃসন্দেহে রাইফেল রোটি আওরাত ভালো বই। কিন্তু তাঁর আরও অনেক কাজ আছে, যেগুলো চাপা পড়ে গেছে। এখন অবশ্য নতুন করে বইগুলো আবার প্রকাশিত হচ্ছে। প্রকাশ করছে স্টুডেন্ট ওয়েজ। বেশির ভাগই প্রকাশিত হয়েছে। বাকিগুলো প্রকাশের কাজ চলছে।

মাসউদ: মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় কলমসৈনিক হিসেবে আনোয়ার পাশাকে মানুষ আজ আলাদা করে চেনে এবং সম্মান করে। তাঁর সন্তান হিসেবে কী অনুভূতি হয়?

রবিউল: অনুভূতি খুবই ভালো, গর্বের। আমি চাই মানুষ ভালো থাকুক। শান্তিতে থাকুক। কারণ আমার বাবা মানুষের জন্য কাজ করেছেন। মানুষকে ভালোবেসেছেন। আমরা আনন্দিত। কৃতজ্ঞ। কেবল একাত্তরের নয়, তিনি ছিলেন সমাজের এক নীরব যোদ্ধা। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধের নীরব যোদ্ধা ছিলেন, তেমনি সমাজ বিনির্মাণেও যুদ্ধ করেছেন। সব সময় মানুষের ভালো চেয়েছেন, সমাজের ভালো চেয়েছেন। সুন্দর সমাজের স্বপ্ন দেখেছেন। আমার বাবা কিন্তু নামাজ পড়তেন। আবার এটাও বলতেন, ধর্মকে পুঁজি করে মানুষকে পিষ্ট করব না।