দীর্ঘ কবিতার বন্দরে

>

দীর্ঘ কবিতা বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বল ঐতিহ্য। আধুনিক কবিরা দীর্ঘ কবিতায় লেখেন তাঁদের নিজের আখ্যান এবং জীবনবোধের কাব্যভাষ্য।
দীর্ঘ কবিতার বন্দরে আজ দাঁড়িয়েছেন বরেণ্য দুই কবি মোহাম্মদ রফিক ও নির্মলেন্দু গুণ

মোহাম্মদ রফিক জন্ম: ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩
মোহাম্মদ রফিক জন্ম: ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩

মোহাম্মদ রফিক
সুন্দরী জলগাথা

এক চন্দ্রবোড়া শরীর গুটিয়ে
নিল দীর্ঘ সেগুনগজারি
পাতা ছুঁয়ে-ছেনে রাত্রি শেষ,
ভোর ভোর শ্যাওলাসবুজের
পিছল মায়াবী সোঁদাঘ্রাণ
লেগে আছে পুঁইয়ের মাচায়
সারা রাত জোনেকি-আলোক
আতপ্ত নিশ্বাস-দ্বার খুলে
গড়াগড়ি যায় আঙিনায়
মধুকর ক্ষুধায় কাতর
ফুল থেকে ফুলে-বনফুলে
কী আনন্দে কী স্বপ্নযাত্রায়
দু-ঊরুর ফাঁকে নোনাঘাস
শিশিরের ঘামে-স্বেদে ভেজা
ছপছপ, চলো যাই খালে
বনে চাই বনজ শরীর,
গৃহে হৃষ্টপুষ্ট গাইগরু
বিয়োবে প্রতি সনে, চলো

ডিঙি নাও হোগলার ঝোপে
ভাঙাচোরা ঘুণে খাওয়া তা-ও
উজানেও নারী কাম দেয়;

দুই.
বদর বদর হাঁক দাও
সত্যপির, তাঁর নাম লও

মেঘপানি দেখে দাঁড় বাও
এ তো নাও, দেহখানি নয়

নদী, দুই পাড়জুড়ে ওই
ভাঙন ভাঙন শব্দ বাজে

জোয়ারের জোয়ারি মাতম
ভাটির টানটাও কম নয়

জোয়ারভাটার লীলারঙ্গ
প্রাণ যায় যায় রে শিরির

হায়, বইঠার ঘায়ে ঘায়ে
রক্তে জেগে ওঠে শিহরণ

তখন স্রোতের তালে তালে
হাড়-মাংস খুবলে পড়ে ঢেউয়ে

সুন্দরীর ডাল থেকে ডালে
বানর-বানরী চুমু খায়

সহবাসে দুলে ওঠে বন
বাঘ-বাঘিনীর শিশিৎকারে

হেতল সোহাগী বনকেওড়া
জড়ায়-জড়িয়ে দোল খায়

দখিনা বাতাসে উড়ো ছায়া
ওরে মাঝি ধীরে দাঁড় বাও

নদী প্রতারক কুয়াশার
অঙ্গের লাবণী ধু ধু জল

সোনা রংবন্ধুরে আমার
কে গায়, কোথায়, পারাবার

স্তব্ধ শ্বাস হায় অকালেই,
জলেতেই নাহয় ভাসান

মরণের খাত বেয়ে বলো
কী করে বা দেখাই স্বপন

ভরা দরিয়ার ভরা যৌবনের
কলসি কাঁখে হেঁটে চলি ওই

রূপ যেন আদি অলৌকিক
ঢেউ ভাঙে দেহে বাঁকে-বাঁকে

দুই বাঁক ঘুরে গেলে পর
সাগর উথাল ডাকে আয়,

ঢেউ ঢেউ জলবিন্দু জ্বলে
নিস্তব্ধ ধরণি নীলিমায়;

তিন.
কচা-পসুরের তীব্রতপ্ত
মিলনমোহনা ছুঁয়ে
ওই পাড়ে
কোনো এক গাঁয়ের গভীর
এক গাঁয়ে তরল কামোজ
সেগুনসুন্দরী ঢাকা অন্ধকারে একা টেমি
একবিংশ শতাব্দীর
দ্বার খুলে উত্তুরে হাওয়ায়
মরে আসা জলজোছনায়
বয়ান করেছে কোনো এক
মহুয়াকুণ্ডলা
লোককাহনির রূপকথা
কে বা জানে কে বা শোনে

