গদ্যরচনায় নজরুল-মানস

কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যেষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
কাজী নজরুল ইসলাম (১১ জ্যেষ্ঠ ১৩০৬—১২ ভাদ্র ১৩৮৩), প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল


কাজী নজরুলের সঞ্চিতা কাব্যসংকলন পাঠে তাঁর ধ্যানধারণা বিষয়ে আবাল্য যে প্রতীতী জন্মেছে, তা থেকে নজরুল-মানস আমাদের অন্তর্লোকে স্পষ্টভাবেই উদ্ভাসিত আছে। কারণবাস্তবিক, কাব্যসত্য সব সময়েই কবির চেতনা আর অন্তর্গত বিশ্বাসের সত্যকে আপন সত্তার গহনে বহন করে। কবিতা আর কাব্যগীতির কথা বাদ দিলে সাহিত্যের অন্যান্য অঙ্গে লেখকের আত্মার প্রতিফলন ততখানি দৃশ্যমান হয় না, তবে তার ছায়া অবশ্যই থাকে।

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত নজরুল রচনাবলি অবলম্বনে নজরুলের প্রবন্ধ আর অভিভাষণগুলো পড়ে তাঁর চিন্তা এবং নিহিতবোধ অনুধাবন করবার চেষ্টা করব আমরা। পাশে পাশে মানস বিবর্তন বুঝবার জন্য তাঁর জীবনও স্মরণ করতে হবে আমাদের।

এক.
প্রথমে কাজী নজরুল ইসলামের গদ্যগ্রন্থ যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী আর রুদ্রমঙ্গল থেকে লেখকের চিন্তাভাবনার ধরনটি বুঝে নেবার চেষ্টা করব।

যুগবাণী সংকলন প্রধানত দৈনিক নবযুগ পত্রিকার সম্পাদকীয় থেকে নির্বাচিত কিছু রচনা। পত্রিকাতে সমসাময়িক প্রসঙ্গই স্বভাবত প্রধান। সমাজ, বিশেষতমুসলমান সমাজের জড়ত্ব এবং পশ্চান্মুখীনতা নিয়ে নজরুল আক্ষিপ্ত। তাঁর কবিতা-গানের মতো প্রবন্ধেও স্বজাতিপ্রীতি প্রবল। বাংলাভাষা চর্চায় মুসলিম সম্প্রদায়ের অভিরুচি জন্মেছে বলে আনন্দ বোধ করলেও, লেখাতে জড়তাবশত সহজ যৌবনতরঙ্গিত প্রাণপ্রবাহের অভাব লক্ষ করে নজরুল পীড়িত। (‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’ পৃ. ৩৮৮)। চিন্তাভাবনার বলিষ্ঠতা সাধনের জন্যে শারীরিক সুস্থতা আর আনন্দময়তা প্রয়োজনীয়, বলেছেন তিনি। সেই সঙ্গে সংগীতমনস্কতাও তাঁর মতে জরুরি। কারণ, সাহিত্যের ভাষাতেও সংগীত চাই, চাই সুরের রণন। ভাষাবিষয়ে এমন উপলব্ধির দরুনই নজরুল সার্থক ভাষাশিল্পী হয়েছিলেন। বলেছেন, লেখার উৎকর্ষের সঙ্গে অন্তরের ঔদার্য, জাতিধর্ম বিষয়ে বিদ্বেষমুক্ত মনোভাব চাই। এর ফলে ব্যক্তির সৃষ্টি আপন সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজনের হয়ে ওঠে। আর আপন জাতি-ধর্মের বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেও বিশ্বজনীন সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব, মনে করেন তিনি।

হিন্দু-মুসলমান বিরোধ নজরুল-ভাবনার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। রাজনৈতিক প্রয়োজন বোধ করে এই দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ মীমাংসা বা মিলনের চেষ্টা করা যে কত হাস্যকর আর অর্থহীন সে কথা নজরুল বুঝেছেন। মনে পড়ে গান্ধীজির এ রকম চেষ্টা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ আপত্তি করেছিলেন। ‘ভাই বলিয়া গলা জড়াইয়া’ ধরলেই সত্যিকার বন্ধন সৃষ্টি হয় না।

‘আদত রোগে’র খোঁজ করে বলেছেন, ‘ছোঁয়াছুঁয়ি’র জঘন্য ব্যাপারটাতেই বিভেদের কারণ রয়েছে। ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে ‘সত্য’, তা বিশ্বে পরিব্যাপ্ত। সেই ধর্মে সংকীর্ণ প্রথার সমর্থন থাকতে পারে না। সে জন্য হিন্দুর ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’ বাণীর মতো। মুসলমানের হাদিসেও এক শ বছর পরপর প্রথাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করবার জন্য একজন ‘সংস্কারক’-এর আবির্ভাবের কথা রয়েছে, বলছেন শাস্ত্র-অভিজ্ঞ নজরুল।

 হিন্দুধর্মে ‘নর’কেই ‘নারায়ণ’ বলা হয়েছে, অথচ ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘ম্লেচ্ছ’ নাম দিয়ে হিন্দুসমাজের প্রবল ঘৃণাপ্রকাশ নিয়ে আক্ষেপ করেছেন নজরুল। তাঁর আহ্বান হিন্দু-মুসলমান সকলে মিলে মুক্ত আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বলুক ‘আমার মানুষ ধর্ম’।তাহলেই ‘সৃষ্টির আদিম বাণী’ অবলম্বন করে ‘মহাজাতি’ জন্ম নেবে। সকলে মিলে ধ্বনি তুলুকশুধু মানুষ বাঁচিয়া থাক ভাইভারতে শুধু চিরকিশোর মানুষেরই জয় হউক’ (ছুঁৎমার্গ, পৃ. ৩৯)।

হিন্দু-মুসলমান ভেদ ছাড়াও আমাদের সমাজে ‘অভিজাত গোষ্ঠী’ আর ‘ছোটলোক’ শ্রেণির ব্যবধানও দুস্তর। ‘উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন’ শিরোনামের লেখায় নজরুল এদিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বলছেন তথাকথিত ছোটলোকদের ঘৃণা করে দূরে ঠেলে কখনোই দেশের উন্নতি হতে পারে না। কারণ, ‘দেশের অধিবাসী লইয়াই তো দেশ এবং ব্যক্তির সমষ্টিইতো জাতি’ (পৃ. ৩৯৫)।আভিজাত্যের অহংকার ছেড়ে দেশের সাধারণ মানুষদের আন্তরিকভাবে বুকে টেনে নিয়ে তাদের শক্তির উদ্বোধন ঘটাতে পারলে ঐক্যবদ্ধ বলিষ্ঠ জাতির জাগরণ সম্ভব হবে। ছোটলোক জনসাধারণের ‘সুপ্ত’ ‘সিংহশক্তি’কে জাগাতে পারলেই ঐক্যবদ্ধ জাতিগঠন হওয়া সম্ভব।

যুগবাণী লেখমালায় প্রাধান্য পেয়েছে, হিন্দু-মুসলমান হিংসা এবং অভিজাত আর সর্বসাধারণের বিভেদ দূরীকরণ। আরও আছে জাগরণের আহ্বান, মুক্ত স্বাধীন জীবনে উদ্বুদ্ধ হবার আহ্বান। ‘যুগবাণী’তে নজরুল ব্যবসায়ী মানসিকতার নিন্দা করলেও, চাকরির পরিবর্তে কৃষিকাজ বা অন্য ব্যবসায়ে যোগ দিলে অন্তরের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব বলে জানিয়েছেন।

দুর্দিনের যাত্রীতে ধূমকেতু পত্রিকার কিছু প্রবন্ধ আর সম্পাদকীয় সংকলিত হয়েছিল। যুগবাণীর মতো এ পুস্তকটির ওপরও ইংরেজের বাজেয়াপ্ত-ঘোষণার খাঁড়া নেমে এসেছিল। ‘তুবড়ি বাঁশির ডাক’ (পৃ. ৪০৪) প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ঝোড়ো পরিবেশ বর্ণনার বর্ষাসংগীত ‘পুব সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী’ গানের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন নজরুল। ঝড়ের বাতাসের ধ্বনিতে ‘সাপ খেলাবার বাঁশি’ শুনে, সাপুড়িয়ার তুবড়ি বাঁশির ডাকে ‘কাল-কেউটে’র মতো দলে দলে ছুটে আসতে বলছেন তরুণদের। তারা আগুনের মতো বিষ-নিশ্বাস ছেড়ে সর্বত্র বিষ ঢেলে জ্বালিয়ে দিক সব, এ রকম প্রবলভাবে জেগে উঠবার আহ্বান। সরকারকে দুশ্চিন্তায় ফেলবার মতো কথাই বাস্তবিক!

