বশীরের 'মাই লেডি'

মুর্তজা বশীর ও তাঁর স্ত্রী আমিনা বশীর
মুর্তজা বশীর ও তাঁর স্ত্রী আমিনা বশীর
>১৯৬২ সালে বিয়ের পর থেকে স্ত্রী আমেনা বশীরের বেশ কিছু স্কেচ এঁকেছেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। গত বছর ১৩ মে প্রয়াত হয়েছেন আমেনা বশীর। স্ত্রীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১১ মে একটি স্থানীয় হোটেলে হয়ে গেল বিভিন্ন সময়ে মুর্তজা বশীরের আঁকা তাঁর স্ত্রীর স্কেচ ও সেগুলো থেকে করা সেরিগ্রাফির একটি প্রদর্শনী।

বিয়ের পর স্ত্রীর যত স্কেচ করেছিলেন সবই পরম যত্নে গুছিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তা না হলে কী করে আমরা দেখতে পেতাম সেই ১৯৬২ সাল থেকে এ পর্যন্ত আঁকা বেশ কিছু স্কেচ! শিল্পী মুর্তজা বশীরের স্ত্রী আমেনা বশীর যখন দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগছিলেন তখন আমরা দেখছি কতটা স্ত্রী অন্তঃপ্রাণ আর দায়িত্বশীল হতে পারেন একজন শিল্পী। ফেসবুকের কারণে সেসব ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতির নানা দিক নিশ্চয় কারও কারও চোখে পড়েছে। মনে আছে, গত বছরের শুরুতে একদিন তাঁর বাসায় গিয়ে দেখেছি শয্যাশায়ী স্ত্রীর সেবা-যত্নে তাঁর দৌড়ঝাঁপ, যখন ৮৫ বছর বয়সী মুর্তজা বশীরের নিজেরই শুশ্রূষার প্রয়োজন। দেখেছি কী পরিমাণ উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সময় পার করছেন তিনি। নিয়মিত ডায়ালিসিসের বাইরে একসময় হাসপাতালে টানা মাস দুয়েক থাকতে হয়েছে আমেনা বশীরকে, তখন সেই পুরোটা সময় তিনিও হয়েছিলেন হাসপাতালবাসী। গত বছর ১৩ মে মুর্তজা বশীর হারান তাঁকে, যাঁকে তিনি ‘তুলু’ বলে ডাকতেন।

প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একজন শিল্পীর পক্ষে সবচেয়ে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় যেভাবে স্ত্রীকে স্মরণ করা সম্ভব সেটাই করেছেন মুর্তজা বশীর। এই কাজে তিনি সঙ্গে পেয়েছেন গ্যালারি কায়া ও শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীকে। ১১ মে একটি স্থানীয় হোটেলে হয়ে গেল বিভিন্ন সময়ে মুর্তজা বশীরের আঁকা তাঁর স্ত্রীর কিছু স্কেচ, সেগুলো থেকে করা সেরিগ্রাফির উন্মোচন ও ছোটখাটো এক প্রদর্শনী। ওই ১২টি স্কেচের সেরিগ্রাফি নিয়ে ৩০ সেটের একটি ফলিও বের করেছে গ্যালারি কায়া। এই ৩০ সেটই শেষ কথা। কারণ এই প্রিন্টগুলোর পর যে সেরিগ্রাফি বা সিল্ক স্ক্রিন প্রিন্টের প্লেট থেকে স্কেচগুলো করা হয়েছে সেগুলো শিল্পী নিজেই ক্রস দিয়ে বাতিল করে দিয়েছেন। সেই দিনের সেই ছোট আয়োজনে প্রদর্শিত হয়েছিল মূল ১২টি স্কেচ ও পাশাপাশি সেগুলোর সেরিগ্রাফি প্রিন্ট। মাঝে ছিল মুর্তজা বশীরের ২০০৩ সালে করা আমেনা বশীরের প্রতিকৃতির তৈলচিত্র ‘মাই লেডি’। সেই সূত্রেই এবারের এই আয়োজনের নাম ছিল ‘হোমেজ টু মাই লেডি’।

