নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ: আমাদের সাহিত্যে

>

নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ নিয়ে গোটা পৃথিবী এখন সোচ্চার। ‘#মিটু’ আন্দোলন হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের অভিন্ন মঞ্চ। নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহ কীভাবে ধরা পড়েছে আমাদের সাহিত্য ও আত্মজীবনীতে? #মিটু আন্দোলনের পূর্বাপর প্রেক্ষাপটই-বা কী? গতকাল পেরিয়ে গেল বিশ্ব নারী দিবস। এই পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রেখে আজকের আয়োজন।

খেলারাম খেলে যা, নন্দিত নরকে ও আমার মেয়েবেলা—এই বইগুলোয় আছে নারী নিগ্রহের বিবরণ
খেলারাম খেলে যা, নন্দিত নরকে ও আমার মেয়েবেলা—এই বইগুলোয় আছে নারী নিগ্রহের বিবরণ

যৌন নিগ্রহ বা নির্যাতন নারীদের জীবনে প্রাত্যহিক ঘটনা, অহরহ ঘটছে; কিন্তু আমাদের শিল্পসাহিত্যে বিষয়টি খুব বেশি এসেছি কি? সাহিত্যে কতটা উঠে এসেছে এই নিগ্রহ?

সভামধ্যে দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহের চরম দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে চিরকাল।

রামচন্দ্র সীতার জন্য ভয়ানক যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধজয়ের পর সীতার চরিত্র হয়ে দাঁড়াল প্রশ্নের সম্মুখীন। পুরো ঘটনার জন্য সীতা যদিও এতটুকুও দায়ী নন, কিন্তু সমাজ, এমনকি রামও গ্রহণ করলেন না তাঁকে। আঙুল তোলা হলো নারীর দিকেই। এই প্রবৃত্তি সমাজে এখনো সমানভাবে বিরাজমান।

এবার আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়ার দিকে তাকানো যাক। সুবিশাল রবীন্দ্র-সাহিত্যে নারীর বঞ্চনা, ক্ষোভ, অপমান, বেদনা আর উপেক্ষার কথা এসেছে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে নারীর হৃদয়ের এত বিচিত্র অনুভব এবং তাঁর জটিল মনস্তত্ত্ব আর কেউ উপস্থাপন করেননি। কিন্তু যৌন নিগ্রহ? এমন তীব্র দেখা ও বোঝার চোখ থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ কি তা দেখতে পাননি? নাকি এড়িয়ে গেছেন সন্তর্পণে?

এড়িয়ে গেছেন আরও সব সাহিত্যিকও। বিভূতিভূষণে বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গা কৈশোরে কখনো যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল কি না, আমরা তা জানতে পারিনি। শরৎচন্দ্রের নায়িকার কষ্টে পাঠক কেঁদে বুক ভাসালেও তাদের জীবনের গ্লানিময় ক্লেদাক্ত ইতিহাস পাঠকের জানা হয়নি। তবে এ বিষয়টা চোখ এড়ায়নি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘সরসী বলিতে পারে না। অনেক চেষ্টায় একটু আভাস দিল। বাকিটুকু মা জেরা করিয়া জানিয়া নিলেন। জানিয়া মাথায় যেন বাজ পড়িল। রাগের মাথায় মেয়ের পিঠে গুম গুম করিয়া কয়েকটা কিল বসাইয়া দিলেন। বলিলেন, সেইকালে বারণ করেছিলাম সারা দুপুর টো টো করে ঘুরে বেড়াসনে সরি, বেড়াসনে। হলো তো এবার? মুখে চুনকালি না দিয়ে ছাড়বি, তুই কি সেই মেয়ে! সরসী খুব কাঁদিল।...তার কোনো অপরাধই নাই, সুবলদার মতলব বুঝিতে পারা মাত্র তার হাতে কামড়াইয়া দিয়া পলাইয়া আসিয়াছে সে। তবু তাকেই মার খাইতে হইল।’ (‘কেরানির বউ’, রচনাকাল: ১৯৪০)।