এই গ্রন্থের ‘মোরা সবাই স্বাধীন/ মোরা সবাই রাজা’ রচনায় ‘স্বরাজ’ শব্দের অর্থ নিয়ে আলোচনা করেছেন নজরুল। ‘নিজেকে নিজের রাজা করা’র দিকে লক্ষ দিলেই প্রকৃত স্বাধীন হওয়া সম্ভব। নিজের অধীনতামাত্র স্বীকার করা অহংকারের ঘোষণা নয় মোটেই, আপনার ওপর অটল বিরাট বিশ্বাস-এর ঘোষণা। বলছেন, ‘এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে মানুষ কাপুরষ হয়ে যায়, ক্লীবত্ব প্রাপ্ত হয়’ (পৃ. ৪০৬)। নজরুলের আরও উপদেশ ‘কল্যাণকে জাগাও। আপনাকে চেনো’ (ওই)। আর ‘যে অপমান করে তার চেয়ে কাপুরষ হীন সে-ই, যে অপমান সয়। তোমার আত্মশক্তি যদি উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তবে বিশ্বে এত বড় দানব-শক্তি নেই যা তোমাকে পায়ের তলায় ফেলে রাখে’ (পৃ. ৪০৭)। রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি গ্রন্থের কথা এ সূত্রে মনে আসে।

রুদ্রমঙ্গল নজরুলের বাজেয়াপ্ত-হওয়া অপর গদ্যগ্রন্থ। এতেও আবার সত্য আর আত্মশক্তিতে বিশ্বাসের প্রসঙ্গ এসেছে। এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা। ‘মোহর্রম’ প্রবন্ধে মাতম-অভিনয়কে ধিক্কার দিয়ে সত্যের পক্ষ নিয়ে নির্যাতনের প্রতিবাদে রক্ত দেবার আহ্বান জানিয়েছেন নজরুল। প্রথার অন্তরে নিহিত সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন বাস্তবিক।

‘বিষ-বাণী’ রচনায় তরুণদের আত্মবোধন এবং দ্রোহের পথে আহ্বান করা হয়েছে। তরুণদের উদ্দেশে জাগরণের ডাক তাঁর লেখার অন্যতম প্রধান বিষয় সর্বদা। নাগের বিষ ছড়িয়ে বন্দিত্বের শৃঙ্খল ভাঙবার আহ্বান জানাচ্ছেন। দ্রোহ করে ফাঁসিতে প্রাণ দেওয়া মাতৃহীন ক্ষুদিরামের ‘আঠার মাসের পরে, /জনম নেব মাসীর ঘরে, মাগো!’ আশ্বাসবাণী স্মরণ করে মায়ের ঘরে ঘরে গলায় ফাঁসির চিহ্ন নিয়ে জন্মানো ক্ষুদিরামদের সন্ধান করেছেন নজরুল। শত তরুণ জাগ্রত-আত্মার ক্ষুদিরামদের আওয়াজ দিতে বলছেন, কারণ, ‘ওরা দেশের, ওরা বলিদানের, ওরা পূজার’। এমন আহ্বানে ব্রিটিশরাজের আতঙ্কিত হবার কারণ ছিল বৈকি! এই সব সময়ে নজরুল ধর্মীয় বা সামাজিক প্রথার নিহিত তাৎপর্য খুঁজছেন। যে জন্য ‘মোহররম’ তাঁর কাছে নির্যাতনের প্রতিবাদে রক্তদানের প্রতীক হয়ে উঠেছে। একইভাবে ‘ধূমকেতুর পথ’ লেখাতে তিনি বলছেন ‘পূজা মানে দেবতাকে সত্যি করে চিনে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া। যাকে আমি সত্য করে বুঝতে পারিনি, তাঁকে পূজা করতে যাওয়া তাঁর অপমান করা’ (পৃ. ৪২৯-৩০)। আরও বলছেন, না-বুঝে না-চিনে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দকে ভক্তি দিতে গেলে তাঁদের বরং অপমানই করা হবে। এতে নজরুলের আধুনিক চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ করছি।

রুদ্রমঙ্গল গ্রন্থের শেষে ‘মন্দির ও মসজিদ’ আর ‘হিন্দু-মুসলমান’ নামে দুটি রচনাতে ভারতবর্ষের প্রধান দুই জাতির পরস্পর অর্থহীন বিদ্বেষ এবং হানাহানিকে নজরুল তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি এর আগেও লিখেছেন, পরেও, তাঁর অভিভাষণে এসব কথা পাব। তরুণদের সত্যপথে আন্দোলনে নামবার ডাকও আসবে ফিরে ফিরে।

‘মন্দির ও মসজিদ’ (পৃ. ৪৩১)-এ দাঙ্গা নিয়ে তাঁর বেদনা উদ্বেল হয়েছে। মানবতার দিকে যারা ফিরেও তাকায় না তারা ছোরা আর লাঠি নিয়ে নিজের ধর্মসম্প্রদায় রক্ষা করে! নজরুলের মতে, ‘ইহারা ধর্মমাতাল। ইহারা সত্যের আলো পান করে নাই, শাস্ত্রের অ্যালকোহল পান করিয়াছে।’ মনে পড়ে, শাস্ত্রীয়প্রথাকে রবীন্দ্রনাথও সর্বদা ধর্মবহির্ভূত ‘ধর্মতন্ত্র’ বলে ধিক্কার দিয়েছেন তাঁর প্রবন্ধে।

নজরুলের উল্লিখিত দুটি প্রবন্ধেই হাস্যরসিক লেখকের সরস মন্তব্য লক্ষণীয়। ‘মারো শালা যবনদের!’ আর ‘মারো শালা কাফেরদের!’ হাঁক ছেড়ে মাতালের চিৎকার দিয়ে তারা নাকি আল্লাহ্‌র এবং মা কালীর ‘প্রেস্টিজ’ রক্ষা করে। আর মারণ আঘাতে লুটিয়ে পড়লে তারা সকলেই আল্লাহ্ বা মা কালীকে না ডেকে ‘বাবা গো, মা গো’ বলে চিরকালের বাঙালির মতো একই ভাবে কাতরায়!

‘হিন্দু-মুসলমান’ লেখাতেও রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে নজরুল বলছেন, ‘যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজ কাটবে কে?’ (পৃ. ৪৩৬)। টিকি আর দাড়ি হচ্ছে মানুষের সেই ন্যাজ। এ ন্যাজ মাথায় আর মুখে নয়, গজিয়েছে মনের গভীরে; তা থেকেই এত বিদ্বেষ। আর, দাড়ি কামানো খায়রু মিয়া ছুরি খেলে, কিংবা ‘তুর্কিছাঁট-দাড়ির শশধর বাবু’ ছুরি খেলে প্রথম ক্ষেত্রে মুসলমান আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে হিন্দু শব নিয়ে কবরস্থান বা শ্মশানে ছোটে না।

দুঃখ এই, ‘মানুষ আজ পশুতে পরিণত হয়েছে, তাদের চিরন্তন আত্মীয়তা ভুলেছে। পশুর ন্যাজ গজিয়েছে ওদের মাথার ওপর, ওদের সারা মুখে। ওরা মারছে... টিকিকে, দাড়িকে। বাইরের চিহ্ন নিয়ে এই মূর্খদের মারামারির কি অবসান নেই!’

নজরুলের প্রবন্ধে ভাষার খেলা খুবই চিত্তাকর্ষক। যেমন খানিক আগেই ‘আলো’র সঙ্গে ‘অ্যালকোহল’-এর তুলনায় ল-ধ্বনির খেলা দেখেছি আমরা। পরবর্তী আলোচ্য ‘অভিভাষণ’ সমগ্রতেও উইট আর হিউমারের অন্তঃস্রোত ভাষাকে কেমন রসাল করেছে, তা দেখা যাবে।

দুই.
বিভিন্ন উপলক্ষে দেওয়া নজরুলের ভাষণগুলো একত্র করে রচনাবলিতে ‘অভিভাষণ’ নামে সংকলন করা হয়েছে। বিন্যাসকালে কালানুক্রম রক্ষা করা হলে নজরুল-মানসের বিবর্তনধারা অনুসরণের সুবিধা হতো। বর্তমান আলোচনায় কালানুযায়ী আলোচনা করে নজরুলের চিন্তাধারার ক্রমগতি বুঝবার চেষ্টা করব।

১৯২৬ সালে ‘কৃষক শ্রমিকের প্রতি সম্ভাষণ’ শিরোনামে নজরুল তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠিয়েছিলেন ময়মনসিংহের কৃষক-শ্রমিক সম্মেলনে। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। লেখাটি লাঙল পত্রিকার ৭ই মাঘ, ১৩৩২ সংখ্যায় প্রকাশ হয়েছিল। খেটে-খাওয়া মানুষের জন্য নজরুলের দরদ প্রকাশ পাচ্ছে এ লেখাতে। শোষণ-বঞ্চনার প্রতিবাদে তাদের ‘নবজাগরণ’কে সম্মান জানাচ্ছেন লেখক। উপযুক্ত নেতা এসে তাদের অপহৃত অধিকার ফিরিয়ে আনুক, এই প্রার্থনা তাঁর। বলেছেন, ‘এ মাঠ চাষার, এর ফুল-ফল কৃষক-বধূর’। ‘অবহেলিত, নিষ্পেষিত, বুভুক্ষু’ শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করতেও কোনো নেতা আসবেন অবশ্যই, বলছেন এ ভাষণে।সমসময়ে নজরুল লাঙল পত্রিকার সম্পাদকরূপে নিরীহ-নিপীড়িত শ্রমজীবীদের পক্ষ নিয়ে লেখালেখি করছিলেন।

