মৃণালের ছবিতে সমতার ধারণা

‘রূপ অরূপ অপরূপ’, শিল্পী:  কাজী মৃণাল
‘রূপ অরূপ অপরূপ’, শিল্পী: কাজী মৃণাল

দৃষ্টির সমতা সামাজিক সাম্যের পূর্বশর্ত কি না, সে বিষয়ে সুরাহা ছাড়াই নৈতিকতায় বিশ্বাসী শিল্পী বা কবি এর পক্ষে দাঁড়ান। চোখ বা চাহনি দুই ভাগে ভাগ করা যায়—এক চোখে মানুষ যদি ‘আপন’ বা ‘স্বকীয়া’ দৃষ্টি খোলে, অপর চোখে ‘পরকীয়া’ দৃষ্টি। কাজী মৃণাল, যাঁর ছবিতে মানব-মানবী, শিশু, গাছপালা ও পাখি এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হয়—আপন হতে পরগামী হয়েছেন। তিনি পরকীয়া ভাব ও ভক্তির শিল্পী হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন। যা তিনি আঁকেন, সেই সব বিষয়ের দিকে তিনি সমান দৃষ্টিতে তাকান, ভক্তিভরে দেখেন ও দর্শক সমীপে তুলে ধরেন, তাঁর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে এমন বোধ হয়।
শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে শিল্পীর ‘রূপ অরূপ অপরূপ’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে নারী-পুরুষ-শিশু-গাছ-পাখির যৌথতার আখ্যান দৃষ্টিগোচর হয়। সমাজতত্ত্বের নিরিখে এই পরকীয়া দৃষ্টির ব্যাখ্যা করা যাবে না। কারণ যে কামনা এখানে দৃশ্যমান, তা অপরের সূত্রে জন্ম নিয়েছে। এমন অপরের ধারণা ধর্মতত্ত্বে বিরল নয়। মৃণাল ধার্মিক নন, তবে তাঁর দৃষ্টিতে ধার্মিকতা স্পষ্ট। খণ্ডতার মধ্যে তিনি সমগ্রতা আবিষ্কার করতে চান। নর ও নারী কিংবা শিশু ও বয়স্ক কিংবা প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হয় সমাজের সূত্রে, তা নাকচ করে তিনি সমতার গল্প বলেন।
এই শিল্পীর আখ্যানে একধরনের নিরপেক্ষ প্রেম বা আস্থা হাজির থাকে। দৃশ্য এখানে ‘অনুমান’, অর্থাৎ অদৃশ্য শক্তি এবং ‘বর্তমান’—এ দুইয়ের সমঝোতায় তৈরি। এ কারণে গাছপালা, পাখি, অন্ধকার, নর-নারী সবই একই চরিত্র প্রকাশ করে—তারা মিলনেচ্ছুক। কারণ তাদের মধ্যকার যোগাযোগে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
যে মগ্নতার মধ্য দিয়ে শিল্পী সামান্য কালি-কলমের ব্যবহারে অসামান্য ‘প্রকৃতি’ বা সম্মিলিত চরিত্র তুলে ধরেন, তাতে আকস্মিকতার ছাপ নেই।
মৃণালের ছবি ‘এসেটিক’ বা ত্যাগীর চৈতন্য থেকে দূরের। তিনি সম্ভোগের সত্য আবিষ্কার করেছেন সর্বপ্রাণ বা সর্বজনের প্রতি প্রেম নিবেদনের সূত্রে।
বৈষম্যসহ আরও নানা সামাজিক বিকার থেকে এই শিল্পী নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছেন। পোশাক-আশাক ও ঘরবাড়ি আঁকেননি তিনি—যা সহজেই মানুষের শ্রেণি ও সম্পদের পরিচয়বহ, যা আর্থসামাজিক অবস্থান স্পষ্ট করে তোলে।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ধ্রুপদি মাত্রার শিল্পী যেমন ধর্ম-পরিচয়ের সাধারণ মাত্রা অতিক্রম করে মনোজগতে ও বহির্জগতের একটি সহজ সুরাহায় পৌঁছেছিলেন তার কুটুম-কাটাম ভাস্কর্যের আপাত নিরাবেগ ও ফর্মের মর্ম বা আদ্যসত্য পুনরুদ্ধারের সূত্রে, মৃণালের চিত্রকল্পে তারই অনুরূপ এক মাত্রা এই প্রদর্শনীর কাজে প্রতীয়মান হয়। এখানে বাসনা কর্তার কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত এবং তা গোষ্ঠীর শরীর পুনর্নির্মাণের তরে দেহের বাইরে চিত্রতলে বাসা বেঁধেছে বলা যায়। শিল্পী পর্বে পর্বে যে দৃশ্য তুলে ধরেছেন, তা একত্বের ধারণায় গাঁথা। হয়তো এ কারণেই তাঁর সব ছবির শিরোনামও একটিই: ‘রূপ অরূপ অপরূপ’।
মানব-মানবীর প্রধান ছবিতে গুটিকয়েক অবয়বের মধ্য দিয়ে চিত্রকল্পের সুরাহা করেছেন শিল্পী। চিত্রতলের অন্ধকারময় ক্ষেত্রের বিস্তার দেখা যায় এগুলোর মধ্যে। সামান্য নির্দেশমূলক কিছু গাছপালার মধ্য দিয়ে শিল্পী তাঁর কল্পনার বাস্তব রূপ দিয়েছেন। এসব ছবি আলোছায়ার খেলার মধ্য দিয়ে মায়াবী জগৎ তৈরি করে তা যদি লঘু রোমান্টিকতা বলে মনে হয়, এর বিপরীতে গাছপালা, মানুষ ও পাখি ভিড় করে আছে—এমন চিত্রে তাঁর সাম্যের চিন্তা অধিকতর গাঢ়।
বাংলাদেশে ফিগারধর্মী ছবির যে ভাষা, তার অধিকাংশই ব্যাখ্যামূলক বা বিশ্লেষণধর্মী। সুলতান ও জয়নুল বাদে তাবৎ আধুনিক চিত্রকলা ও ভাস্কর্য নানান বিষয় ও আঙ্গিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্মী এসব কাজে বাস্তবের ব্যাখ্যা একটি প্রধান মনোযোগের বিষয়। মৃণাল ব্যাখ্যাতীতে গমনে পারদর্শী, কিন্তু তিনি ব্যাখ্যা ও ব্যাখ্যাতীত এই দ্বৈরথ থেকে দূরে থেকে উচ্চবাচ্যহীন এক গাথা বা আখ্যানের অবতারণা করেছেন। প্রদর্শনীটি চলবে ২০ মে পর্যন্ত।