বহিঃরূপের ভেতরে অন্তর্দর্শনের খোঁজ

‘মূক অবস্থা’, শিল্পী: কামালুদ্দিন
‘মূক অবস্থা’, শিল্পী: কামালুদ্দিন

লুডুর ঘুঁটিটা স্থির হয়ে আছে মকমল কাপড়যুক্ত চেয়ারের ওপর। দান ছক্কা। জুয়া খেলার দৃশ্য নয় এটি। এটি হলো ক্ষমতার সিংহাসন দখলের সাংকেতিক রূপ। শিল্পনৈপুণ্যে খোদাইকৃত কাঠের চেয়ার, বসার ঝলমল কাপড়াবৃত গদি বাস্তবানুগ ধারায় অঙ্কিত হওয়ার কারণে ছবিটিকে আলোকচিত্র বলে ভ্রম হয়। আদতে এটি কামালুদ্দিনের তৈলচিত্র। এই ছবির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব ধরনের ক্ষমতা, ক্ষমতার খেলা, ক্ষমতা পাওয়ার ভাগ্য, না পাওয়ার উদ্বিগ্নতা—এসবের চিত্র পাওয়া যায়। কামাল বস্তুর বাস্তবানুগ বহিঃদৃশ্যের ভেতর দিয়ে এক গাণিতিক হিসাব কষতে চান। আর ওই হিসাবের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে তাঁর ছবির বিষয়-ভাবনা। তাঁর চিত্রচর্চায় দেখেছি ‘পেইন অব সোসাইটি’ বা ‘সামাজিক ব্যাধি’ শীর্ষক সিরিজচিত্র, যেখানে মানুষের সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ করা অর্থাৎ ব্যথানাশক পট্টি লাগানো। এখানে সমাজের অবহেলিত শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধের সাধ ও স্বপ্ন অপূরণের কষ্টকে বহিরাবরণে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী। তারই ধারাবাহিকতায় গ্যালারি কায়ায় ‘অন্তর্দৃষ্টি’ শিরোনামে এই শিল্পীর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়ে গেল ২০ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত।

প্রদর্শিত চিত্রকর্মে একাধিক জ্যামিতিক তল ও রেখার ব্যবহার লক্ষণীয়। এসব জ্যামিতিক তল ব্যক্তি মানুষের অনুভূতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের নিরিখে দেখতে সহায়তা করে। ফলে শিল্পী প্রদত্ত চিত্র-শিরোনামের পথ ধরে চিত্রগল্পের সন্ধান পেতে সহজ হবে। অন্যথায় নীরস আলোকচিত্র বলে মনে হতে পারে। কারণ চিত্রে রং, রেখা, টেক্সচারে স্বাধীন চলন না থাকায় নিজস্ব ভাবনায় অবগাহন করা একটু অসুবিধা হতে পারে।

‘অন্তরায়’ সিরিজচিত্রে দেখা যায়, শিশুর মুখ ঢেকে আছে ব্যাগে। বাইরে খোলা আকাশে উড্ডীয়মান শান্তির কপোত। শিশুর দৃষ্টি সেখানে পৌঁছায় না। ‘অন্তর্দৃষ্টি’ সিরিজচিত্রের একটিতে কিশোরের মাথা এক কাগজের কবুতর, আবার বাইরের শূন্য তলে জীবন্ত কবুতর। ‘অপ্রত্যাশিত’ চিত্রে বৃদ্ধের সাধ আর স্বপ্নের বাস্তবতা সংকেতে দেখিয়েছেন শিল্পী। অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করলে বোঝা যাবে চিত্রে ব্যবহৃত ফুলদানির ফুল যেমন ঝড়ে পড়ে, তেমনি বৃদ্ধের স্বপ্নও বাস্তবায়িত হবে না। বার্ধক্যের জীর্ণতার সঙ্গেও তুলনা করে দেখা যেতে পারে এই চিত্রটি। এভাবে কামালুদ্দিন চিত্রজমিনে বাস্তবানুগ ভঙ্গিতে অঙ্কিত মানুষ ও বিভিন্ন বস্তু উপাদানে অর্থবহ গল্প তৈরি করেছেন।
‘মূক অবস্থা’ ছবির ওপরের তলে নিজ হাতে মুখ বন্ধ করে আছে এক কিশোরী। সামনে মাউথ স্পিকার। শেষের অংশে কোনো এক শ্রমিকের কষ্টক্লান্ত দৃষ্টি। বোঝা যাচ্ছে তাদের অব্যক্ত ব্যথা কারও কাছেই বলার নেই। এমন অনেক ছবিই বুঝে নেওয়া যাবে শিরোনামের সূত্র ধরে।

এ ছাড়া পানপাত্র, ভাত রাঁধার হাঁড়ি, ঘণ্টা, শিশুর খেলনা গাড়ি প্রভৃতি চিত্র স্টাডি হিসেবে বিবেচনা করাই ভালো। বিষয়ের নেপথ্যে অন্য অন্তর্দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ থাকলেও ছবিগুলো একান্তই জলরং ও তেলরং মাধ্যমের বাস্তবানুগ করণকৌশল দেখানোতে মনোযোগ লক্ষণীয়।
প্রায় প্রতিটি ছবিতেই মানুষের শরীর ছাই রঙে অর্থাৎ বিবর্ণ করে আঁকা। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের সাদামাটা, রংহীন, স্বপ্নহীন জীবন যন্ত্রণার উপাখ্যান বর্ণ ও বস্তুর গাণিতিক হিসাবে দেখিয়েছেন শিল্পী। অনেক ছবিতে জ্যামিতিক রেখা ও তল প্রাসঙ্গিক মনে হয়নি। এই ফটোগ্রাফিক চিত্র ভাষা ও জ্যামিতিক তল থেকে শিল্পীনির্দেশিত গাণিতিক সূত্র ধরে দর্শক শিল্পরস আস্বাদনে কতটুকু সমর্থ ও তৃপ্ত হতে পারছেন, সে বিচার সময়সাপেক্ষ।