নজরুলের পরবর্তী ভাষণ ১৯২৯ সালের প্রথম দিকে রচিত। চট্টগ্রামের ‘বুলবুল সোসাইটি’র মানপত্রের জবাবে সেটি লেখা। ‘ওগো বুলবুলিস্তানের নব বৈতালিক দল’ সম্বোধনে উচ্ছ্বাসময় এই লেখায় নজরুল নবীনদের ‘ভয়ে-নির্ভীক আনন্দে-শান্ত দেবশিশু’ হিসেবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। এদের ‘জাগর-চঞ্চল’ গানে ঘুমন্ত যাত্রীরা জেগে উঠবে, আর সেই গানই চট্টগ্রামে নজরুলের ‘সুন্দরতম আমন্ত্রণগাথা’ হবে, লিখছেন। এই সব অভিভাষণে নবীন যুবকদের জাগরণগাথা গাওয়া নজরুলের প্রিয়-প্রসঙ্গ ছিল।

১৯২৯ সালেই ‘চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠার সমাবেশে আর একটি উচ্ছ্বাসমুখর সভাপতির ভাষণ দেন কাজী নজরুল।এটিও জাগরণীগাথা। এতে ‘নারী জাগরণে’র বিশেষ আহ্বান রয়েছে। বাহার-নাহার ভাইবোনের আগ্রহে নজরুলের চট্টগ্রাম গমন। তখনকার মুসলিম গৃহের শিক্ষা আর সাহিত্যে আগ্রহী শামসুননাহারের দারুণ প্রশংসা উচ্চারিত হয়েছে এতে। এখানেও নজরুলের সমাজ-উন্নয়নের আগ্রহ প্রধানভাবে প্রকাশিত। দিনের বিভিন্ন প্রহরে নিজের ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকার সঙ্গে ‘দীপ্ত মধ্যাহ্নে’ তাঁর কাজের বিবরণ দিচ্ছেন, ‘খর তরবার নিয়ে রণভূমে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তখন আমার খেলার বাঁশি হয়ে ওঠে যুদ্ধের বিষাণ, রণশিঙ্গা’ (পৃ. ১৯)। তাঁর তরবারি ‘সুন্দরের অবমাননাকারী’ ‘অসুরের জন্য’ (ওই)।

চট্টগ্রামের খানবাহাদুর আবদুল আজিজ ছিলেন ত্যাগী মানুষ। স্পষ্ট উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, প্রয়াত এই মহাপ্রাণই ‘চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটি’র সূচনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি যে, ‘সুর ধরিয়ে দিয়ে গেছেন’ তা ‘সমে’ পৌঁছে দেবার আহ্বান নজরুলের।

শিক্ষা-সমিতির কাছে, চট্টগ্রামবাসীর কাছেও আরও এক আরজি বক্তার, চট্টগ্রামে শান্তিনিকেতনের মতো একটি সংস্কৃতি-কেন্দ্র গড়ে তোলা হোক। সেখানে মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা করে সংস্কৃতিমান মানুষ গড়ে তুলতে পারলে আমাদের মানসিক দৈন্য ঘুচবে।হিন্দু-মুসলমানে পরস্পর ঘৃণার মূলে আছে মুসলমানের পশ্চাদ্‌গামিতা। এই সাম্প্রদায়িক বিষ উন্মূল করবার জন্যে মুসলমানের সংস্কৃতিসাধনা একান্ত প্রয়োজন। ‘আমাদের এই দুই জাতি কেউ কারুর শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতার মহিমার খবর রাখিনে।’ (পৃ. ২২)। ফলে, হিন্দুর কাছে ‘দরিদ্র মূর্খ কালিমুদ্দি মিয়াই... এ্যাভারেজ মুসলমানের মাপকাঠি’ (ওই)। পরস্পর শ্রদ্ধাবোধের অভাব আর হিংসার জন্যই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ দেশের পরাধীনতাকে দিন দিন দিন পোক্ত করছে। নিজের এই চিন্তাকে নজরুল ‘রাজনৈতিক’ ভাবনা বলছেন। নজরুলের ধারণা মুসলিম ঐতিহ্যের দৃষ্টান্ত রয়েছে আরবি-ফারসি ভাষায় লিখিত গ্রন্থে। এবং এসবের অনুবাদ হলেই হিন্দুর কাছে মুসলমানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য উদ্‌ঘাটিত হতে পারবে। এ বিশ্বাসের পেছনে মুসলিমবিশ্বের ইতিহাস-চেতনা কাজ করছে। বাঙালি মুসলমানের জন্য সুরাহার ভাবনা প্রকাশ পাচ্ছে না বাস্তবিক। নজরুল বরাবরই দৃঢ়ভাবে ওই বিশ্ব মুসলিম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গৌরব-গাথা গেয়ে গেছেন।

১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলার হিন্দু-মুসলমানের পক্ষ থেকে’ নজরুলকে ‘বিপুল সমারোহ ও আন্তরিকতা সহকারে সংবর্ধনা’ দেওয়া হয়েছিল। তারই উত্তরে কবি ‘প্রতিভাষণ’ দেন। এই অভিভাষণের শিরোদেশে বর্ণিত আছে যে, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে মানপত্র পড়ে শোনান এস. ওয়াজেদ আলী। আমরা জানি, ইনি তখনকার বিশিষ্ট অসাম্প্রদায়িক প্রবন্ধ-রচয়িতা। আর নজরুলের প্রতিভাষণের পরে দলনেতা সুভাষ বসু ‘আবেগোচ্ছল কণ্ঠে’ কবির ‘স্বদেশী-সঙ্গীত ও দেশাত্মবোধমূলক কবিতার প্রশংসা’ করেন।

নজরুল জীবনে এই একটি সম্প্রদায়-নির্বিশেষ উদার এবং সঙ্গত সম্মাননার আয়োজন হয়েছিল বলে লক্ষ করি। নজরুল ভাষণে বলেছিলেন, ‘কেউ বলেন, আমার বাণী যবন, কেউ বলেন, কাফের। আমি বলি ও দুটোর কিছুই নয়’ (পৃ. ৫)। এরপরেই সম্প্রদায়গত মিলনের চেষ্টার কথা তুলে ভাষা নিয়ে খানিক সরস খেলা করেছেন ‘আমি মাত্র হিন্দু-মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যাণ্ডশেক করাবার চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করবার চেষ্টা করেছি। সেই হাতে-হাত মিলানো যদি হাতাহাতির চেয়েও অশোভন হয়ে থাকে, তাহলে ওরা আপনিই আলাদা হয়ে যাবে...’ (পৃ. -৬)। ভাষণের শেষে বলেছেন, বিভেদের দায় শুধু একপক্ষের নয়।সমুদ্রমন্থনকালে দেবতাদের দোষের কথা তুলে দেবতাপক্ষকে ডেকে বলেছেন, ‘আজকের হলাহলটাই সত্য নয়, অসহিষ্ণু হবেন না দেবতা র’সে খান, অমৃত আছে, সে উঠলবলে’ (পৃ. ৬)। ভবিষ্যৎ মঙ্গলের আশায় উন্মুখ কবিকে দেখতে পাই এখানে।

১৯৩২ সালে সিরাজগঞ্জে ‘বঙ্গীয় মুসলিম তরুণ সম্মেলন’-এর সভাপতিত্ব করতে গিয়ে নজরুল অতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা দেন। নিজেই সে-অভিভাষণটি ‘অতিভাষণ হতে চলল’ বলেছিলেন। লেখাটির দৈর্ঘ্য এবং উপশিরোনামগুচ্ছ অনেকগুলো লেখার সমাহার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূল নাম ‘তরুণের সাধনা’র ছোট ছোট শিরোনামগুলো উল্লেখ করছি ‘বার্ধক্য ও যৌবন’, ‘গোঁড়ামি ও সংস্কার’, ‘অবরোধ ও স্ত্রী-শিক্ষা’,‘সঙ্ঘ একনিষ্ঠতা’, ‘সঙ্গীত শিল্প’, ‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’, আর ‘শেষকথা’। সব কটি লেখা পরস্পর সংগ্রথিত। সমাজ নিয়ে বিস্তারিত, সামগ্রিক, সুগভীর ভাবনার প্রতিফলন এ প্রবন্ধে বিধৃত।

