উষ্ণমণ্ডলীয় প্রজাপতির গপ্পো

জন মারে, আ ফিউ শর্ট নোট্স অন ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাইজ-এর প্রচ্ছদ
জন মারে, আ ফিউ শর্ট নোট্স অন ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাইজ-এর প্রচ্ছদ

মাত্র একটি গল্পসংকলন দিয়ে বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠার ঘটনা ভূরি ভূরি না হলেও বিরল নয়। অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ির পর পুলিৎজার বা মানবুকারের ঢাকঢোল ছাড়াই ইংরেজি ভাষায় শর্ট ফিকশন রচয়িতাদের তালিকায় পেশায় আপাদমস্তক চিকিৎসক জন মারে অনিবার্যভাবে উল্লেখ্য।

আ ফিউ শর্ট নোট্স অন ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাইজ নামে তাঁর গল্পগ্রন্থটি প্রকাশ করে হারপার কলিন্স ২০০৩ সালে। মোট আটটি গল্প। পরিসরে সব কটিই দীর্ঘ—তিরিশ, চল্লিশ পৃষ্ঠাব্যাপী; একটি আবার ছোট গল্পের ছোটত্বকে ছাড়িয়ে-মাড়িয়ে দীর্ঘ প্রায় সত্তর পৃষ্ঠাব্যাপী, তারপরও সেটি গল্পই, নভেলা বা প্রায়োপন্যাসজাতীয় কিছু নয়। শুরুর গল্প ‘হিলস্টেশন’ কথনভঙ্গির চমক সত্ত্বেও যথেষ্ট গতানুগতিক। তবে পরপরই কৌতূহলী পাঠক লক্ষ না করে পারেন না, লেখকের ভাষারীতি, উপস্থাপনা কৌশল গল্প থেকে গল্পে বদলে যাচ্ছে। চিন্তার বিন্যাস বা ইচ্ছাকৃত ‘অবিন্যাস’ পাঠকের সামনে নানা দরজা মেলে ধরছে। কোথাও মনে হচ্ছে অনেকখানি খোলা, কোথাও আধখোলা, কোথাও বোঝার উপায় নেই আদৌ কতটা খোলা, কতটা আটকানো।

এ সত্ত্বেও জন মারে প্রথানুরাগী লেখক। প্রথাসিদ্ধ লেখালেখির ধাঁচ বা আনুষ্ঠানিকতা তছনছ করে বেরোনোর সচেতন কোনো তাগিদ তার লেখায় নেই। তবে ইশারা আছে—কোথাও কোথাও বেশ প্রবল, পাঠককে যা বিভ্রমে ফেলে।

শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত আখ্যানরীতির চৌহদ্দিতে বাস করেও ব্যতিক্রমী তিনি নানা করণে। প্রথম কারণটি অবধারিতভাবে তাঁর গদ্য। ভাষাকে আখ্যানের খোলস হিসেবে বিবেচনা করেও ভিন্ন ভিন্ন নির্যাসে শব্দ ও বাক-প্রতিমার প্রয়োগে তাঁর গল্প ভাবনা একধরনের স্বাধীনতার স্বাদ পায়। দ্বিতীয়ত, বাস্তব ও কল্পবাস্তব, মনস্তত্ত্ব ও বিজ্ঞান নিয়ে কৌতূহলী অন্বেষণ তাঁর গল্পে এক বিচিত্র বহুস্বর সম্ভাবনাকে খুঁচিয়ে তোলে, কিন্তু উদ্‌ঘটিত করে না, প্রচ্ছন্ন রাখে এবং কখনোই সমাপ্তি ঘোষণা করে না।

জন মারেকে নিয়ে কিছুটা সমস্যা এখানেই। এই যে তিনি সম্ভাবনাকে প্রচ্ছন্ন ও অনুদ্‌ঘাটিত রাখেন, তাকে এক অর্থে বলা চলে নন্দনতত্ত্বের প্রথাসিদ্ধ কৌশলের সফল প্রয়োগ; অন্য অর্থে প্রচ্ছন্নতাকে ভর করে তার যে ইতি টানায়, সমাপ্তি ঘোষণায় প্রবল আপত্তি তা প্রবণতার দিক থেকে অনেকটাই উত্তর আধুনিক। সমস্যা এ জন্য যে এখানে একধরনের টানাপোড়েন লক্ষণীয় এবং তা তাঁর পাঠবিচারে।

