পুলিৎজার পুরস্কার ২০১৮


এক অনিশ্চিত জীবনের গল্প ‘লেস’
তুষার তালুকদার

আর্থার লেস একজন মাঝারি গোছের ‘সমকামী’ ঔপন্যাসিক। বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর কদর দিনে দিনেই কমছে। প্রকাশক সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর সদ্য লেখা উপন্যাস সুইফট তিনি প্রকাশ করবেন না। প্রকাশ না করার কারণ হিসেবে তাঁর যুক্তি, এটি অতীব ‘ভাবাশ্রয়ী ও মর্মভেদী’। অন্যদিকে, এত দিনের পুরোনো বয়ফ্রেন্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করবে, আর এ উপলক্ষে লেসকে নিমন্ত্রণপত্রও পাঠিয়েছে। নানাভাবে নাকাল, বিপর্যস্ত আর্থার লেস সিদ্ধান্ত নিল পৃথিবীজুড়ে যেসব সাহিত্যানুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়েছে, সেসবে যোগ দেবে সে। তবে কি জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় লেস?

হ্যাঁ, পাঠক এভাবেই শুরু হয়েছে ২০১৮ সালে উপন্যাসে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া মার্কিন ঔপন্যাসিক অ্যান্ড্রু সিন গ্রিরর লেখা উপন্যাস লেস-এর গল্প।

অ্যন্ড্রু সিন গ্রির এক সাক্ষাৎকারে এই উপন্যাস লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে বলেন, ‘আমি কখনোই এর আগে একজন লেখকের জীবনকে আমার কোনো উপন্যাসে তুলে ধরিনি। হ্যাঁ, আর্থার লেসের মতো একজনের কথা আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম এই উপন্যাস কেবল আনন্দপূর্ণ হবে, পরে দেখলাম তা সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি লেখকেরই কিছু কষ্ট আছে, যা আনন্দের পেছনে লুকিয়ে থাকে। আর্থার লেসের কষ্ট, অপমান, যন্ত্রণা, হতাশা, না পাওয়া ইত্যাদির সঙ্গে থাকতে চেয়েছি আমি। তবে এসব উপাদানের পরতে পরতে রসবোধও আছে। দেখাতে চেয়েছি কীভাবে মাঝারি মানের একজন লেখক জীবনের নানা ধাপে প্রত্যাখ্যাত হয়ে পালিয়ে বেড়াতে চায়। এক কথায়, লেস পাগলাটে, নিজেকে তরুণ ভাবতে ভালোবাসে। সব অপমান মাথা পেতে সয়েছে। ভাবে, একদিন সফলতা হয়তো আসবে, কিন্তু জানতে-বুঝতে চায় না—কীভাবে।’

এতক্ষণে নিশ্চয় আপনাদের জানতে ইচ্ছা করছে, হতাশাগ্রস্ত আর্থার লেসের জীবনে আর কী কী ঘটেছে।

সানফ্রান্সিসকোতে বয়ফ্রেন্ডের বিয়ে এড়ানোর জন্য প্রথমেই লেসকে দেখি নিউইয়র্কের একটি সাহিত্যানুষ্ঠানে যেতে। সেখানে তাকে এইচ এইচ এইচ ম্যানডার্ন নামে একজন সায়েন্স ফিকশন লেখকের সাক্ষাৎকার নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু ওই লেখক হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় শেষ পর্যন্ত সাক্ষাৎকারটি তাকে নিতে হয়নি। মজার ব্যাপার হলো, লেখক সাক্ষাৎকার দিতে উপস্থিত না হলেও লেস ঠিক সময়েই অনুষ্ঠানে এসেছিল, তবে হেলমেট পরে, যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। অ্যান্ড্রু সিন গ্রির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘লেসের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল হীনম্মন্যতা, নিজেকে নানা কারণে পরাজিত ভাবত। কোনো কোনো সময় মানুষের সামনে নিজেকে তুলে ধরতে সংকোচ বোধ করত।’

আবার জার্মানিতে এক সাহিত্যানুষ্ঠানে তাকে যখন বেশি রাতের একটি অধিবেশনে নিজের বই থেকে পড়তে দেওয়া হলো, তখন লেস বলে উঠল, ‘রাত এগারোটায় আমাকে কে শুনতে আসবে?’ আয়োজকদের বলল, ‘এটি আপনাদের মানসিক অসুস্থতার পরিচয়।’ এভাবেই লেসকে কখনো দেখা যায় হেলমেট পরে হাসির পাত্র হতে, আবার কখনো দেখি নিজের আত্মসম্মানের প্রতি খুবই সোচ্চার।

এর মধ্যেই আমরা জেনেছি, বর্তমান জীবনের দুঃখ ভুলতে নানা দেশের সাহিত্য সম্মেলনে ঘুরে বেড়াচ্ছে লেস। কিন্তু আদতে দুঃখ কি তার পিছু ছেড়েছে? একদিন নিউইয়র্কে তার এক পরিচিতজন বলে বসল, ‘আপনি একজন মধ্যবয়স্ক বিরক্তিকর লেখক। তার ওপর সমকামী। আপনি কেবল আমেরিকার যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনকেই উপন্যাসে তুলে ধরতে চান। কষ্টকে কেবল মহিমান্বিত করতে চান। আসলে আপনি সমকামী হিসেবেও দ্বিতীয় শ্রেণির। এসব আর কত! লেস সাহেব, এবার একটু উচ্চাকাঙ্ক্ষী হোন, আমাদের উদ্বুদ্ধ করুন।’

অ্যান্ড্রু সিন গ্রিরকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন তিনি লেসের সমকামিতার কথা বারবার বলতে চেয়েছেন?