অতিপ্রয়োজনীয় এবং সংস্কারমূলক এই ভাষণটির বক্তব্য তুলে ধরলে আমরা সংস্কারমুক্ত-সত্যাশ্রয়ী-মানবতার সেবক নজরুলের চিরন্তন রূপটির স্পষ্ট ছবি প্রত্যক্ষ করব।

প্রথমে নিজেকে ‘দেশকর্মী’ বলে দাবি করে পরপরই নতুন অনুচ্ছেদে তিনি বলছেন, ‘আমি আজ তাঁহাদেরই দলে যাঁহারা কর্মী নন ধ্যানী’। ১৯৩২ সাল নাগাদ তিনি কর্মী-ভূমিকা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে ধ্যানদৃষ্টিতে সমাজের পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেছেন।বিশেষতমুসলিম যুবকদের ‘তারুণ্যের ভরা-ভাদরে’ ‘জোয়ার’ আনবার জন্যে ডাক দিচ্ছেন।

‘বা‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌র্ধক্য ও যৌবন’ অংশে রবীন্দ্রনাথের ‘সবুজের অভিযান’-এর অনুরূপ বক্তব্য এসেছে। জীর্ণ ভবন যখন মাথার ওপরে ভেঙে পড়বার দাখিল হয়, তখন তা ভেঙে ফেলাই যৌবনের ধর্ম। জরাগ্রস্ত সবকিছু ভেঙে নব সৃষ্টির পথে আসবার আহ্বান এ লেখায়।

পরবর্তী অংশে ‘গোঁড়ামি ও কুসংস্কার’ প্রসঙ্গে নজরুলের অকুতোভয় উক্তি, ‘এ দেশের মওলানারা খাল কেটে বেনোজলের সঙ্গে কুমির নিয়ে এসেছেন।’ লিখেছেন, কাঠমোল্লাদের অত্যাচার তাঁর কাছে দুঃসহ। তারা ইসলামের নাম করে ‘ফতুয়া-ভরা ফতোয়া’ নিয়ে মুসলিম জাতি আর সমাজের অনিষ্ট করে চলেছে। তরুণরাই পারবে ওঁদের হটাতে। এঁদের কুষ্ঠ বা যক্ষ্মারোগীর মতো দূরে সরাতে হবে।পচনশীল অঙ্গকে কেটে না ফেললেই অমঙ্গল। শেষে বলছেন,চোগা-চাপকান দাড়ি-টুপি দিয়া মুসলমান মাপিবার দিন’ চলে গেছে। আধুনিক দ্রুতগতির জগতে গোঁড়ামি পরিহার করে অগ্রযাত্রা জরুরি।

এরপরে পর্দাপ্রথা ত্যাগ আর নারীশিক্ষার কথায় গেছেন নজরুল। বহু তিরস্কারের পরে ভরসা করেছেন, তরুণরাই উড়তে ভুলে যাওয়া দাঁড়ে বাঁধা নারীদের মুক্তি সাধন করতে পারবে।

অনন্তর, সঙ্ঘ গড়ে একনিষ্ঠভাবে কর্মে নিযুক্ত হবার আদর্শের কথা তুলেছেন নজরুল। এ ক্ষেত্রে হিন্দুযুবাদের তুলনায় মুসলিম-তরুণদের দুর্বলতা নিয়ে আক্ষেপোক্তি করছেন। হিন্দুদের সাধন নিষ্ঠার জন্যেই দেশের যৌবনে ঘুন ধরে যায়নি এখনো।ওই যুবকদের জজ-ব্যারিস্টার-ম্যাজিস্ট্রেট-প্রফেসর হবার যোগ্য শিক্ষা থাকলেও তারা চাকরি করবার হীনতা স্বীকার করেনি। অথচ মুসলমান যুবারা সাবরেজিস্টার বা দারোগা হবার লক্ষ্যেই লেখাপড়ার দিকে যায়। আর শিক্ষিত হিন্দু তরুণরা ‘রাস্তায় প্রাণ ফিরি করিয়া ফিরিতেছে।...দীপশলাকার মতো ইহারা আয়ু ক্ষয় করিয়া গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে প্রাণপ্রদীপ জ্বালাইয়া তুলিয়াছে।’ (পৃ. ১৩)।

তিরস্কারপূর্ণ তুলনার শেষে মুসলমান যুবকদের সব মোহ ছেড়ে ঝুলি নিয়ে পথে বের হয়ে আসবার জন্য উদাত্ত স্বরে ডাক দিয়েছেন।

সংগীত আর শিল্পচর্চার প্রতিও মুসলিম যুবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কবি আর সংগীতশিল্পীদের যাত্রাসঙ্গী করে নিলে তরুণদের বহুমুখী কাজের লক্ষ্য পূরণ হবে বলে বিশ্বাস করেন নজরুল। মুসলমানের সংগীতচর্চায় নিষেধ থাকলে, তা অগ্রাহ্য করবার উপদেশ দিচ্ছেন।এ ক্ষেত্রে মুসলিম সংগীতগুণীদের কণ্ঠ এবং যন্ত্রসংগীতে শিখর স্পর্শ করবার খবরও জানাচ্ছেন বক্তা।সংগীত-সাহিত্য-চিত্র-ভাস্কর্য ক্ষেত্রের সার্বিক সাধনা সমাজের মানস-উৎকর্ষ সাধনের উপায় বলছেন।

‘হিন্দু-মুসলমান ঐক্য’ নজরুলের অন্যতম প্রিয় বিষয়, আমরা জানি। যৌবনের প্রতি এই কবির আবেদন, ‘আমার ধর্ম যেন অন্য ধর্মকে আঘাত না করে, অন্যের মর্মবেদনার সৃষ্টি না করে’ (পৃ. ১৫)। একই দেশের ফুলে-ফসলে পুষ্ট দুই সম্প্রদায়ের বিরোধ অত্যন্ত নিন্দনীয়। অথচ সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক নেতারা নিজ নিজ সম্প্রদায়কে ‘ধর্মের নামে উগ্র মদ পান’ করিয়ে অযথা মাতাল করে তুলে বিরোধ সৃষ্টি করছেন। আর শিক্ষা-বঞ্চিত সাধারণ মানুষকে করে তুলছেন নিজেদের হাতের পুতুল। রাজনৈতিক নেতারা চারপাশে ‘ভাড়াটিয়া মোল্লা মৌলবি পণ্ডিত পুরুত’ জুটিয়ে নিয়ে তাদের দিয়ে আপন আপন সম্প্রদায়ের পক্ষে ওকালতির ব্যবস্থা করেন। নজরুলের কথা, তরুণরা যেন ‘কদর্য’ হানাহানির ঊর্ধ্বে থাকে। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘ইসলাম ধর্ম কোনো অন্য ধর্মাবলম্বীকে আঘাত করিতে আদেশ দেন নাই।ইসলামের মূলনীতি সহনশীলতা। পরমত সহনশীলতার অভাবে অশিক্ষিত প্রচারকদের প্রভাবে আমাদের ধর্ম বিকৃতির চরম সীমায় গিয়া পৌঁছিয়াছে’ (পৃ. ১৫-১৬)। যুবসমাজের উদ্দেশে বলছেন, ‘মানুষকে মানুষের সম্মান দিতে যদি না পারেন, তবে বৃথাই আপনি মুসলিম’ (পৃ. ১৬)। মুসলমানদের ভুল আর পশ্চাদ্পদতা বিষয়ে লেখকের ওই দুর্ভাবনা এ যুগের জন্যেও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। নজরুলের ‘শেষকথা’, ‘আমরা যৌবনের পূজারী, নব-নব সম্ভাবনার অগ্রদূত...’ (ওই)। পৃথিবীর অগ্রগামী পথিকদের সঙ্গে সমতালে পথ চলব। দশ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ ভাষণে নজরুল নওজোয়ানদের জন্য সুচিন্তিত সর্বাত্মক পথ-নির্দেশ দিয়ে গেছেন।

১৯৩৬ সালে ‘ফরিদপুর জেলা মুসলিম ছাত্র সম্মিলনী’তে সভাপতি নজরুল ‘বাংলার মুসলিমকে বাঁচাও’ নামে বক্তৃতা করেছিলেন। ওই সময়ে জীবিকা নির্বাহের কঠিন সংগ্রামে পর্যুদস্ত কবি গ্রামোফোন কোম্পানির চাকরিতে প্রবেশ করেছিলেন। আক্ষেপ করেছেন, আন্দোলনের পথ ছেড়ে ছাত্রসমাজের নেতৃত্ব দেবার আকাঙ্ক্ষা ছেড়ে তিনি চাকরি গ্রহণে বাধ্য হন। লজ্জাবোধে নিজেকে ব্রতচ্যুত মানুষ হিসেবে গণ্য করেছেন এখানে। মুসলিম ছাত্রদের ‘ভালোবাসার দোহাই’ শুনে সভাপতিত্বে সম্মত হয়ে তাদের নারীর অবরোধের ‘কুশ্রীতা’ বিষয়ে সজাগ করেছেন। পরস্পর যাবতীয় বিভেদ ভুলে সঙ্ঘবদ্ধতায় উদ্বুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছেন।

