প্রীতিময় স্মৃতিময় গল্প

বেলা-অবেলার কথা সেলিম জাহান প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৮৩, দাম: ৩৫০ টাকা।
বেলা-অবেলার কথা সেলিম জাহান প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা: ১৮৩, দাম: ৩৫০ টাকা।

‘কড়া নাড়ব না বৈদ্যুতিক ঘণ্টিটি বাজাব, তা ভাবতেই মিনিটখানেক কেটে গেল। অকারণে নয়, সময়টার কথা ভেবেই আমার এ দ্বিধা। শীতের পড়ন্ত বিকেল—ইতিমধ্যেই সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম গগনে। চারদিক সুনসান, শব্দদের নিলডাইন করে রাখা হয়েছে চারপাশে—নিস্তব্ধতার গন্ধ এসে লাগছে নাকে। আমি ক্ষয়ে যাওয়া, বিবর্ণ হয়ে ওঠা লাল মেঝের বারান্দায় দাঁড়িয়ে।...একটু এগোতেই রফিকদের বাড়ির সামনের মজা পুকুরটি—প্রায় ৫০ বছর আগেও এটা মজা পুকুরই ছিল। এখন ছোট হতে হতে এটা ডোবা হয়ে গেছে। ভেঙে পড়া পাড়ে জলের ওপর কলমিলতা আর তার বেগুনি রঙের ফুল, হেলেঞ্চার ঝোপ, এখানে-ওখানে ঢেঁকিশাকের সাপের মতো পেঁচানো শুঁড়। একটা ফড়িং কেবলই উড়ে উড়ে সেই শুঁড়ে বসছে আর সরে যাচ্ছে।’

ওপরের এই অংশটি যেন কোনো গল্পের ধারাবর্ণনা। যেকোনো পাঠকেরই মনে হতে পারে, গল্পের মধ্যে ‘গল্প’ বলতে গিয়ে গল্পকার ওপরের বাক্যসমূহ চিত্রিত করেছেন। গল্প বটে! তা কোনো সাহিত্য-পদবাচ্য ‘গল্প’ নয়, তা একান্ত নিজের গল্প। মূলত স্মৃতিগল্প।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহানের ফেসবুকের—তাঁর ভাষায় অবয়বপত্রের—প্রতিদিনকার লেখা নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত বেলা-অবেলার কথা বইয়ের প্রতিটি লেখার ধরনই এমন। একজীবনে কত ঘটনা-দুর্ঘটনাই তো দেখতে হয়। হাঁটতে-ফিরতে-পথ চলতে সেসব ঘটনার কতটাই-বা আমরা মনে রাখি। কিন্তু সেলিম জাহান মনে রাখেন। কেবল মনে রাখেনই না, তিনি পাঠককেই মনে করিয়ে দেন। ‘প্রারম্ভিকা’ নামের ভূমিকা বাদ দিয়ে বইটি পড়া শুরু করলে যেকোনো পাঠকের দ্বিধা জাগতে পারে বইয়ের ধরন নিয়ে।

লেখকের গল্প বলার মুনশিয়ানার কারণেই পাঠক স্মৃতিকথা পাঠের চেয়ে বেশি আনন্দ লাভ করবে এ বই পড়ে। বলার ধরন এমনই আকর্ষণীয় যে ব্যক্তিগত গবেষণা সহকারীকে নিয়ে যখন গল্প ফাঁদেন, যখন তার একান্ত ব্যক্তিকথার আভরণ উন্মোচন করেন, যখন আবিষ্কার করেন প্রেম-অপ্রেমের গল্পকথা, তখন কীভাবে লেখক তার পাশে দাঁড়ান, তা যেমন পিতা-কন্যার চরিত্রের মতো একাকার হয়ে যায়, তেমনি পাঠকের সঙ্গেও লীন হয়ে যায় তাদের আবেগ।