১২টি স্কেচের মধ্যে ১১টি ১৯৬২ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্য আঁকা। বাকিটি তিনি এঁকেছেন আমেনা বশীরের মৃত্যুর পর, এ বছরের মার্চে। এটিই একমাত্র স্কেচ যা তিনি করেছেন ছবি দেখে। ১৯৬২ সালের ২৭ মে বিয়ের পর ১৭ জুলাই প্রথম স্কেচ করেন স্ত্রীর। সে বছর করা আরও ছয়টি স্কেচ ছিল এই আয়োজনে। সঙ্গে ছিল ১৯৭৪-৭৫ সালের চারটি ও ১৯৮৮ সালের একটি। বলপেন, কালি-কলম ও লেড পেনসিলে আঁকা হয়েছে এসব। এসব স্কেচ নিয়ে কথা হয়েছে মুর্তজা বশীরের সঙ্গে। বললেন, ‘স্কেচ করার সময় যে সিটিং দিতে হয় তুলু তা কখনো দিতে চাইত না। ও পছন্দ করত না, বিরক্ত হতো। এর মধ্যেই এগুলো আঁকা।’
মাধ্যম হিসেবে ড্রয়িং বা স্কেচ একজন শিল্পীর নিজের পর্যবেক্ষণকে তুলে ধরে। এই স্কেচগুলো আমাদের সবার সামনে দেশের এই সময়ের শ্রেষ্ঠ ‘ড্রয়িং মাস্টার’ মুর্তজা বশীরের সেই ’৬২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কাজের ধারাবাহিক একটি চিত্র তুলে ধরেছে। তিনি দেখিয়েছেন সবচেয়ে সরল লাইনে কীভাবে কোনো মুহূর্ত বা অভিব্যক্তি ধরে রাখা যায়। বলা যায় সরল লাইনে একেবারে নিজের একটা রীতি দাঁড় করিয়েছেন। সেই ১৯৬২ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত এই ১২টি স্কেচে আমেনা বশীরের বয়স ও ব্যক্তিত্বের বিবর্তনটি যেমন টের পাওয়া যায়, তেমনি দেখা মেলে শিল্পীর ড্রয়িংয়ের বিভিন্ন পর্যায়।
মুর্তজা বশীরের জীবনে ‘মাই লেডি’র আগমন বা বিয়ে তাঁকে অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ‘শিল্পীরা তো বোহেমিয়ান ধরনের হয়, কিন্তু বিয়ের পর দেখলাম জীবন ছকে বাঁধা। সকালে বসে একসঙ্গে চা-নাশতা খাওয়া থেকে শুরু করে সবই একসঙ্গে।’
বিয়ে আর কোনো পরিবর্তন আনেনি? জিজ্ঞেস করেছিলাম তাঁকে।
‘ছবি আঁকার ধরন ও রং—অনেক কিছুতেই বদল এসেছে বিয়ের পর। বিয়ের আগে আমি কখনো সোনালি, রুপালি বা লাল রং ব্যবহার করিনি। বিয়ের পর করেছি। আগের ছবির ধরনের সঙ্গেও বিয়ের পরের ছবির ধরন অনেক পাল্টেছে। ছবি আকার পর আমি তাকেই প্রথম দেখাতাম। তার মতামত জানতে চাইতাম। ঠিক পরামর্শ দিতে না পারলেও বলত, এই রংটি বা এই অংশটি ভালো লাগেনি। তখন অনেক সময় আমি বদলে দিতাম।’
স্ত্রীর অসুস্থতার কারণে মাঝে ছবি আঁকতে পারেননি অনেক দিন। এখন আবার নতুন করে ছবি আঁকার কথা ভাবছেন। যে সময় পার করেছেন তিনি, তখন নানা হ্যালুসিনেশনের মধ্যে অনেক ইমেজ নিজের কাছে ধরা দিয়েছে। যেগুলো আঁকতে চান মুর্তজা বশীর। আমরা অপেক্ষায় আছি।

‘মাই লেডি’, শিল্পী: মুর্তজা বশীর
‘মাই লেডি’, শিল্পী: মুর্তজা বশীর