'দেখা থেকে লেখা' প্রসঙ্গে শবমেহের

 শুক্রবার ছুটির দিন। পত্রিকাগুলো সাহিত্য ও নানা আনন্দ-বিনোদনে সেজে ওঠে। প্রায় সব দৈনিকের সাহিত্য পাতায় চোখ বুলিয়ে প্রথম আলোর ‘শিল্পসাহিত্য’ পাতা খুলে আকর্ষিত হলাম। আগ্রহ জাগাল তিনজন প্রথিতযশা ঔপন্যাসিক-সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকারভিত্তিক নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে সাজানো পাতা ‘দেখা থেকে লেখা’ শিরোনামের লেখাগুলো। সাক্ষাৎকার যাঁরা নিয়েছেন এবং সাহিত্যিক যাঁরা বলেছেন, সবাইকে জানাই ধন্যবাদ। এ প্রসঙ্গে আরও কিছু কথা বলার প্রয়োজনে এই লেখা।

দেশভাগ বিষয়ে অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের গল্প-উপন্যাস আমাদের প্রিয় পাঠ্য। আমি জন্মেছি ভারতের হুগলি শহরে, বাবার কর্মস্থলে, ১৯৪৪ সালে। দেশভাগের পরে পূর্ববঙ্গে ফিরে আসা। বাবার-মায়ের সূত্রে দেশের বাড়ি কুমিল্লা আমার প্রিয় জন্মভূমি। কিন্তু যখন বড় হলাম, পড়েছিলাম ঢাকায় লীলা নাগ পরিচালিত ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ (১৯২৮ সালে, প্রতিষ্ঠাকালের নাম) স্কুলে। থাকতাম ওয়ারী পাড়ায়। তখন জানা শুরু হলো দেশভাগের ভয়াবহ দাঙ্গাবিধ্বস্ত পুরান ঢাকার এলাকাগুলোকে। দেশভাগের প্রত্যক্ষ আঘাতে লীলা নাগকে যেতে বাধ্য করা হলো ১৯৫০-এ। প্রখ্যাত ডাক্তার মন্মথনাথ নন্দীকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হলো ১৯৬৪ সালে।

গল্প-উপন্যাসে দেশভাগ এসেছে নানাভাবে। এই দেশভাগের কাহিনি হাসান আজিজুল হক লিখেছেন রাঢ় বঙ্গের আঞ্চলিক ভাষায়, তাঁর আগুনপাখি উপন্যাসে।

আবার দেশভাগের ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে তৈরি হওয়া ছিটমহলবাসীদের বন্দিজীবন নিয়ে লিখেছেন সেলিনা হোসেন। ২০ বছর ধরে রাখা তাঁর আকুলতা তিনি প্রকাশ করেছেন ভূমি ও কুসুম উপন্যাসে। চোখে দেখা মানুষদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখা তাঁর এই বইটি পড়ে আদতেই কান্না পায়।

 ‘দেখা থেকে লেখা’ পর্বের তৃতীয় বই ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস টোপ। এ বইটি কীভাবে লেখা হলো, সে কথা বলতে গিয়ে সাক্ষাৎকারে ইমদাদুল হক মিলন বলেছেন, ‘লেখার প্রয়োজনে টানবাজারে গিয়েছিলাম।’ ৭২ পৃষ্ঠার টোপ উপন্যাসে বিক্রমপুর অঞ্চলের ভাষার বহুল ব্যবহার প্রসঙ্গে তাঁর ভাষ্য, তাঁর নিজের বাড়ি বিক্রমপুর বলেই ভাষাটা তাঁর ভালো জানা।

বলে রাখা ভালো, ইমদাদুল হক মিলনের সাক্ষাৎকারটি আমার স্মৃতিকে দারুণভাবে উসকে দিল। আবার মনে পড়ল, শবমেহেরকে।

 ‘টানবাজার’ নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি এলাকা। দুঃখজাগানিয়া নির্যাতিত-নিহত শবমেহের নরসিংদীর একটি গ্রামের মেয়ে। ঘটনাকাল ১৯৮৫ সালের জানুয়ারি। আজ থেকে ৩৩ বছর পেছনের ৩৯৬ মাস, ১১, ৮৮০ দিন, ৪৩৫২০ ঘণ্টা; এবং সেই হিসাবের মিনিট ও সেকেন্ডের স্মৃতি তড়িতাহত করল আমাকে। হাসান আজিজুল হক ও সেলিনা হোসেনের লেখা বই দুটি পড়েছি, কিন্তু টোপ আমি পড়িনি। ইমদাদুল হক মিলন ভাইকে ফোন করে বাহক পাঠিয়ে বইটি বিকেলের মধ্যে সংগ্রহ করলাম। মিলন ভাইয়ের কাছ থেকে বইয়ের সহায়তা পেয়েছি আমার পিএইচডি করার সময়ে ১৯৯৫-২০০০-এর সময়পর্বে। তাঁর ব্যক্তিগত পাঠাগারের বই কয়েকটি বোধ হয় এখনো রয়ে গেছে আমার কাছে। এই ফাঁকে তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করে নিচ্ছি।

 ‘শবমেহের’ আমার এবং নারী আন্দোলনের সাথিদের স্মৃতিভান্ডারে বিদ্যুৎ জ্বেলে পথ দেখিয়েছে। শবমেহেরকে ইলেকট্রিক শক দিয়ে টানবাজারের অভিযুক্ত মালিক মমতাজ মিয়া এবং দালাল সর্দারনি সাজা দিয়েছিল, ‘পতিতা’বৃত্তিতে বাধ্য করতে চেয়েছিল। সেই বৈদ্যুতিক শক তখন কবি সুফিয়া কামালের সভানেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদিকা আমার ও অন্য নেতৃবৃন্দের, সদস্যদের মনে আগুন জ্বালিয়েছিল।