এর পাশাপাশি পড়া যাক গত ২৪ অক্টোবর ‘#মিটু’ আন্দোলনের জোয়ারে উদ্বুদ্ধ পুরান ঢাকার এক নারীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান: ‘আমি রান্নাঘরে ঢুকে মার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাম। ভাবলাম, মা কি জানে যে সব কিছু কেমন বদলে গেছে? আমি রান্নাঘরের কোণের দিকে মিশে যেতে চাইলাম। তারপর থাকতে না পেরে ফিসফিস করে মাকে বললাম, মা, ওই লোকটা আমার এইখানে হাত দিয়েছে! মা এমনভাবে তাকালেন যে তার মুখভঙ্গি আমাকে থামিয়ে দিল। তিনি ধমকে উঠলেন, বোকার মতো কথা বলো না। উনি একজন ধার্মিক মানুষ! মুরুব্বি মানুষ!’ ৭৫ বছর ব্যবধানে মানিকের সরসী আর ঢাকার তরুণীর অভিজ্ঞতা এভাবেই একাকার হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সাহিত্যে পাকিস্তানি সৈন্য কতৃক নারীর যৌন নির্যাতনের নানা বর্ণনা উঠে এসেছিল বিচিত্র ও বিপুলভাবে। কিন্তু শত্রুপক্ষের পুরুষ ছাড়াও আত্মীয়, বন্ধু, ভাইয়ের বন্ধু, প্রতিবেশী, শিক্ষক, বস, সহকর্মী, স্বামী, প্রেমিক—এমন হাজার রকমের পুরুষের দ্বারা নারী যে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, সে গল্প অমনভাবে কি দেখতে পাই? পুরুষের রচিত সাহিত্যে কেন যেন অনুচ্চারিতই থেকে যায় নিত্যদিনের এসব অপমানকর ঘটনা। এরই মধ্যে শহীদুল্লা কায়সারের সংশপ্তক সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা কিংবা শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর মতো বিখ্যাত ও বহুলপঠিত উপন্যাসে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের বিষয়টি খোলামেলাভাবেই উঠে এসেছে। এই যৌন নিগ্রহের বিষয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর গদ্যে। তাঁর ‘উৎসব’ গল্পে বন্ধুর স্ত্রীকে দেখে কামোদ্দীপ্ত আনোয়ার আলি গ্রাম্যতায় ভরা স্ত্রীর সঙ্গে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হয় আর ভাবে: ‘তবে ভালো ভালো মেয়ে দ্যাখা গেছে বহু, সুখ তো আজ ওদের নিয়ে, সালেহা উপলক্ষ মাত্র।’ (অন্য ঘরে অন্য স্বর, প্রকাশকাল: ১৯৭৬)

এরপরের ধাপে শহুরে মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর প্রথম উপন্যাস নন্দিত নরক-এ-ই মানসিকভাবে অপরিপক্ব রাবেয়া যৌন নিগ্রহের শিকার হয়। তারপরও নানাভাবে নানা গল্প-উপন্যাসে বিষয়টি এনেছেন হুমায়ূন। প্রিয়তমেষু উপন্যাস এর ভেতরে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে স্বামীর বন্ধু কর্তৃক পুষ্পর ধর্ষিত হওয়া এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি, এর আগে আমরা তেমন দেখিনি। এই লেখকের আরেক জনপ্রিয় উপন্যাস কোথাও কেউ নেই। এখানে বাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে নির্জন ঘরে প্রেমিকের দ্বারা মুনা যে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়, পরবর্তীকালে এই উপন্যাসটাই টেলিভিশন নাটকে রূপান্তরের সময় হুমায়ূন তা সন্তর্পণে এড়িয়ে গেলেন। পরিবারের চেনা গল্প, পারিবারিক বিনোদনের বাক্সে খোলাখুলি দেখাতে অস্বস্তি হয় বৈকি।

নারী লেখকদের মধ্যে তসলিমা নাসরিনই প্রথম বেশ সবিস্তারে নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন: ‘মজার জিনিসটা এইবার তরে দেখাই বলে একটানে আমাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেন মামা। আমার পরনে একটি কুঁচিওলা রঙিন হাফপ্যান্ট শুধু। শরাফ মামা সেটিকে টেনে নিচে নামিয়ে দেন। আমি তাজ্জব। হাফপ্যান্ট দুহাতে ওপরে টেনে বলি, কি মজার জিনিস দেখাইবা, দেখাও। আমারে ল্যাংটা কর ক্যা?’ (আমার মেয়েবেলা, প্রকাশকাল: ১৯৯৯)।