‘একজন সমকামী লেখককে যে কিছু বাড়তি কথা শুনতে হয়, তা তো সত্যি। “সমকামী” পরিচয়টাও যে নানাভাবে একজন লেখকের ওপর সামাজিক চাপ তৈরি করে, তা আমি দেখাতে চেয়েছি।’ গ্রির সাবলীল জবাব।

লেসের বয়স যখন বিশ থেকে তিরিশের কোঠায়, তখন তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল রবার্ট বাউনবার্ন নামে প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য এক কবির। তবে চমকপ্রদ বিষয় এই যে লেস কখনোই রবার্টকে তার চেয়ে বয়সে বড় ভাবত না। তাদের সম্পর্কটা ছিল খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন আসে, রবার্টের সাফল্য কি কখনোই লেসকে তাড়িয়ে বেড়াত না? লেস কি রবার্টের মতো সফল হতে চাইত না? বিষয়টি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস-এর কলামিস্ট ক্রেসিডা লেইসন বলেন, ‘লেস রবার্টের পুলিৎজার পাওয়ার ঘটনাটি মনে করতে করতে বলে ওঠে, “পিউলিটস্যার” উচ্চারণটি সে কখনোই সঠিকভাবে করতে পারেনি। তখন রবার্ট মজা করে বলে, এটি হবে “পুল-ইট-স্যার”। লেসের এই স্বীকারোক্তি বলে দেয় পুরস্কার সম্পর্কে তার উদাসীনতার কথা।’

এ নিয়ে এই উপন্যাসের লেখক গ্রিরও কিছু কথা আছে, ‘ভালো লেখার সঙ্গে পুরস্কারের কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু তারপরও ভালো লেখকেরাই পুরস্কার সবচেয়ে বেশি চায়। রবার্টও তেমনটি চেয়েছিল। অন্যদিকে জগৎ-সংসার, এমনকি পুরস্কার নিয়ে লেসের উদাসীন ভাবটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে। এ জন্য উপন্যাসটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কীর্তি-কলাপ অতিমাত্রায় ‘ফানি’ বা মজাদার করতে চেয়েছি আমি।’

এবার দেখা যাক, এই উপন্যাস নিয়ে সমালোচকেরা কে কী বলেছেন। দ্য নিউ ইয়র্কার-এ একজন সমালোচক বলেন, ‘যেভাবে অ্যান্ড্রু সি গ্রুর আর্থার লেসের মতো একজন মধ্যম মানের লেখকের বিষাদময়তা বিদ্রূপাত্মক শব্দাবলির মাধ্যমে তুলে ধরেছেন তা অভাবনীয়।’ ওয়াশিংটন পোস্ট-এর পর্যালোচক ডেভিড স্টারকি জানান, ‘এই উপন্যাসে সি গ্রির রূপক ও ঠমক ব্যবহারের ক্ষমতা মুগ্ধকর। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, যেভাবে ঔপন্যাসিক লেসের শার্ট-প্যান্ট ও জুতার রঙের সঙ্গে তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে রূপকায়িত করেছেন, নিঃসন্দেহে তা অসামান্য।’

তবে অ্যান্ড্রু সিন গ্রির এই উপন্যাসটি নিয়ে কোনো কোনো সমালোচকের আছে ভিন্নমত। তাঁদের মতে, ‘এটি পুরস্কার পাওয়ার মতো কোনো উপন্যাস নয়। কারণ এতে আবেগময়তা বেশি।’ দ্য গার্ডিয়ান-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এটি ভালো উপন্যাস, কিন্তু পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলতে সময় লাগবে।’

কথা হলো, এসব কথাই পুলিৎজার জেতার আগের সময়ের। আর এখন বাস্তবতা এই যে, আপনি চান বা না চান, লেস এ বছরের পুলিৎজারপ্রাপ্ত উপন্যাস, যা একজন লেখকের অনিশ্চিত জীবনের গল্প বলে।