মনে পড়ছে সেদিনের তীব্র দহনের কথা।

মৃতপ্রায় শবমেহেরকে টানবাজারের বাইরে রাজপথে ফেলে রেখেছিল অপরাধীরা। জনৈক জনদরদি তাকে পথ থেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এসবই পড়েছিলাম দৈনিক পত্রিকায়। সে সময়ের প্রেসিডেন্ট এরশাদের সামরিক সরকারের নিষেধাজ্ঞায় নারীদের প্রতিবাদ সভা করা যায়নি। হাসপাতালে গিয়ে মৃতপ্রায় শবমেহেরের জন্য যা কিছু করা যায়, সংগঠন থেকে করা হলো। তার চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু তার সুস্থ হওয়ার কোনো আশ্বাসই পেলাম না ওই হাসপাতালে কর্মরত সে সময়ের প্রসূতিবিদ ডা. ফিরোজা বেগমের কাছ থেকে। তিনি সে সময় আমাদের নারী সংগঠনের সহসভানেত্রী ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শবমেহের মারা গেল। আত্মীয়হীন অসহায় নিহত মেয়েটিকে দেখতে পুরো হাসপাতালের রোগী-লোকজন দৌড়ে গিয়েছিলেন। অভাগিনী মা এসেছিলেন পরে। আমরা মহিলা সংগঠনের সদস্যরা সে সময়ের সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সমাবেশ অর্থাৎ মিলাদ মাহফিল করেছিলাম হাসপাতালের গেটের কাছে।

গরিব মা অক্ষম বলে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সাহায্যে শবমেহেরের দাফন হলো। আমরা চেষ্টা করেছিলাম বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের উদ্যোগে দাফনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু পুলিশ বাধা দিয়েছিল ‘রাজনৈতিক’ অজুহাত দেখিয়ে।

আমাদের নারী সংগঠন থেকে নারী নির্যাতনবিরোধী আইনি সহায়তায় টানবাজারের মালিক মমতাজ মিয়া ও দালাল সর্দারনিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলাম। নারায়ণগঞ্জ মহিলা পরিষদ শাখার সহায়তায় কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে এই মামলার জন্য সার্বিক কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মহিলা পরিষদের নেত্রী প্রয়াত বেলা নবী। দিনের পর দিন আদালতে গিয়েছেন তিনি। টানবাজারের পতিতালয়ের মালিক মমতাজ মিয়া অভিযুক্ত হলেও ছাড়া পেয়ে যান। ওই মামলায় অভিযুক্ত দালাল ও সর্দারনির জেল-সাজা হয়েছিল।

আজ বিতর্ক উঠেছে নারী আন্দোলনে, ‘পতিতা’ কেন বলব? এরা ‘যৌনকর্মী’। আজ আমরা মেনে নিয়েছি। ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি ‘দেহপসারিণী’, ‘পতিতা’ শব্দ থেকে বুঝিবা সম্মানজনক। যেন এরা শরীরে খেটে খাওয়া কর্মী বা শ্রমিক।

কিন্তু যে ‘খদ্দের’ নামের পুরুষেরা এবং দালালেরা (নারী-পুরুষ) এই মেয়েদের সুস্থ জীবনযাপনের পথ থেকে বিপথে নিয়ে আসছে, তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা সমাজ-রাষ্ট্র-আইন নিচ্ছে? কিছুই নিচ্ছে না।

এসব নিয়ে আমি লিখেছি নারী আন্দোলনের পাঁচ দশক বইটিতে (অন্যপ্রকাশ, ২০০২, পৃ. ১৪৩-১৫০)।

১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে শবমেহেরের মৃত্যুর পরদিন, তারিখটা মনে নেই, দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় রাহাত খান ভাই রসালো একটি লেখা লিখেছিলেন, আমি পরের দিন প্রতিবাদ জানিয়ে একটি প্রতিক্রয়া লিখেছিলাম। সে সময় উত্তাল আন্দোলন হয়েছিল কাগজে-কলমে। রাজপথে পারা যায়নি।

ইমদাদুল হক মিলন ভাইকে ধন্যবাদ। উপন্যাসসুলভ আকর্ষণীয় রস-সম্পৃক্ত বই হলেও টোপ উপন্যাসে শবমেহেরের কথা বলেছেন বলে। লেখক এই উপন্যাসে শবমেহেরের নাম দিয়েছেন ‘পারুল’। ‘পারুল’ নামের মেয়েটি কি নতুন সংস্করণে—যখন নতুন করে সংস্করণ করা হবে—শবমেহের নামে পরিচিতি পাবে? তাকে নিয়েই কি উপন্যাসটি শুরু করা যায়? দালালেরা (শুধু নারী নয়, পুরুষও) কম প্রাধান্য পেতে পারে কি? ওরা কি সমাজ-পাঠকের ঘৃণা পেতে পারে উপন্যাসে?

পুনশ্চ: সুসাহিত্যিক রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর (১৯৭৭)নামে একটি উপন্যাস আছে। পতিতাদের জীবন নিয়ে লেখা এ উপন্যাস প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন, উপন্যাসটি প্রকাশের পর বহু পুরুষ কণ্ঠ তাঁকে দিন-রাত উত্ত্যক্ত করেছেন। তাঁরা জানতে চেয়েছেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় রচিত কি না বইটি? ভাবছি, কোনো পুরুষ লেখককে কি এমন প্রশ্ন শুনতে হয়?