তারও আগে ইলা মিত্র বা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জবানে আমরা নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বয়ান পেয়েছি। পেয়েছি রিজিয়া রহমানের উপন্যাসে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস রক্তের অক্ষর পতিতাদের নিয়ে লেখা। এটি ছাড়া তাঁর আরও বিভিন্ন উপন্যাসে স্থান পেয়েছে বিষয়টি: ‘গুলজারের হাত ফাতেমার পিঠের মসৃণ ত্বকে খেলা করছে। ছিটকে সরে গেল ফাতেমা। গুলজার হঠাৎ দুহাতে বন্দি করে ফেলল ফাতেমাকে। ফাতেমা ছটফট করে চিৎকার করল, ছেড়ে দাও। গুলজার পাগলের মতো ঠোঁট স্পর্শ করছে ফাতেমার শরীরে—না ছাড়ব না। তুমি যদি না দাও, আমি কেড়ে নিতে জানি।’ (ধবল জ্যোৎস্না, প্রকাশকাল: ১৯৭৬)।

নারীর লেখা উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে যৌন নিগ্রহ
নারীর লেখা উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে যৌন নিগ্রহ

নারী লেখকরা নানাভাবে ও মাত্রায় নারীর প্রতি যৌন অসদাচরণ ও সহিংসতার বিষয়টি সামনে এনেছেন। কয়েকটি উদাহরণ:
‘ঘরে তিন বিবি থাকা সত্ত্বেও যখন তখন কর্তার ঘরে তার ডাক পড়ত। একদণ্ড বিলম্বও সহ্য হতো না নুনের বেপারির। খড়ম খটখটিয়ে দাসীমহলে চলে আসতেন।’ (সখী রঙ্গমালা, শাহীন আখতার, প্রকাশকাল: ২০১০)
‘সেদিন হঠাৎ করে গ্যাসের চুলাটি নিভে যাওয়ায় আমি রেজাউলের পকেটে দেশলাই খোঁজার জন্য দরজায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখি, হাত পা ছুড়ে চিৎকার করছে মেয়েটা এবং রেজাউল তাকে পেয়েছি পেয়েছি বলে বিছানার ওপর চেপে ধরেছে। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, মোটেও টের পায় না। সেই অবস্থায় বল কোথায় আছে বলতে বলতে ও মেয়েটার কাছে কিছু খোঁজার চেষ্টায় তার বুক, ঊরু আর শরীরের সব জায়গায় অবাধে হাত চালাতে থাকে।’ (উড়ুক্কু, নাসরীন জাহান, প্রকাশকাল: ১৯৯৩)।
‘জায়েন্ট দু-হাতের থাবায় সায়মের পোশাক আক্রমণ করতে এলে সে বলল, জায়েন্ট তুমি আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা।
তাই তো সব কিছুতেই আমি প্রথম হব। মাই ডিয়ার লিটিল বার্ড, বাধা দিসনে। নখরা দেখাসনে।...এই জায়েন্ট কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ছিল না। যেন সম্পূর্ণ অচেনা কেউ। এমনকি ঝড়-তুফানের পর যে কথা বলল, সে-ও। কিছুক্ষণ উপুড় হয়ে পড়ে থেকে উঠে যাবার আগে হুকুমি স্বরে বলল, তুই উঠবি না। এখন আন্না আসবে।
তার মানে?
মানে আন্না আসবে। জাস্ট ফুর্তি। টেক ইজি।’ (দূরে বৃষ্টি, রাবেয়া খাতুন, প্রকাশকাল: ২০০৩)
‘সত্য কইরা ক’ তো মা, তুই ক্যান চইলা আইলি?
সাহেব আমার গা হাতাইছিল।
তা তো কতবার হুনলাম। কিন্তুক সাহেব শুনি কত ভালা। অনেক ল্যাখাপড়া। অনেক বড় কাম করে। বিবি সাহেবও কত ভালা। চেহারা শুনছি বড় সোন্দর। ডবকা বউ ঘরে রাইখা তোর শুকনা গা ক্যান হাতাইবে সায়েবে ক’ তো ফিরু?’ (ভালোবাসার লাল পিঁপড়ে, আনোয়ারা সৈয়দ হক, প্রকাশকাল: ১৯৯৯)।
‘ভালোবাসার লোকটি বিয়ে করবে বলে বাণীশান্তা থেকে পটিয়ে এনে পুঁজির পুরো চার লাখ টাকা হাতিয়ে, পিটিয়ে আধমরা করে, যোনির ভেতরে চুল ঢুকিয়ে যখন ফেলে রেখেছিল তাকে বিএনপি আগারগাঁও বস্তির ধারে—রিজিয়া বিবি তখন ভাগ্যে সেখানেই নতুন মেয়ে ঢুঁড়ে খুঁজতে গেছিল। (সৌভাগ্যের রজনী, অদিতি ফাল্গুনী, প্রকাশকাল: ২০০২)।