১৯৩৮ সালে কৃষক পত্রিকার অফিসে সভাপতির অভিভাষণে নজরুল ‘জন-সাহিত্য’ শিরোনামে কথা বলেন। এটি ছিল ‘জন-সাহিত্য সংসদ’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সর্বসাধারণ সম্পর্কে বিশেষ সচেতন নজরুল জনগণের ‘মতবাদ’ সৃষ্টি আর তাদের জন্য ‘রসসৃষ্টি’র প্ল্যাটফর্ম তৈরির আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। সাম্প্রদায়িকতা সকল শুভকর্মের বাধা বলে সে সমস্যার সমাধান প্রয়োজন বলেছেন এই লেখাতেও। পল্লিজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জন-সাহিত্য গড়ে উঠবে এবং সে লেখার ভাষা হবে সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করবার মতো। পল্লিমানুষের ভাষাতে জারি আর গাজির গান রচনা চাই। গ্রামে ঘুরে বুঝেছেন তিনি নিজেও জন-সাহিত্য রচনার অযোগ্য। সে-অভিজ্ঞতা থেকেই বলেছেন যে, ‘ইনটেলেকচুয়াল’দের তিনি জন-সাহিত্য রচনায় প্রবৃত্ত হতে বলবেন না। যাঁরা সাধারণের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারবেন, তাঁরাই এ কাজের যোগ্য হবেন। এত বড় সঙ্গত কথাও তিনি এখানে উচ্চারণ করেছেন যে, মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন নাগরিক সাহিত্য বস্তুত ‘টবের গাছ’। নিজের সৃষ্টিকেও তো তা-ই বললেন তাহলে!

স্বার্থকেন্দ্রিক জনদরদ আর রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি তাঁর বক্রোক্তি, তাঁরা ‘কওমের জন্য চিৎকার করতে করতে হয়ে যান মন্ত্রী, আর ত্যাগ করতে কারতে বনে যান জমিদার’ (পৃ. ২৯)। আরও বলেছেন, আমরা কোরবানির নামে গরু-ছাগল জবাই করেই কর্তব্য সমাপ্ত করি; মনের গহনের পাপ, কুসংস্কার, অন্যায় কোরবানি করবার দায় এড়িয়ে আল্লাহ্‌র সঙ্গে প্রতারণা করি। সত্য নির্দেশ না-বুঝবার ভান রয়েছে আমাদের।

এই লেখাটিতে কোথাও কোথাও কিছু জোড়াতালির পরিচয় আছে। সব কথা যেন পরস্পর-সংলগ্ন নয়। আকস্মিকভাবে সংগীতে অবদানের জন্য ভবিষ্যতে তিনি স্মৃত হবেন,এমন প্রসঙ্গ দলছুট উক্তির মতো এসেছে। ১৯৩৮ সালে এই অসংলগ্নতা লক্ষ করবার মতো। নজরুলের দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির আভাস পাওয়া যায় না কি এ থেকে?

’৩৯ সালের শেষ দিকে ‘উস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁ’র শোকসভায় সভাপতির ভাষণে নজরুল তাঁর সংগীতগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে অনেক গুণীশিল্পীর স্রষ্টা হিসেবে তাঁকে স্মরণ করে, তুলেছেন শরিয়তের প্রসঙ্গ। জমিরউদ্দীন ধর্মের কাজ করেননি বলে মুসলমানদের পক্ষে তাঁর শোকসভা করবার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা উঠতে পারে উল্লেখ করে বললেন, ‘বেহেশ্তের পাখির গান’ হিসেবে সুর বস্তুত ঊর্ধ্বলোকের পবিত্র প্রসাদ। বললেন, ‘সুর... আল্লার রহম-রূপে দুনিয়ায় নাজেল হয়েছে’ (পৃ. ৩১)। পরে লিখছেন, হাফিজের মৃত্যুর পরে তাঁর জানাজায় আসতে চায়নি কেউ। আর কবির নির্দেশমতো তাঁর বইয়ের পাতা খুলে প্রথমেই দেখা গিয়েছিল হাফিজ সেখানে লিখেছেন, কেউ তাঁর দাফন করতে চাইবে না বটে তবু আল্লার দরবারে তাঁর স্থান হবে। এসব প্রসঙ্গের বিস্তার জমিরউদ্দীন খাঁ সাহেবের শোকসভার জন্য অপরিহার্য বোধ হয় না। অবশ্য এরপর যুগের প্রয়োজনের কথা তুলে পরিবর্তনের জন্য ধর্ম সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটে বলে, দেহের ক্ষুধার মতো মনের ক্ষুধা মিটবার আয়োজনে স্রষ্টারা জন্ম নেন উল্লেখ করে ক্রমে জমিরউদ্দীন খাঁর মূল্যায়নে প্রত্যাবর্তন করলেন লেখক। চিন্তার কিঞ্চিৎ বিশৃঙ্খলার পরিচয় এ লেখাতেও আছে।

১৯৪০ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র ঈদ পুনর্মিলনীতে সভাপতিত্ব করতে গিয়ে ‘স্বাধীন চিত্ততার জাগরণ’ ভাষণেও নজরুল এক প্রসঙ্গ থেকে হঠাৎ হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছেন। কোরবানির তাৎপর্য এবং আল্লাহকে ফাঁকি দেবার চেষ্টার কথা আগেও দুটি লেখায় যেমন বলেছেন, আরম্ভে এখানেও তা বলছেন। পরবর্তী বক্তব্য, ‘সকল ঐশ্বর্য সকল বিভূতি আল্লার রাহে বিলিয়ে দিতে হবে’ (পৃ. ৩৩)। বলছেন, ইসলামের মহান নীতি বলে ‘ধনীর দৌলত, জ্ঞানীর জ্ঞানভাণ্ডারে সকল মানুষের সমান অধিকার’ (ওই)। আরও বললেন, ঈদের শিক্ষাও তাই। ধনীর উদ্বৃত্ত অর্থে সর্বজনের অধিকার দিয়েছে ইসলাম। কথাগুলো ছড়িয়ে যেতে চায়, তবে লেখক আবার কোনোমতে আগের সঙ্গে পরের একটা যোগসূত্র তৈরি করে নেন।

পরের অনুচ্ছেদে তাঁর কথা, মনের ক্ষুধা মিটাবার জন্যে মানুষের ‘সৌন্দর্য-পিপাসা’র সুধা আসে কবি-সাহিত্যিকের সৃষ্টির ভেতর দিয়ে। বাস্তবের কাঁটার আঘাত থাকে স্রষ্টাদের সৃষ্টির পেছনে। এখানে ব্যক্তিগত পুত্রশোকের আঘাতের পাশাপাশি গৃহপ্রাঙ্গণে প্রস্ফুট হাস্নাহেনার সৌরভ উপভোগের ‘মহানুভূতি’র উল্লেখ করেছেন নজরুল। একই সঙ্গে জীবনের আরও নানা অভিজ্ঞতার কথা, জীবন আর মৃত্যুর যুগপৎ উপলব্ধির কথা লিখেছেন ওই অনুচ্ছেদে। বিচিত্র প্রসঙ্গ অকারণ ভিড় জমিয়েছে এখানটায়।

ঊনশেষ প্যারাতে জরাগ্রস্ত তরুণদের স্থানে জীবনসমৃদ্ধ তরুণদের ওপর আস্থা জ্ঞাপন করছেন নজরুল। ভীরুতামুক্ত যৌবন-তরঙ্গ তাঁর কাম্য। সৃষ্টিকে পুরোদস্তুর উপভোগ করবে যুবকেরা, এই তিনি চান। পরের লাইনেই হঠাৎ লিখছেন, ‘এই জন্যই শ্রদ্ধা হয় এ যুগের বৈজ্ঞানিকদের প্রতি’ (পৃ. ৩৫)। জীবন উপভোগের প্রসঙ্গে আকস্মিকভাবে বৈজ্ঞানিকরা ‘সৃষ্টির রহস্য’ আবিষ্কার করেন বলে নজরুল তাঁদের শ্রদ্ধা করেন বলছেন। এখানে ‘এই জন্য’ পদটি এসেছে অহেতুক।

শেষ অনুচ্ছেদে আছে নজরুলের বরাবরকার প্রিয় কথাভীরুতা, দুর্বলতা, কাপুরুষতা বিসর্জন দিতে হবে’, ‘অধিকারের দাবিতে’ সঞ্জীবিত হতে হবে, কারও কাছে হাত না পেতে ছোট কাজ করে হলেও শ্রমের বিনিময়ে উপার্জন করতে হবে। এই হচ্ছে ‘স্বাধীনচিত্ততার জাগরণ’-এর আহ্বান। বাংলার মুসলিম তরুণদের নিজ জীবনাভিজ্ঞতা বর্ণনা করে আবেদন জানালেন তিনি। শেষ লাইনে আবার বললেন,ইসলামের ইহাই সর্বশেষ্ঠ বাণী, ইসলামের ইহাই মর্মকথা’ (পৃ. ৩৫)।