অ্যান্ড্রু সিন গ্রির

ঔপন্যাসিক অ্যান্ড্রু সিন গ্রিরর জন্ম ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৭ সালে প্রকাশিত লেস উপন্যাসের জন্য ফিকশন বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার-২০১৮ জিতেছেন তিনি। তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস দ্য পাথ অব মাইনর প্ল্যানেটস প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। অ্যান্ড্রুর সবচেয়ে সাড়া জাগানো উপন্যাস দ্য কনফেশানস অব ম্যাক্স টিভিলি বের হয় ২০০৪ সালে। তবে তাঁর তৃতীয় উপন্যাস দ্য স্টোরি অব অ্যা ম্যারেজই পাঠকমনে বেশি দাগ কেটেছে—এমন মত সমালোচকদের। অ্যান্ড্রুর লেখায় বিশ শতকের খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক জেমস জয়েসের প্রভাব রয়েছে। সময়, স্থানিক সমস্যা, ভালোবাসা, হতাশা প্রভৃতি তাঁর লেখার মূল উপজীব্য। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পুলিৎজার ছাড়াও তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বুক অ্যাওয়ার্ড, ও হেনরি অ্যাওয়ার্ড এবং ফার্নান্দো পিভানো অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন।


ফ্র্যাঙ্ক বিডার্ট
ফ্র্যাঙ্ক বিডার্টের জন্ম ১৯৩৯ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৭৩ সালে গোল্ডেন স্টেট শিরোনামে ছাপা হয় তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন। দীর্ঘ কবি-জীবনজুড়ে প্রকাশিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দ্য স্যাক্রিফাইস (১৯৮৩), ইন দ্য ওয়েস্টার্ন নাইট (১৯৯০), ডিজায়ার (১৯৯৭), স্টার ডাস্ট (২০০৫) ও মেটাফিজিক্যাল ডগস (২০১৩)। গত বছর প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত লেখা তাঁর কবিতার সুবিশাল সংকলন—হাফ-লাইট। বইটি ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর পোয়েট্রি’ অর্জন করে। একই বইয়ের জন্য অতি সম্প্রতি, চলতি বছরের ১৬ এপ্রিল কবিতা বিভাগে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনি। বিডার্টের কবিতা মূলত নিরীক্ষাধর্মী। তাঁর কবিতার একটি বড় অংশজুড়ে আছে মানুষের মনোজগতের অন্ধকার। এখানে অনূদিত কবিতাগুলো হাফ-লাইট সংকলন থেকে নেওয়া হয়েছে।

ফ্র্যাঙ্ক বিডার্টের কবিতা
অনুবাদ: আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির


একই শব্দযুগল প্রতি চরণের শেষে

লজ্জায় আমাকে থেমে যেতে হলো, কারণ যে দরজা দিয়ে
আমি এসেছি, তার নাম—‘তোমার মৃত্যু’।

যাকে ছাড়া কোনো শব্দ লেখার কখনো
একরত্তি মূল্য নেই সে­—তোমার মৃত্যু।

তুমি এমন এক বিনাশ, মরণের পরেও তোমার
মাতাল বাহুজুড়ে থাকে নারী, তারপর—তোমার মৃত্যু।

ঘাসগুলো সব তোমার ক্ষুধায় কাতর
ওদের খাদ্য কেবল—তোমার মৃত্যু।

‘তোমার পিতার খুনিকে তুমি খুন কর’, আমাকে তোমার
জীবন এসে বলে গেল আগে, পরে—তোমার মৃত্যু

ক্ষুধার শরীর নিয়ে বড় হতে চাওয়া কষ্ট ভীষণ।
তোমার ক্ষুধাজুড়ে আজও কেবল-তোমার মৃত্যু


৭৪ বছরের চোখ

তোমাকে ছাড়াই কী সুন্দর ঘুরছে, দেখো, পৃথিবী!
মৃত্যুর নির্বাসনে তুমি, এই পৃথিবীকে তাই ছোঁয়ার সাধ্য নেই।
দেখতে পাওয়ার অদ্ভুত আনন্দে ডুবে আমার মনে হয়—

একটা কিছু হতে চাওয়ার নেশায় আমাদের গভীরে
ফুরিয়ে যাওয়া, ফেলে আসা কিছু একটা ভিড় করছে
আমাদের বাহিরজুড়ে জ্বলে আছে পৃথিবী—

সে নিজেকে নিজের ভেতর ডুবে থাকা সবকিছু
অবিরাম বুঝিয়ে চলেছে। জীবনকে ভালোবাসার
অন্য নাম—তোমার মতে—তোমার প্রতি যার অবহেলা—

তাকে ভালোবাসা। কী সুন্দর ঘুরছে, দেখো!
পৃথিবী কেবল পৃথিবী দেখেই নিজেকে চিনতে পারে।
অতি দ্রুত দখল করে সে তাই দূষণ করবে সমস্ত নক্ষত্র।

রক্তে-মাংসে গড়া এক অনুমান তুমি
আকাশভরা তারাদের শেখাবে না হয়ে ওঠার
প্রচণ্ড সম্ভাবনা ঘিরে জন্ম নেওয়া প্রচণ্ড সব ক্রোধ।

*
কখন যেন দরজায় কারও হাতের শব্দ শুনি।
জেগে উঠি। শব্দ
শব্দ। দুই বার
দারুণ স্পষ্ট শোনা যায়।

ঘুম ভেঙে জেগে উঠি। শুনতে যাই। কোথাও কোনো শব্দ নাই।