বঙ্গবন্ধুকে দেখার স্মৃতি ভোলা সম্ভব নয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাঠক। ছবি: জহুরুল হক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন পাঠক। ছবি: জহুরুল হক

আমি অকিঞ্চিৎকর মানুষ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বড় মানুষকে নিয়ে কী লিখব। সঞ্চয়ে আছে বটে তাঁকে নিয়ে টুকরো কিছু স্মৃতি। তবে সেসবের ভেতর বঙ্গবন্ধু যতটা না প্রত্যক্ষভাবে আছেন, পরোক্ষে রয়েছেন তারও বেশি।

বঙ্গবন্ধুর কথা মনে উঠলে আমার মনে ভেসে ওঠে ১৯৭১ সালের রেসকোর্স ময়দান—এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। কেননা, ৭ মার্চে এই রেসকোর্সের মাঠেই বঙ্গবন্ধুকে সরাসরি প্রথম দেখি লাখ লাখ মানুষের ভিড়ে বসে। মনে আছে, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রেসকোর্সের আকাশে বারবার হেলিকপ্টার উড়ছিল। মনে হচ্ছিল যুদ্ধ তখনই শুরু হয়ে যাবে। কানাঘুষা ছিল, সভাস্থলে বোমা ফেলবে। অবাক ব্যাপার হলো, মানুষের সমাগম তারপরও কমল না, বরং বাড়ছিল। যাহোক, সেদিন আমিসহ আমার আরও অনেক পরিচিতজনই ছিলেন মাঠে। সবার ভেতরেই দারুণ উত্তেজনা, বঙ্গবন্ধু কী বলবেন, কী নির্দেশনা দেবেন?

তখন আমি ঢাকা আর্ট কলেজে (চারুকলা অনুষদ) সবে শিক্ষকতা শুরু করেছি। তরুণ শিক্ষক। একদিকে স্বপ্ন দেখছি স্বাধীন হওয়ার, অন্যদিকে কাজ করছে আতঙ্ক। সেখানে সেই যে তাঁকে প্রথম দেখলাম, পরে আরও কয়েকবার দেখেছি। তবে প্রথম দেখার স্মৃতি কোনো দিনই ভুলিনি। ভুলব না। আসলে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল ব্যক্তিত্বকে দর্শন করার স্মৃতি ভুলে যাওয়া সম্ভবও নয়।

প্রথম দেখার পর তাঁকে আবার দেখলাম দেশ স্বাধীন হলে, ১৯৭২-এ। সে সময় আমরা চূড়ান্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। সবকিছু নতুনভাবে সাজানো দরকার। আমাদের দেশ আমাদেরই সাজাতে হবে। বিদেশিদের কাছে তুলে ধরতে হবে নিজেদের সম্ভাবনা, সরকারের ভাবনা ছিল এমন। তথ্য মন্ত্রণালয় নতুন বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নিল। মিট বাংলাদেশ নামে একটি বইয়ের কাজে হাত দিল। মূলত আলোকচিত্রসহ দেশ-পরিচিতি ধরনের বই। অলংকরণের দায়িত্ব দেওয়া হলো কাইয়ুম চৌধুরী, কালাম মাহমুদ আর আমাকে। লেখকদের মধ্যে ছিলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ অনেকে। আমরা সেখানে অনেক ছবি সংগ্রহ, সম্পাদনা অলংকরণ, মেকআপ ইত্যাদি নানা কাজে যুক্ত ছিলাম। যেহেতু এটি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কাজ, ফলে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই ছিল ভালো করার তাগিদ। মিট বাংলাদেশ-এর উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসান।

তখন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। আমাদের কাজ দেখে তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। আমাদের প্রশংসাও করেছিলেন সামনাসামনি। বলেছিলেন, কাজ ভালো হয়েছে। এই ভালো কাজটি বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিতে হবে। ঠিক হলো, আমাদের উপস্থিতিতে মন্ত্রী বইটি উপহার দেবেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তখন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল বেইলি রোডের কর্নারের বাড়িটি। নির্দিষ্ট দিনে সেজেগুজে আমরা গেলাম সেখানে।

মনে পড়ে, দল বেঁধে আমরা সবাই চেয়ারে বসে আছি। আমার ভেতরে কাজ করছে অন্য রকম এক অনুভূতি, এত বড় একজন নেতাকে সামনে থেকে দেখব! না, সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেহেতু দলের মধ্যে আমি ছিলাম সবচেয়ে কনিষ্ঠ, স্বভাবতই উত্তেজনাও ছিল বেশি।

অপেক্ষা করছি বঙ্গবন্ধু, মানে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কখন নামবেন, কখন আমাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। অবশেষে দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। সবার মধ্যে ফিসফাস, বঙ্গবন্ধু আসছেন, বঙ্গবন্ধু আসছেন। দেখলাম, সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা এক সুপুরুষ নেমে আসছেন। একসময় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মিশে গেলেন আমাদের হাতে হাত রেখে। হাতে হাত মেলানোর সময় কারও থুতনি ধরে আদর করলেন, কারও নাম ধরে ডাকলেন, কাউকে তুই বলে সম্বোধন করলেন। মনে আছে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ডাকলেন চান্দু বলে। আর বললেন, আমাদের নিয়ে ভালো কিছু লেখালেখি করো।

একজন সামনে এসে প্রথমে তাঁকে পরিচয় করালেন কাইয়ুম চৌধুরীর সঙ্গে। দুজনে কথাবার্তা বললেন। শিল্পী জয়নুল আবেদিনের খোঁজখবর জানতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধু সব সময় জয়নুল আবেদিনকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতেন। এই ফাঁকে কাইয়ুম চৌধুরী পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে। বললেন, এই আমাদের তরুণ শিল্পী। ঢাকা আর্ট কলেজের নতুন শিক্ষকও। বঙ্গবন্ধু আমার কাছে জানতে চাইলেন, কী অবস্থা, কাজ করতে কেমন লাগছে, বইয়ের কাজটি কেমন হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সে সময় আমি উত্তেজনায় কাঁপছি, বঙ্গবন্ধুর হাত যে আমার হাতকে স্পর্শ করেছে, তাঁর সঙ্গে যে হাত মিলিয়েছি!