পূর্বাপর সব বক্তব্য একসূত্রে সংগ্রথিত, এমন বলা বাস্তবিক দুষ্কর।

কালক্রমিক পরবর্তী অভিভাষণের নাম ‘আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ’। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বরে ‘কলিকাতা মুসলিম-ছাত্র সম্মিলন’-এ ভাষণটি দেওয়া হয়। এই সময়ে নজরুলকে আল্লাহতে পূর্ণনিবেদিত বলে মনে হয়। স্রষ্টার জন্য গূঢ় সাধনায় নিয়োজিত আছেন তিনি। তাঁর পিছু ডাকলে ওই যাত্রাপথেই তাঁর মৃত্যু ঘটবে। রহস্যময় বক্তব্যের অবতারণা হলো এভাবে।

পরে সমাজের সমালোচনা করছেন নজরুল। দীর্ঘদিন সম্মাননা নেওয়া থেকে বিরত ছিলেন তিনি, কারণ হিসেবে বলছেন সম্মানের মালায় হাত বাঁধা পড়লে ঈশ্বরের প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়।

আরবি-ফারসি শব্দবহুল ভাষায় দেশ-নেতাদের সমালোচনা করে বলতে চাইছেন, তাঁরা মিথ্যার পথ ধরে জাতিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা ‘সুদখোর কাবুলি’ আর ‘ভীষণ দৈত্যে’র চেয়েও ভয়ানক এবং ‘কূটবুদ্ধি’। স্বাধীন দেশেও ‘শক্তি-মাতাল দানবের উৎপাত চলে’ এ কথা আমাদের কালের জন্যে তাঁর মহা ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হয়। নজরুল নেতৃত্বাভিলাষী স্বার্থান্ধ নেতাদের অশ্রদ্ধেয় জ্ঞান করেন। এরা পিছু হটতেই জানে, বুক ফুলিয়ে অগ্রসর হতে জানে না। অভিযাত্রায় মৃত্যু দেখে ভয় পায়, খেয়াল করে না রোগে ধুঁকে ধুঁকে কত মানুষ মৃত্যুবরণ করছে প্রতিনিয়ত। যুবাদের বাহন করে এরা ‘যশ’ আর ‘ঐশ্বর্য’ ভোগ করে চলেছে, সে-সবের অংশ কি পাবে যুবকরা? না, ঐশ্বর্যের ভাগ কিছুমাত্র নেই ওদের জন্যে। হজরত আর তাঁর সাহাবিদের অন্তরের ঔদার্য থেকে এরা শিক্ষা নেয়নি। নজরুল তরুণদের ডেকে বলছেন, হৃদয়ে অনন্ত ঐশ্বর্য অর্জন করেও ‘নির্লোভ’-‘নিরহংকার’ নেতাকে ডাকতে হবে একমনে। ‘সেই সর্বভয়মুক্ত সর্বভেদ-জ্ঞান-মুক্ত শক্তি-সাধনায় পূর্ণসিদ্ধ মহাপুরুষকে ডাকো তোমাদেরই মাঝে’ (পৃ. ৩৯)। নজরুলকে তরুণরা দলনেতারূপে পেতে চায় বলে এর পরে নজরুল বলছেন, ‘যেদিন আল্লাহ তাঁর এই বান্দার অন্তর-বাহিরের সর্বসত্তাকে তার (Sic) বলে গ্রহণ করবেন আমার বলে কিছুই থাকবে না যেদিন আমার পরম স্বামী পরম প্রভুর দরবার থেকে পাব ফরমান সেই দিন আমি তাঁরই ইঙ্গিতে কর্মে নামব’ (পৃ. ৩৯)। এই কি তবে নজরুলের রহস্যময় সাধনার উদ্দিষ্ট! তিনি এমনকি বলছেন, ‘আল্লাহর রহমত আমি পেয়েছি’, তবে ‘অন্যকে মুক্ত করবার শক্তি তিনি দেননি’ (ওই)। কয়েক পৃষ্ঠাজুড়ে এই সব কথার পরে ভক্তদের নজরুল বলছেন, ‘লিডারের কাছে শক্তি ভিক্ষা করো না আল্লাহ এতে নারাজ হন শক্তিভিক্ষা করো একমাত্র আল্লাহর কাছে’ (পৃ. ৪২)।

কর্মের সাধনার উপদেশ নয় এখন, আল্লাহর কৃপার অপেক্ষা। নজরুলের বক্তব্য অনেক কাটছাঁট করেও মূল বক্তব্য মোটামুটি বিস্তৃতভাবেই তুলে ধরা হলো। নজরুলের এই পাগলপ্রায় গূঢ় সাধনাকে এরপর তিনি নিজেই ‘মিস্টিসিজম’-এর সাধনা বলে অভিহিত করবেন। নজরুল–মানসের এই বিবর্তনধারা বুঝে নেবার জন্যেই অভিভাষণগুলোকে কালানুক্রমে সাজিয়ে আলোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি।

নজরুলের ‘রসলোকের তৃষ্ণা’ অভিভাষণটির সাল–তারিখ জানা যায়নি। কথাসাহিত্যিক আবু রুশ্‌দদের কলকাতার বাসভবনের এক ঘরোয়া আসরে নজরুল এ লেখাটি পাঠ করেন। আবু রুশ্দের ‘আত্মজীবনী’তে এই ভাষণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ‘রসলোকের তৃষ্ণা’তে প্রথম দিকে নজরুলের বক্তব্য, ‘রসলোকে একমাত্র যেতে পারেন শিল্পী, কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ’ (পৃ. ৫০)। আর আল্লার কৃপাতেই শুধু সেই রসলোকের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। পবিত্র কোরআনে সুরা নূর পড়ে নজরুলের মনের আবরণ মোচন হয়েছিল। সেখানে পৌঁছানো গেলে কবি-শিল্পীরা আল্লার ‘সখা’ (খলিলুল্লাহ) হতে পারেন। তাঁদের মনে ভেদ জ্ঞান থাকে না, তাঁদের ‘রসবোধে’ ভয়ভীতি বা অভাববোধ থাকে না। প্রশ্ন তুলেছেন উচ্চ রসলোকে যাঁরা যেতে চান, তাঁরা কি ‘এস্কেপিস্ট’? তারপর জানাচ্ছেন, ওপরে উঠে তাঁরা যখন বারি বর্ষণ করেন তখন তাতেই তৃষিত মাটিতে প্রাণ জাগে। রসলোকে পৌঁছে যিনি আল্লার কাছে সর্বসমর্পণ করতে পারেন, তিনি আর মাটিতে ফিরে আসেন না। ওই সময়ে নজরুল এই অধ্যাত্ম উপলব্ধিতে পৌঁছেই অন্য লেখাতেও বলেছেন ‘তাঁর সান্নিধ্য’ তিনি পেয়েছেন। আরও বলছেন, সমর্পণ অবশ্য ঘটে না সচরাচর। অন্যলোক তথা অন্যজগতের ভাবনায় নজরুল এই সময়ে মশগুল। ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণায়ও গভীর রাত্রিতে নজরুলের ওই সাধনার কথা আছে। নজরুল বলছেন শৈশব থেকেই তিনি কবিতা-গান-শিল্পচর্চার ভেতর দিয়ে সাধনা করে এসেছেন।

আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি পঞ্চম খণ্ডে আছে (পৃ. ১৮০) কবি আবুল হোসেনকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আবু রুশ্দ্দের বাড়িতে কালচারাল মজলিশের যে-অনুষ্ঠান হয়েছিল, তাতে নজরুলের আলোচ্য বিষয় ছিল, “নন্দনতত্ত্বের আলোচনা”। সেদিনকার কবির মূল কথা কী ছিল?’ জবাবে কবি আবুল হোসেন বলেন যে, ‘শিল্পের সৌন্দর্যতত্ত্ব’ নিয়ে বলেন নজরুল। রাজনৈতিক কথাবার্তা বলেননি, বরঞ্চ ‘শিল্পত্বই শিল্পে মূল্যবান’ মত প্রকাশ করে সবাইকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু নজরুলের বক্তব্যে দেখছি তিনি আধুনিক কবিদের উদ্দেশে বলছেন, ‘পাঁক-কে ঘৃণা করি না আমি, কিন্তু তোমরা পাঁক ঘাঁটো, পাঁক থেকে উঠতে চাও না, জাগ্রত চেতনা আনতে হবে তোমাদের, তার অনুভূতি-বেদনা আসবে পরম আনন্দলোক থেকে। এই আনন্দলোকে স্থিত হতে চেষ্টা করো, দেখবে কাদার মধ্যে মুক্তোর সন্ধান পাবে’ (পৃ. ৫২)। এ তো নন্দনতত্ত্বেরই উপলব্ধি। এতে বিস্মিত হবার মতো নতুন কিছু তো নেই! মুক্তো ফলানোতেই তো সাহিত্যের সার্থকতা, জানি আমরা।বোদলেয়ারের ‘ক্লেদজ কুসুম’-এর কথাই কি মনে পড়ে না এখানে? রসলোক থেকে মানুষকে ভালোবাসবার প্রেরণা লাভ করতে বলছেন নজরুল। বলছেন ‘ কালচারকে রসায়িত করতে চেষ্টা করুন, নতুবা কালচার-এ কালচে পড়ে যাবে’ (ওই)। পরবর্তী যে কথায় ‘শিল্পত্বই শিল্পে মূল্যবান’ মনে হতে পারে, তা উদ্ধৃত করি ‘আধুনিক কবিতায় অতি-প্রকাশ একটা রুগ্ন নগ্নতা মাত্র, চোখে ভালো ঠেকে না’। শেষে এ কথা বললেও ভূমিকাতে তো মুক্তোর কথা স্পষ্ট বলেছেন। উপসংহারে আবার বলছেন, ‘এখন নগ্নতারও একটা রস আছে। আমাদের বৈচিত্র্যপিয়াসী মন নগ্নতাকে আবরণ দিয়ে সাজিয়ে দেখতে চেষ্টা করে—এই যে আবরণের মধ্যে অনন্ত নিরাবরণ দেখতে পাই, এই হচ্ছে পরম সুন্দর’ (ওই)। বিস্ময় বোধ করি, ঊর্ধ্বলোকের সাধনায় নিমগ্ন খানিক মত্ত অবস্থাতেও নজরুল নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর গভীর উপলব্ধি এমন ভাষায় লিখতে পেরেছেন!

আশঙ্কা করি, লেখার প্রথম দিকের অধ্যাত্ম উপলব্ধির প্রবল উপস্থিতিতরুণ কবি-সাহিত্যিকেরা প্রলাপের মতো মনে করেছিলেন বলে হয়তো শেষের সত্য কথাগুলোতে তত মনোনিবেশ করতে পারেননি। আল্লাহ আর রসলোক নিয়ে বলতে গেলে নজরুল খ্যাপার মতো হয়ে উঠতেন, সে আমরা সেই কালের অন্য লেখাতেও দেখেছি। ভাষণের শেষে:

 ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাব

তবু আমারে দিব না ভুলিতে’

গানের উদ্ধৃতি একেবারেই পূর্বাপর সম্পর্কশূন্য, বলতেই হবে।

‘অভিভাষণ’ সংকলনে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা’ ভাষণের পর ‘রসলোকের তৃষ্ণা’ ছাপানো হয়েছে। কাল অনুক্রমে অভিভাষণগুলো পড়লে ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত নজরুলের চিন্তাধারা আর ভাষাভঙ্গির সঙ্গে ‘রসলোকের তৃষ্ণা’ লেখার প্রভূত মিল লক্ষ করা যায়। বিশেষত ডিসেম্বর ১৯৪০-এ ‘মুসলিম ছাত্র সম্মেলনে’ প্রদত্ত নজরুলের ‘আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ’-এ যে-রকম আল্লাতে সর্বসমর্পণ এবং রহস্যময় সাধনার পরিচয় রয়েছে, ‘রসলোকের তৃষ্ণা’তেও সেই ধরন স্পষ্ট। ধারণা হয়, এ লেখা নজরুল চল্লিশ সালের দিকেই লিখে থাকবেন।

১৯৪০ সালে ‘শিরাজী’ নামে কেবল নয়টি বাক্যের একটি ভাষণ দেন নজরুল। শিরাজী সম্পর্কে নজরুলের গভীর শ্রদ্ধার কথা তাঁর সিরাজগঞ্জের সুদীর্ঘ ভাষণেও আছে। আলোচ্য সভাটি ‘শিরাজী পাবলিক লাইব্রেরি ও ফ্রি রিডিং রুম’-এর উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত হয়। সভাপতি নজরুল বলেন যে, শিরাজীর মতো তাঁর নিজ কাব্যেও ‘অনল প্রবাহ’ আছে। ছোট এই লেখাটি সুসংবদ্ধ। ক্ষুদ্র পরিসরের দরুনই হয়তো এ লেখায় নজরুল খেই ধরে রাখতে পেরেছেন।

১৯৪১ সালে মার্চের মাঝামাঝি বনগাঁর এক সাহিত্যসভায় সভাপতির ভাষণে নজরুলকে ধীর এবং প্রশান্তভাবে তাঁর রহস্যময় সাধনার উল্লেখ করতে দেখব। এই লেখার ভাষায় আরবি-ফারসির মিশাল দেখতে পাব না। যে-ভাষায় নজরুল বরাবর লিখে এসেছেন সেই প্রমিত ভাষাতেই ভাষণটি রচিত। পূর্ববর্তী অভিভাষণের মতো এ ভাষণেও বলছেন, ‘গভীর সমাধির অতল গহ্বরে প্রবেশ’ করে তিনি তাঁর ‘চির-চাওয়া পরমসুন্দরের... অনন্ত প্রেম, আনন্দ, অমৃত, রস ও লীলা’ দেখেছেন। এখন, ‘পরমসুন্দর’  তাঁকে সেসব ‘প্রকাশের শক্তি’ দিলে তিনি ওই ‘রসঘন’ রূপ ‘ছন্দে গানে সুরে’ ফুটিয়ে তুলতে পারবেন। আরও বললেন, ‘আমার বাঁশিতে যে সুর বাজত¾যে বাঁশি আমি অভিমানে দিয়েছিলাম ফেলে, সেই হারানো বেণু আবার ফিরে পেলাম সেই চির-সুন্দর লোকের অশ্রুমতী নদীর তীরে’ (পৃ. ৪৩)।

 পরের অনুচ্ছেদে উল্লিখিত কথাগুলোকে ‘মিস্টিক তত্ত্ব’ বলছেন। আর, মিস্টিসিজমের মধুই এখন কেবল তাঁর কাছে ‘মধুরম্’। তাঁর ‘সাহিত্যসাধনা’য় তিনি ‘ইন্টারনাল এক্সজিসটেন্স’-কেই খুঁজে এসেছেন, বললেন। এখন, বাঁশিতে সুর খুঁজে পেলে তিনি আবার তা বাজিয়ে ধন্য হতে পারবেন বলে বক্তৃতা শেষ করেছেন।

মুসলিম সমাজের আমন্ত্রণে পরপর কয়েকটি ভাষণ লিখতে গিয়ে ‘যাবনি মিশাল’ ভাষা ব্যবহার দেখে মনে হয়েছিল বনগাঁয় আয়োজিত সম্মেলনের দর্শক-শ্রোতা সম্ভবত অমুসলমান হওয়াতেই নজরুল প্রচলিত মান-বাংলায় এ বক্তৃতা লিখেছেন। কিন্তু আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডে কবি আবুল হোসেনের এক সাক্ষাৎকারে (পৃ. ১৮২) মান্নান সৈয়দ বনগাঁর সভা বিষয়ে কবিকে যে প্রশ্ন করেছিলেন, তা থেকে ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মান্নান সৈয়দ আবুল হোসেন সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন১৯৪১ সালে বনগাঁর সাহিত্যসভায় আপনারা শ্রোতা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। আপনি লিখেছেন (‘নজরুল ইসলাম: কিছু স্মৃতি’ দ্রষ্টব্য: ১৩৯৩-এর নজরুল একাডেমী-পত্রিকা শীত-বসন্ত সংখ্যা), “সেদিন সব শ্রোতাকে চমকে দিয়ে সভার শেষ প্রান্ত থেকে তিনি (শওকত ওসমান) প্রায় লাফিয়ে উঠে স্বভাবজ ভঙ্গিতে মঞ্চের দিকে ছুঁড়ে দিলেন কিছু চোখা-চোখা শব্দ।” এই কথাগুলো কী ছিল?’ জবাবে কবি আবুল হোসেন বলেন, নজরুল ইসলামের সেদিনকার ভাষণের বিষয় ছিল অধ্যাত্মতত্ত্ব–সম্পর্কিত, যোগ বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন, ... তার (শওকত ওসমানের) মূল কথা ছিল যোগ সম্পর্কে কটূক্তি। শওকত ওসমান অবৈজ্ঞানিকতার কথা বলেছিলেন।” (ওই)।

‘মধুরম্’ ভাষণের আগের কটি অভিভাষণের বক্তব্যেও ওই অবৈজ্ঞানিকতা এবং যুক্তিশৃঙ্খলার অভাব নিয়ে প্রশ্ন জাগে বাস্তবিক। তবে নজরুল যে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ছেন, লক্ষ করলে তা-ও অনুভব করা যায়।

