লেখালেখির ইসকুল

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

ক্রিস রায়ান একাধারে একজন ঔপন্যাসিক, গল্পলেখক ও শিক্ষক। রুজভেল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএফএ (মাস্টার অব ফাইন আর্টস) ফ্যাকাল্টিতে ভদ্রলোকের পড়ানোর বিষয় সৃজনশীল লেখালেখি (ক্রিয়েটিভ রাইটিং)। পাশ্চাত্যে বহুলপরিচিত এই ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁদের পেশার খাতিরে লেখক পরিচিতিটা প্রয়োজন—অনেকটা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি। তার মানে এই নয়, ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সের শিক্ষক বা পরিচালকেরা তাঁদের লেখক পরিচিতিকে স্রেফ পেশার খাতিরেই ব্যবহার করে থাকেন। জানামতে, অনেক নামজাদা লেখক, যেমন হানিফ কোরেইশি, জর্জ স্যান্ডার্স, অ্যাডাম মারেক প্রায় নিয়মিতই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কর্মশালায় ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স পরিচালনা করেন। তাঁদের তুলনায় ক্রিস রায়ান লেখক হিসেবে অনুল্লেখ্য, তবে শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল লেখালেখির চর্চা ও লেখক হতে আগ্রহী তরুণ-তরুণীদের নিয়ে তাঁর কেটেছে প্রায় আড়াই যুগ—আমেরিকায় ও কানাডায়।

দীর্ঘদিন শিক্ষার্থী লেখকদের তামিল দেওয়ায় নিয়োজিত থাকলেও ক্রিস রায়ান তাঁর কাজকে দেখেন শ্রেণিকক্ষে অন্য যেকোনো বিষয়ে পাঠদানের মতোই। তাঁর বিশ্বাস, শ্রেণিকক্ষে যা শেখা সম্ভব, তা নিজ চেষ্টায় আয়ত্ত করা বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া সম্ভব নয়। লেখালেখি মকশো করতে যাঁরা তাঁর ক্লাসে আসেন, তাঁদের নিয়ে তাঁর প্রথম পরিকল্পনা থাকে নানা ধরনের বইপত্র পাঠ ও আলোচনার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে তাঁদের সাহিত্য ও সৃজনভাবনাকে নেড়েচেড়ে একটা পর্যায়ে উন্নীত করা। দ্বিতীয় কাজটি, যাকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন, তা হলো হবু লেখকদের তাঁদের বিচরণের ক্ষেত্র চিনিয়ে দিতে সাহায্য করা। ক্রিসের বিবেচনায় এটাই তাঁর মূল কাজ। তাঁর জবানিতে যাঁরা ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স চালান, সবার বেলায় ব্যাপারটা তা-ই হওয়া উচিত। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন লেখক (হবু লেখক) কী নিয়ে লেখালেখি শুরু করবেন, লেখালেখির কোন মাধ্যম তাঁর মেধা, চিন্তাভাবনা ও লেখনীশক্তির সহগামী, তা বুঝতে বুঝতেই জীবনের একটা মূল্যবান সময় ব্যয় করে ফেলেন। কেউ হয়তো কবিতা দিয়ে হাত পাকানোর চেষ্টায় ব্যস্ত, কিন্তু তাঁর শক্তির জায়গা কবিতা নয়, হতে পারে তা নাট্যকলা বা অন্য কিছু। লেখক যত তাড়াতাড়ি তাঁর নিজের স্বচ্ছন্দ বিচরণের জায়গাটা ধরতে পারবেন, ততই সুবিধা।

এ যুক্তির যথার্থতা নিয়ে তর্ক করার কিছু নেই, যদিও প্রশ্ন থেকে যায়, কাজটা কতটা সার্থকভাবে করা সম্ভব বা সব ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সে কি বিষয়টার ওপর সমান গুরুত্ব পায়?