 জন মারে ডিকন্সট্রাকশন (বিনির্মাণ) নিয়ে ভেবেছেন, তাঁর গল্পপাঠ সে কথা বলে না। গল্প পড়তে পড়তে পাঠক প্ররোচনা বোধ করেন, কখনো কখনো ঝামেলায় পড়েন তাঁকে কোথায় স্থান দেবেন। তবে পাঠক ধৈর্যশীল হলে খেয়াল না করে পারবেন না যে গতানুগতিক ঢঙে মারের গল্প বলার কায়দাটা যেন একটা আড়াল, ছদ্মাবরণ, এমনকি ঢাল, যার ভাঁজে-ভাঁজে রয়েছে কল্পবাস্তবের নানা বিচিত্র অনুষঙ্গ, যা প্রাত্যহিক নাঙ্গা বাস্তবের সঙ্গে সহাবস্থান করছে, আবার সংঘর্ষেও লিপ্ত হচ্ছে। এ হচ্ছে মারের জাদুবাস্তবতা। এখানে নাটকীয়তা কম, রয়েছে কিছুটা টেনে টেনে বিলম্বিত লয়ে আখ্যানের নানামুখী প্রক্ষেপ ও বিস্তার—পরস্পরাময়, আবার পরস্পরাহীন।

 গল্পগ্রন্থের নাম-গল্প ‘আ ফিউ শর্ট নোটস অন ট্রপিক্যাল বাটারফ্লাইজ’ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। এক পরিবারের তিন প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে বা কোনো নিগূঢ় রহস্যময় কারণে এক বিশেষ ধরনের প্রজাপতি দ্বারা আচ্ছন্ন। সাধারণের কাছে মনার্ক বাটারফ্লাই নামে পরিচিত এ প্রজাপতির বৈজ্ঞানিক নাম ডানায়ুস প্লেক্সিপ্পাস। প্রথম প্রজন্মের বৃদ্ধ নিজের গোটা জীবন কাটিয়েছেন মানার্ক প্রজাপতি সংগ্রহে। সংগ্রহ অভিযানে দূরদূরান্তে দিনের পর দিন কাটিয়ে তাঁর মাঝে মাঝে মনে হতো, ডারউইন অন্তত একটা জায়গায় ভ্রান্ত ছিলেন। প্রজাপতির পাখার রঙের যে অপার বর্ণাঢ্য বাহার, তা তাদের বেঁচে থাকার প্রয়োজনের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, অপ্রয়োজনীয়, এমনকি বাড়াবাড়ি। ডারউইন নিশ্চয়ই ভুল করেছিলেন সব প্রাণীকুলের ক্ষেত্রে অভিন্ন সূত্র প্রয়োগ করে। তার এ-ও মনে হতো, প্রজাপতির আয়ু মাত্র চার সপ্তাহ, সংক্ষিপ্ত এই আয়ুষ্কালের প্রেক্ষাপটে প্রজাপতির পাখার বর্ণময়তা নিছকই আর্ট ফর আর্টস সেক। জীবনের একপর্যায়ে বৃদ্ধ যখন উপলব্ধি করলেন, তিনি আর কর্মক্ষম নন, বিশেষ করে প্রজাপতি সংগ্রহে, তখনই ধারালো ছেনির মোক্ষম কোপে নিজের বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলটি গোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললেন। ফরমালিনে ডুবন্ত ছোট কাচের জারবন্দী আঙুলটি পারিবারিক লোকগাথায় পরিণত হয়ে বিচিত্র প্রভাব বিস্তার করে চলে বৃদ্ধের পরবর্তী বংশধরদের জীবনে—তাঁর ছেলের এবং ছেলের সন্তানের, অর্থাৎ কথকের জীবনে। আঙুল ছেদের পর আত্মবিনাশপ্রবণ বৃদ্ধ যখন গালয় ফাঁস আটকে আত্মহত্যা করেন, তখন তাঁর ঝুলন্ত আপাদমস্তক শরীর ঢাকা পড়ে গিয়েছিল সাদা-কালো বর্ণচ্ছটাময় ভাইসরয় প্রজাপতিতে।

এত দূর পর্যন্ত যা পাওয়া গেল, তাকে একটা ঢিলেঢালা স্টোরিলাইন বলা যায়, কিন্তু এর ভেতরে রয়েছে বৃদ্ধের ছেলে ও তাঁর ছেলের জীবনের নানা খণ্ডাংশ। প্রজাপতির একটা যোগসূত্র রয়েছে তাঁদের জীবনে, আবার প্রজাপতিতে আচ্ছন্ন হওয়ার মতো স্বপ্নময় রোমান্টিকতার বিপরীতে রয়েছে উদোম বাস্তবের গোলমেলে পদচারণা। গল্পে রয়েছে তৃতীয় প্রজন্ম, অর্থাৎ কথকের ব্যক্তিগত জীবন এবং তার চিকিৎসক পেশার টুকরো টুকরো অনুষঙ্গ, রয়েছে ব্রেন-সার্জারির খুঁটিনাটি, মাথার খুলি কাটার চকিত বর্ণনা, ল্যাবরেটরির কাচের সারি সারি জারে সংরক্ষিত মানুষের তাজা-টাটকা ফুসফুস ও যকৃৎ পরিবেষ্টিত নিরিবিলি স্থানে নিরুদ্বেগ দেহমিলন।