ধীরে ধীরে
হিম ঝরে কলাপাতা ছুঁয়ে
চাঁদ ডুবে গেলে পর

ভুতুম ভুতুমি বুনে চলে
বকবকবক
কথার পাঁচালি
সূর্যমুখ ছেয়ে

নির্মলেন্দু গুণ জন্ম: ২১ জুন, ১৯৪৫
নির্মলেন্দু গুণ জন্ম: ২১ জুন, ১৯৪৫

নির্মলেন্দু গুণ
সূর্য সত্য, চন্দ্র সত্য, সত্য নববর্ষ

আমার কবিতায় বহুরূপে বহুবার সূর্যের প্রসঙ্গ এসেছে।
তার মানে এই নয় যে, আমি খুব সূর্যপ্রেমিক বা আমি সূর্যকে খুব ভালোবাসি।

তুলনামূলকভাবে সূর্যের চেয়ে চাঁদই বরং আমাকে আনন্দ দিয়েছে বেশি।
আমার কবিতায়, আমার গানের মধ্যে আমি সূর্যের চেয়ে চাঁদের কথাই বেশি বলেছি।
‘ও আমি রাগ করেছি চাঁদের সাথে,
মুখখানি সে দেয়নি ছুঁতে আমার হাতে।’

বিশেষত পূর্ণিমার চাঁদ আমার খুব প্রিয়।
এই বয়সেও আকাশ উন্মাদ করা চাঁদের নগ্ন স্নিগ্ধরূপ আমি লুকিয়ে-লুকিয়ে দেখি।

একদিন গভীর রাতে, বিশ্ব যখন নিদ্রামগন, গগন মেঘে ভরা, তখন চাঁদ আমাকে, সবার সামনে বলা যায় না এমন একটা ইঙ্গিত দিয়েছে।
আমি তার ইঙ্গিতের প্রতি আস্থা স্থাপন করে চন্দ্রপৃষ্ঠে
একটি ছোট্ট বাংলোবাড়ি তৈরি করেছি।

আমার মৃত্যু হলে, যদি কখনো হয়, হতেও তো পারে।
মৃত্যু কি কখনো কোনো জীবনকে ছাড়ে?
তখন আমি কোথায় যাব?
ভাগ্যিস চাঁদ নামমাত্র মূল্যে তার আট শতাংশ জমি আমাকে লিজ দিয়েছিল।
তা না হলে ও রকম পশ এলাকায় আমার কবিতাকুঞ্জ গড়া কখনো সম্ভব হতো না।
আমি জানি, সূর্যের চেয়ে চাঁদের ক্লাইমেটই আমার স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী হবে।

তবে আপনারা ভুল বুঝবেন না আমাকে।
আমি সূর্যকেও ভালোবাসি, কম আর বেশি।
তার তেজ খুব বেশি হলেও
তার প্রতি আস্থা আমার কম নয় মোটেও।
আমি জানি, আমি তাকে খুব প্রেমচোখে না দেখলেও
তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা অবিচল।

আমি জানি, মেঘে-ঝড়ে বা ঘন কুয়াশায় যদি ঢেকে যায়
এই সৌরজগৎ, তারপরও সূর্য উঠবেই।
তার তো অমাবস্যার ছুটি নেই, নেই পূর্ণিমার চাঁদের মতো মাসিক-উল্লাস।
কক্ষপথে ধাবমান চঞ্চল চন্দ্রের মতো সে নয়।
মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিওর মতোই সে আপন অবস্থানে
এবং আপন বিশ্বাসে স্থির, দীপ্যমান।

আমি বিশ্বাস করি, যত দিন আকাশ আছে—
যত দিন চাঁদ আছে আকাশে—যত দিন রবে পদ্মা-মেঘনা, গৌরী-গঙ্গা বহমান,
তত দিন রবে আকাশে সূর্য, মাটিতে শেখ মুজিবুর রহমান।

আর আমি? আমার গন্তব্যের কথা তো আমি আগেই বলেছি।
আমি চলে যাব চাঁদের নদীর তীরে তৈরি করা আমার কবিতাকুঞ্জে।
সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কবিতার মতো এক চন্দ্রমুখী নারী।

আমি বিশ্বাস করি, মহাকাশে যত বিপর্যয়ই ঘটুক না কেন
কাল সকালে পুবের আকাশে সূর্য উঠবেই এবং
বাঙালি সাড়ম্বরে পালন করবেই তাদের প্রিয় নববর্ষ।

আমি তাকে উঠতেও দেখি না, ডুবতেও দেখি না বহুদিন।
তবু আমি সর্বপাপঘ্ন সূর্যকে বিশ্বাস করি এবং তাকে
মহাবিশ্বের সকল শক্তির অনন্য উৎস বলে মানি।