প্রশ্নটা তোলা থাক। বরং অন্য প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া যেতে পারে। লেখালেখি কি আদৌ শেখানোর জিনিস? হাতে-কলমে? বিশ্বব্যাপী, বিশেষত পাশ্চাত্যে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের যত বিস্তারই ঘটুক, এ প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। ক্রিস রায়ানের কথা যদি মেনে নিই, অর্থাৎ হবু লেখকদের সঠিক পথের দিক-দিশা দেওয়াই রাইটিং প্রোগ্রামের মূল লক্ষ্য, তাহলে পরের ধাপে শিক্ষার্থীরা কতটা সার্থকভাবে এগোতে পারবে—এ তর্কের শেষ নেই। কট্টর বিরোধীপক্ষ এমনও বলে থাকেন, যদি এ ধরনের কোর্স বা প্রোগ্রাম লেখক তৈরির কারখানাই হবে, তাহলে অন্তত দু-চারজন বরেণ্য লেখকের খোঁজ তো পাওয়া যেত, যাঁরা এই কারখানার ফসল।

লেখালেখি শেখানো যায় কি না—এ প্রশ্নটা তাই সংগত কারণেই এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল। শ্রেণিকক্ষে ইতিহাস বা পদার্থবিদ্যা পাঠদানের মতো এখানে কোনো নিয়ম, এমনকি ঠিক-বেঠিকের তথাকথিত শৃঙ্খলা খাটে না। অনেক ক্ষেত্রেই অন্য দশটা সাহিত্যের ক্লাসের মতো সাহিত্যবিষয়ক বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়, শিক্ষার্থীদের আলোচনায় উদ্বুদ্ধ করতে নানা কৌশলও খাটানো হয়, যাতে তাঁদের চিন্তাভাবনা স্বাধীনভাবে প্রকাশের পথ পায়। সেই সঙ্গে যা অবধারিতভাবে যুক্ত তা অবশ্যই নানা বিষয়ে নিরন্তর লেখালেখির অনুশীলন। ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের প্রবক্তাদের মতে এই প্রক্রিয়া ভবিষ্যতের লেখক তৈরিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বিরুদ্ধবাদীরা এ ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে বলেন, লেখালেখির ক্ষেত্রে এসব একদম অচল। শুধু অচলই নয়, ক্ষতিকরও। লেখক পরিচিতি পেতে উন্মুখ তরুণ-তরুণীদের চিন্তাভাবনা ও কল্পনাশক্তি শ্রেণিকক্ষশাসিত সাহিত্যভাবনায় আটকা পড়ে গণ্ডিবদ্ধ হয়ে যেতে পারে। তাঁদের মতে, এর ফলে বড়জোর ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির ওপর কিছুটা দখল বাড়তে পারে।

ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের সূচনা গত শতকের বিশের দশকে আমেরিকায়। সে সময় অবশ্য ওয়ার্কশপ বা কর্মশালা পর্যন্তই ছিল এর সীমানা। আর সে কারণে এর কোনো পোশাকি বা প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্র ছিল না। পরে যুদ্ধোত্তরকালে প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্যে ও ছত্রচ্ছায়ায় ধীরে ধীরে এটা বিকাশ লাভ করেছে। জন হপকিন্স, কলাম্বিয়া, স্ট্যানফোর্ড, কর্নেল প্রভৃতি নামকরা মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স নিয়মিত পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে মূলত ষাট ও সত্তরের দশকে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে পুরোদস্তুর স্নাতকোত্তর কোর্স চালু করে। সেই সঙ্গে অন্য যে কাজটি করা হয় তা সাহিত্যে উঁচু ডিগ্রিধারী অধ্যাপকদের পাশাপাশি খ্যাতনামা লেখক, যেমন ফিলিপ রথ, কুর্ট ভোনেগেট, নেলসন ওলগ্রেনের মতো অনেককে দিয়ে কোর্স পরিচালনা করা।

বলা নিষ্প্রয়োজন, ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রাম সর্বতোভাবেই মার্কিন আবিষ্কার, আর সে কারণে এটা বহির্বিশ্বে একটা উল্লেখযোগ্য মার্কিন রপ্তানি পণ্যও বটে। ইংরেজি ভাষাভাষী অনেক দেশ—অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা একে সাদরে আহ্বান জানালেও ব্রিটিশরা গোড়ার দিকে মোটেও আগ্রহ দেখায়নি, যদিও বেশি দিন লাগেনি তাদেরও এক কাতারে শামিল হতে। সাম্প্রতিক সময়ে বিলেতের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় রাইটিং প্রোগ্রামের একটা অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেশ কিছুকাল ধরেই আফ্রিকা, লাতিন ও মধ্য আমেরিকার নানা দেশে এই প্রোগ্রামের প্রসার যেমন দ্রুত ঘটছে, তেমনি ইসরায়েল, মেক্সিকো, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশেও খানিকটা প্রতিপত্তি নিয়েই বিরাজ করছে।

ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের দ্রুত প্রসার দেখে এর ব্যবসায়িক দিক যেমন এড়িয়ে যাওয়া যায় না, তেমনি এর হুজুগে প্রবণতাকেও অস্বীকারের উপায় নেই। ব্যাপারটা যেন অনেকটা এ রকম: লেখালেখির সৃজনপ্রতিভা এমনি এমনি গড়ে ওঠে না, এর ডালপালা, শাখা-প্রশাখা বিস্তর যত্নে লালন করতে হয় বলেই একটা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। পৃথিবীতে কোন কাজটা না শিখে করে ফেলা সম্ভব! আর কোন কাজটাই-বা সৃজনশীল নয়—ছুতার, দরজির কাজ থেকে শুরু করে রকেট চালানো! লেখালেখি কোনো রহস্যময়, লুকোছাপার বিষয় নয় যে এটা অন্যের কাছে শেখা যাবে না।

বলা ভালো, যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত, বিশেষত শিক্ষককুলের একটা বড় অংশ, তাঁরা স্পষ্টতই লেখক তৈরির কারিগর হিসেবে নিজেদের যথেষ্ট অভিজাত ভাবার সুযোগ পান—অন্তত কয়েকজনের লেখাজোকা পড়ে সরাসরি না হলেও এ ধারণার সমর্থন মেলে। রাইটিং প্রোগ্রামের সার্থকতা নিয়ে তাঁদের অনেকের যুক্তি হলো, কোর্স পরিচালনার সময় শিক্ষার্থীদের প্রকাশক্ষমতা ও কল্পনাশক্তিকে উজ্জীবিত করতে, বিশেষত একই বিষয় বা ঘটনাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ও যাচাই করার জন্য যেসব অনুশীলন করানো হয়, তাতে ভবিষ্যতে লেখক হতে বদ্ধপরিকর একজন শিক্ষার্থী অবশ্যই লাভবান হবে।

কৌতূহলের বিষয় যা, অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখক যাঁরা রাইটিং প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত, যেমন ব্রিটিশ লেখক হানিফ কোরেইশি, এ মতের সমর্থক তো ননই, বরং তাঁর মতে গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন ও সময়ের অপচয় ছাড়া কিছু নয়। সৃজনশীলতা উৎপাদনের নামে এখানে যা করা হয়, তাতে একধরনের ছাঁচবন্দী গদ্যভাষার তালিম দেওয়া হয়, কিন্তু এতে কার লাভ হয়? পাঠক গল্প পড়তে চায়, শুধু ভাষার কারিকুরিতে তার আগ্রহ নেই। ছাত্রছাত্রীদের যদি প্রথাগত ছাঁচ থেকে বের করে নিজেদের চিন্তা-কল্পনার মিশেলে মৌলিক লেখার সামর্থ্য জোগানো না গেল, তা-ও বিরাট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে, তাহলে একে কী বলা যায়—ঠকবাজি নয়? হানিফ কোরেশি এ প্রসঙ্গে অন্য যে তথ্যটি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে তাক লাগানো। তাঁর মতে, ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামে যাঁরা অন্যের হাত ধরে লেখক হওয়ার বাসনা নিয়ে ভর্তি হন, তাঁরা প্রায় সবাই-ই মেধা বিবেচনায় অত্যন্ত গড়পড়তা মানের, সত্যিকার সাহিত্যমেধাসম্পন্ন কেউ এখানে আসেন না, যে কারণে তিন বছর বা আরও বেশি সময় পার করে তাঁদের পক্ষে ডিগ্রি বগলদাবা করাই সম্ভব হয়, উন্নত সাহিত্যচর্চা কখনোই নয়।

হানিফ কোরেইশি পেশায় শিক্ষক হলেও মূলত লেখক বলেই হয়তো রাইটিং প্রোগ্রামের খামতি নিয়ে চাঁছাছোলাভাবে বলতে দ্বিধা করেননি। লুসি এলম্যান নামের একজন অপেক্ষাকৃত স্বল্পখ্যাত ব্রিটিশ লেখিকা, যিনি একসময় রাইটিং প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, একই ভঙ্গিতে একে শিক্ষাঙ্গনের সবচেয়ে বড় প্রতারণা (দ্য বিগেস্ট কন-জব ইন একাডিমিয়া) বলে মনের ঝাল ঝেড়েছেন।

সৃজনশীল লেখালেখি নিয়ে দেশে দেশে এত যে তোড়জোড়, সবই কি তবে অপচয়? হুজুগে মেতে ওঠা পুঁজিবাদী সাহিত্যবাণিজ্য?