জীবনে কোনো কিছুই স্বয়ম্ভূ নয়, আবার যোগসূত্রময় বলে সরলীকরণের অবকাশও নেই—এ-ই হয়তো বলতে চান লেখক। গল্পের শেষে কথক যখন উন্মুক্ত বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের অতীতকে দেখতে পায় পিছলে যাচ্ছে—দূরে, আয়ত্তের বাইরে—তখন পাঠক একটা জুতসই শ্রেণিকক্ষের ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইলে বলতে পারেন: জীবন অনিত্য, হাজারো বর্ণিল আলোকছটা সত্ত্বেও প্রজাপতিদেরই মতো। সেই সঙ্গে প্রতিতুলনার রেশ ধরে এ-ও কি বলা যায়, প্রজাপতিদের ক্ষেত্রে যেমন, মানুষের ক্ষেত্রেও টিকে থাকার (সারভাইভাল) জন্য শারীরিক-মানসিক সুবিধাদি ছাড়া অদৃশ্য বা প্রকাশ্য বৈভবমণ্ডিত অনেক কিছুই সংগতিহীন, অপ্রয়োজনীয়, বাড়াবাড়ি? পাঠক মনের মাধুরী মিশিয়ে এসব ভাবতেই পারেন, বাধা নেই। এখানেই আখ্যানকারের মুক্তি, পাঠকেরও স্বাধীনতা।

গল্পে বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মারের মূল পর্যবেক্ষণ মানুষকে নিয়ে। সাধারণ, পরিশ্রমী মানুষ—তাদের ব্যক্তিগত নিভৃত জগৎ এবং পরিপার্শ্বের সঙ্গে সেই জগতের সম্পর্ক, মিল-অমিল, দ্বন্দ্ব। কাজটা তিনি করেন ধীরলয়ে গল্প ফেঁদে, একটা গল্পের ভেতর আরেকটা গল্প গুঁজে অনাড়ম্বর নিস্পৃহতায়। তাঁর গল্পে সহজেই একটা দার্শনিক ভিত দাঁড়িয়ে যায়, যা মনে হতে পারে কিছুটা নিচু কথাভঙ্গির কারণে, কিংবা বিস্তর গল্পকথার ডালপালা ছড়িয়েও আখ্যানকে কোনো নির্দিষ্ট গন্তব্যে ঠেলে না দেওয়ার প্রবণতার কারণে। গ্রন্থভুক্ত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গল্পের মধ্যে রয়েছে ‘অল দ্য রিভার্স অব দ্য ওয়ার্ল্ড’, ‘ওয়াটসন অ্যান্ড দ্য শার্ক’, ‘ব্লু’, ‘অ্যাক্টস অব মেমোরিÑউইজডম অব ম্যান’।

গল্প বলায় মারেকে যা তাঁর সমসাময়িক লেখকদের থেকে পরিষ্কার তফাতে রাখে, তা তাঁর অবিশ্বাস্য অনুচ্চ কণ্ঠ। প্রবল নাটকীয় পরিস্থিতিকে নিচু, ঠান্ডা চোখে শুধু দেখাই নয়, দেখতে দেখতে পেঁয়াজের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে এক দিকচিহ্নহীন প্রান্তরে পাঠককে ছেড়ে দিয়ে চোখের পলক ফেলেন—পড়তে পড়তে এমনই মনে হয়।

মারে যে বিষয়টা সম্ভবত সচেতনভাবে পরিহার করে চলেন, তা প্রথাসিদ্ধ রচনার আঁটো বাঁধুনি বা কম্প্যাক্টনেস। পাঠককে তিনি আটকে রাখেন তাঁর বর্ণনাভঙ্গিতে, যা একই সঙ্গে নিস্পৃহ, প্রায়-উদাস ও প্রবল প্রাণসঞ্চারক। ভঙ্গিটা অনেকটাই তাঁর নিজস্ব, আখ্যানকে যা বহুমুখী করতে সহায়তা করে, এমনকি কখনো কখনো সর্বত্রমুখী করতেও—কোনো কোনো সম্ভাবনাই যেখানে নাকচ হয়ে যায় না, জীবনে যেমন।