পরে উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি নিয়ে আমি গেলাম গ্রিসের এথেন্স শহরের ‘এথেন্স স্কুল অব ফাইন আর্টস’-এ। সেখানে গিয়ে ঘটল আরেক ঘটনা। ভর্তির সব কাগজ এক ভদ্রমহিলা দেখছেন। এই কাগজপত্রের সঙ্গে রয়ে গেছে শেখ মুজিবের সবুজ কলমে স্বাক্ষর করা ছাড়পত্র বা অনুমতিপত্র। আমি সেটি ফাইল থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা ওটা টান দিয়ে আমার হাত থেকে নিয়ে নিলেন এবং সবুজ কালির স্বাক্ষরটি দেখিয়ে বললেন, ইনি সেই মহান নেতা? এরপর ওই অনুমতিপত্রটি তিনি নিজের কাছে রেখে দিলেন। আমার ভীষণ মন খারাপ হলো। তাঁকে বললাম, ওটা তো আপনার প্রয়োজন নেই। আমাকে ফেরত দিন। তিনি দিলেন না। বললেন, এটা থাকুক আমার কাছে।

আমার পড়ালেখা যখন শেষের পথে, তখন অনেকবার ওই ভদ্রমহিলার কাছে ধরনা দিয়ে অতঃপর বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত সেই অনুমতিপত্রটি পেয়েছিলাম অবশ্য। তখন ১৯৭৫ সাল। আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ড তত দিনে ঘটে গেছে।

আমি গ্রিসে যাওয়ার ২০-২৫ দিনের মাথায় সেখানে সামরিক বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। চারপাশে ব্যাপক ভাঙচুর। ছাত্ররাও ক্ষেপেছিল তখন। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন করেছে। গ্রিক ভাষা শেখার জন্য সে সময় আবার আমি ছিলাম সালনিকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা এথেন্স থেকে পাঁচ-ছয় শ কিলোমিটার দূরে। খানিকটা মজা করেই সেখানে আমাকে সবাই বলতেন, তুমি আসার পর আমাদের এখানেও আন্দোলন শুরু হয়েছে। তুমিই আন্দোলন নিয়ে এসেছ।

ওই সময় বাংলাদেশের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর নামও জানত সমগ্র বিশ্বের মানুষ। তাঁর অনন্য একটি ইমেজও গড়ে উঠেছিল। ফলে গ্রিসে যেসব লোকের সঙ্গে ওঠাবসা-চলাফেরা করতাম, বঙ্গবন্ধুর দেশের লোক বলে তাঁরা আমাকে যথেষ্ট আদর-সম্মান করতেন। নিজেকে তখন খুব বড় মনে হতো। আড্ডাস্থলে বন্ধুরা জানতে চাইত, শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়েছে কি না। তাদের বলতাম, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার হাত মেলানোর স্মৃতির কথা।

আমাদের ক্লাস শুরু হতো ভোর সাড়ে ছয়টায়, শেষ হতো বিকেলে। তো, ১৯৭৫-এর আগস্টের কাকভোরে শিস বাজাতে বাজাতে কলেজে গিয়েছি। হঠাৎ এক বন্ধু এসে বলল, আরে, তুমি শিস বাজাচ্ছ, জানো তোমার দেশে কী হয়েছে? এরপর আমাকে সে দেখাল খবরের কাগজ। সেখানে আট কলামের হেডলাইন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ইসকতোথিকে ইকোগেনিয়া কস’। এই শিরোনাম দেখে আমার মুখ দিয়ে কথা আর বেরোচ্ছিল না। পাশে বাংলাদেশ নিয়ে আলাপ করছিল অন্য বন্ধুরা। তাঁরা বলছিল, তোমাদের দেশ আবার পাকিস্তানিরা চালাবে। এখন দেশের কী হবে? মর্মান্তিক ঘটনায় একদিকে প্রচণ্ড মন খারাপ, সেই সঙ্গে দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরে ফিরলাম।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর গ্রিসে আমার পরিস্থিতি আর আগের মতো ছিল না। আগে যেখানে আমাকে সবাই খুব সম্মান করত, কথা বলত আগবাড়িয়ে, কোথাও যেতে চাইলে সবুজ পাসপোর্ট দেখামাত্রই ছেড়ে দিত, সে রকম পরিবেশ আর থাকল না। এই নির্মম ঘটনায় একজন মানুষ, একজন নেতা তাঁর ভূখণ্ডের বাইরেও কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, আমি তা দেখেছি। দেখেছি কীভাবে বহির্বিশ্বের মানুষেরা বঙ্গবন্ধুকে সম্মান ও সমীহ করত, করে; এবং তাঁর কারণে আমাদের দেশটিকেও তারা সম্মান করে।