স্মৃতিগল্প বলতে বলতেই লেখক এমন বিষয়ের অবতারণা করেন, বুঝতে বাকি থাকে না, তাঁর শেকড় বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে। তাঁর লেখার সুবাদে চিত্রিত হয় ৫০-৬০ বছর আগের মানুষের পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক-সংস্কৃতি-আন্তরিকতার স্বরূপ। সম্পর্কগুলো আমাদের স্মৃতিকাতর করে তোলে, ‘পঞ্চাশ বছর আগে অনিতাদি আর আমরা প্রতিবেশী ছিলাম বরিশাল শহরে। তাঁর ভাই তপন ছিল আমার সহপাঠী। কী আদরই না করতেন অনিতাদি আমাকে! রোদে ক্রিকেট খেলে ঘেমে তাঁদের বাড়িতে ঢুকেই বলতাম, “অনিতাদি, জল দাও বিরাট এক গেলাসে।” অনিতাদি হেসে একটা মাঝারি গেলাসে জল ঢেলে এনে বলতেন, “তোর তেষ্টার যুগ্যি গেলাস তো নেই এখন ভাই। আজ এটাতেই খা। কাল বড় গেলাসে আনিয়ে নেব ক্ষণ।”...সত্যি সত্যি পরের দিনে বিরাট বড় কাঁসার গেলাস কিনে এনেছিলেন অনিতাদি। সব সময় গেলাস তোলা থাকত আমার জন্য। কাউকেই ধরতে দিতেন না সে গেলাস।’

৫০ বছর পর সেলিম জাহান খুঁজে বের করেছেন তাঁর অনিতাদিকে। তখনো ‘পৃথিবীর সব মমতা তাঁর চোখে ঢেলে মায়াময় হাসি ঠোঁটে নিয়ে অনিতাদি যখন জলের গেলাসটি আমার সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, তোর তেষ্টার যুগ্যি বড় গেলাসেই জল দিলাম। আমি চোখ তুলে চাইতে পারছিলাম না অনিতাদির মুখের দিকে। কেমন করে চাইব? আমার চোখ দিয়ে যে তখন টপটপ করে জল পড়ছিল ওই বড় গেলাসেই।’

লেখকের বড় গুণ হলো, তিনি নিজে যখন নস্টালজিক হয়ে যান, তখন পাঠককেও স্মৃতিকাতর করে তোলেন। নিজের গল্প সবার গল্প হয়ে যায়।

এক বিকেলে ম্যানহাটনের পূর্বী নদীর তীরে হাঁটছিলেন লেখক। সেই সায়াহ্নের বিশেষ সময়ের আলো মনে করিয়ে দিল তাঁর ছেলেবেলার কথা। বলে চললেন বাংলাদেশের সমাজের যুগ যুগের এক কঠিন বাস্তবতার কথা। তাঁর বালকবেলার সময়ের কঠোর পণপ্রথার কথা, ‘সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি মা ভীষণ খুশি—নাজমা আপাকে ছেলেপক্ষের পছন্দ হয়েছে—বিয়ের তারিখও পাকা হয়েছে। তবে ছেলেপক্ষ বহু কিছু দাবি করেছে। “মেয়ে বিয়ে দিতে হলে তো দিতেই হবে”, আমার মায়ের অভিমত।...তাহলে পছন্দ হয়েছে কথাটির মানে কী?’

বইয়ের আরেকটি গল্প বলে শেষ করি। লেখক একবার গিয়েছেন মস্কোতে। একদিন সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরেছেন। সেই বর্ণনা বেলা-অবেলার কথায় আছে এভাবে: ‘চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলতেই চমকে গেলাম। আলো উদ্ভাসিত ঘর—না, চড়া আলো নয়, বিকেলের নরম পড়ন্ত রোদের মোলায়েম আলো ডিমের হালকা কুসুমের মতো। অনেকটা এলিয়ে পড়েছে ঘরের মেঝেতে, তির্যকভাবে লেপ্টে আছে ঘরের সাদা দেয়ালে, তিরতির করে কাঁপছে জানালার পর্দায়।’

আত্মজীবনী যাকে বলে, এই পুস্তক তা নয়। কিন্তু লেখকের জীবনের অবিচ্ছেদ্য গল্প এগুলো। জীবনের খণ্ড খণ্ড স্মৃতিকে তিনি একেকটি দৃশ্যকাব্য হিসেবে নির্মাণ করেছেন। যেগুলোর প্রতিটিতে আছে কোনো না কোনো বার্তা।