৬ এপ্রিল ১৯৪১-এ নজরুল ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’র রজতজয়ন্তীতে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ নাম দিয়ে সভাপতির ভাষণ দেন।বাঁশির কথা চলে আসছে আগের অভিভাষণ থেকেই ‘মুসলিম সাহিত্যসমিতি’র এ ভাষণে নজরুল প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন। রচনার শিরোদেশে সম্পাদক এটিকে ‘জীবনের... শেষ অভিভাষণ’ বললেও, তা ঠিক নয়। ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা’ নামের এই রচনাটির ওপর মন্তব্য লেখা রয়েছে, ‘১৯৪১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর হাওড়ায় রবীন্দ্র স্মরণসভায় নজরুলের ভাষণ। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ১৫ দিন পরে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর তারিখ ৭ আগস্ট ১৯৪১ সাল। মৃত্যুর ১৫ দিন পরে হলে এই লেখার তারিখ হয় ২২ আগস্ট ১৯৪১। সে ক্ষেত্রে ভাষণের তারিখ ৭ সেপ্টেম্বর হতে পারে না। সম্পাদকমণ্ডলী রচনাকাল নিয়ে এই বিভ্রান্তি দূর করলে পাঠককুল উপকৃত হবেন। এরপরও নজরুল ১৯৪১-এ রবীন্দ্রপ্রয়াণের পরে এক স্মরণসভায় বক্তৃতা করেন।এই লেখাটিও ‘রসলোকের তৃষ্ণা’র মতো, পরে সংগৃহীত হয়েছে বলে পূর্বে রচনাবলিতে সংকলিত হয়নি।

যা হোক, ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ ভাষণের বক্তব্যও তাঁর ১৯৩৬ থেকে লেখা অভিভাষণগুলোর মতো ‘আল্লার সান্নিধ্য লাভ’ ‘আল্লার পথে আত্মসমর্পণ’ ইত্যাদি প্রসঙ্গে পূর্ণ।থেকে থেকে লেখাতে সমাজের দুর্নীতি-বিষয়ে তরুণদের জন্যে নানা নির্দেশনাও এসেছে।‘হিন্দু-মুসলমানে হানাহানি’, ‘যুদ্ধ-বিগ্রহ’, ‘দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব’-এর পাশে পাশে লোভীদের টাকার পাহাড় তৈরি ইত্যাদি নিয়ে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আমন্ত্রণকারীদের বলছেন, তিনি আর আগের সেই নজরুল নেই।এখন তাঁকে সভাস্থলে ‘কর্মজগতের ভিড়ে নেমে’ আসতে হলে ‘পরমসুন্দরের সান্নিধ্য’ ছেড়ে আসতে হয়। ঈশ্বর তাঁর ‘আমিত্বকে গ্রহণ করেছেন’। সেই বন্ধন ছেড়ে নেমে আসবার উপায় আর তাঁর নেই।ভবিষ্যতের আশা জানিয়ে বলছেন, ‘আমি যদি আসি, আসব হিন্দু-মুসলমানের সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম তাঁরই দাস হয়ে’ (পৃ. ৪৮)।‘সাহিত্য সমিতি’র পুরাতন বন্ধুদের স্মরণ করে, তাঁদের আশ্রয় লাভ করেই ‘কবি’ হতে পেরেছিলেন বলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবার সময়ে নজরুল যথেষ্ট আনন্দিত আর স্বাভাবিক। লেখাটি এ রকম আলোছায়ায় ঘেরা।

একচল্লিশ সালে ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা’ ভাষণই তাঁর শেষ বক্তৃতা, আগে বলেছি। লেখাটি আগাগোড়া সংবদ্ধ ঠেকে না। রচনাটির শুরুতে নজরুল আপনাকে ‘শক্তির উপাসক’ বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘সৃষ্টির সৌন্দর্য’ বিষয়ে মনোযোগী হয়ে অন্তর্গতভাবকে কাব্যে ফুটিয়ে তুলতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় খাঁটি শিল্পীকে প্রত্যক্ষ করেন নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্রনাথের বরাত দিয়ে বলছেন, ‘চাই বড় হবার জন্য অগাধ তৃষ্ণা, চাই শক্তিলাভের তৃষ্ণা’ (পৃ. ৫৪), আর ‘কর্তব্যকর্মে’ নিষ্ঠা। জাতির মধ্যে ওই সবে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বলে নজরুল দুঃখ করেছেন। এ দেশ ‘স্রোতহীন জলাশয়ের’ মতো বলে এতে পঙ্ক বেশি, গতি তাই ব্যাহত, জীবন স্থবির। অগ্রগতির জন্য যেমন গতিচাঞ্চল্য প্রয়োজন, তেমনি দরকার সাধনার শক্তি। উঁচু আদর্শ নিয়ে বৃহতের অভিমুখে চলতে হবে। নিশ্চল বদ্ধ অবস্থায় থেকে ‘পরম পিতা’র সাধনাও সম্পূর্ণ সার্থকতা পায় না।

রবীন্দ্রনাথ জীবনকে চিনামাটির পেয়ালার সঙ্গে তুলনা করে বাটির ফাঁকা অংশটাকে রসে পূর্ণ বলেছিলেন। অর্থাৎ জীবনের অবকাশটাই রসে ভরা। রবীন্দ্রনাথ সেই রস আহরণ করে তাঁর সাহিত্যকে সুধায় ভরে তুলতেন।এখানে নজরুল হঠাৎ নিজের ভগবানের কথা তুলে বললেন, তাঁর ঈশ্বর সর্বজনের। সঙ্গে সঙ্গে মুহম্মদ (সা.) অভুক্ত মানুষকে কেমন করে নিজের মুখের গ্রাস তুলে দিয়েছিলেন সে কথা এল। অসংলগ্ন ঠেকলেও পরেই আবার বক্তব্যকে অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন এভাবে, ‘এই যে সমাজ এই যে সংসার তরুলতা কীটপতঙ্গ নিয়ে যার সৃষ্টি এটাই তো আমার ভগবান’।

পরের অনুচ্ছেদে ‘গরিব দেশে নেতা’ না হয়ে ‘নচিকেতা’র মতো যমের সাক্ষাৎ পাবার চেষ্টা করাই ভালো, বললেন হঠাৎ।পঞ্চভূতের ‘অধিপতি’ যমরাজই ‘ধর্মরাজ’ও বটে। এই নামের সৌন্দর্য থেকে নজরুল কোরআন আর গীতাতে মিল দেখতে পাচ্ছেন। এর পরে এল সমাজসেবার কথা। তারপর ‘R-এর value’ সমস্যা মেটাবার জন্যে বললেন, ‘কালী’, ‘কোরান’ আর ‘ভগবান’কে ধরতে হবে। আরও কথা, ‘আকর্ষণ বিকর্ষণময় জগতে কৃষ্ণ করেন আকর্ষণ। বলবান করেন বিকর্ষণ’। রবীন্দ্রনাথের শোকসভায় এসব বাস্তবিক কতদূর প্রাসঙ্গিক? উপসংহারে বলবীর্যহীন যুবসমাজের সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথে ফিরে বললেন, ‘শক্তি চাই, তবেই রবীন্দ্রনাথকে বোঝা যাবে’ (পৃ. ৫৫)। যুবারা শক্তির সাধনা করে যোগ্য সৈনিক হয়ে ‘শক্তির পূজারী’ রবীন্দ্রনাথকে জানলেই কবির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জানানো হবে বলে ভাষণ শেষ করেছেন।

বোঝা যায়, ১৯৪২-এ পুরোদস্তুর অসুস্থ হয়ে পড়বার আগে থেকেই নজরুলের কথাবার্তা অসংলগ্ন হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিনে কি করে ‘রবি-হারা’ কবিতা রচনা করে কলকাতা বেতারে পাঠ করেন আর ওই কবিতা এবং ‘ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না, জাগায়ো না’ গান রেকর্ড করেন, ভাবলে বিস্ময় হয়।

আমরা জানলাম, ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা’ ভাষণই পুরোদস্তুর অসুস্থ হয়ে পড়বার আগে নজরুলের দেওয়া শেষ অভিভাষণ। আর, এতে অসংলগ্নতা সুস্পষ্ট।

তিন.
সবশেষে নজরুলের ভাষা প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করা সঙ্গত বোধ করছি। নজরুল ‘যাবনী-মিশাল’ দোভাষী পুঁথির ভাষাকে বাংলা সাহিত্যে, বিশেষত গদ্যে, প্রতিষ্ঠা করে গেছেন বলে কিছু প্রাবন্ধিকের প্রশংসা ও সে বিষয়ে সন্তোষের প্রকাশ দেখা যায় (যেমন: ‘আমাদের ঋণ’, নির্বাচিত প্রবন্ধ, আহমদ ছফা। মাওলা ব্রাদার্স ২০০২)। মুসলিম তরুণদের আয়োজিত সভার ভাষণে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নজরুল আরবি-ফারসি শব্দ এমনকি বাক্যাংশও ব্যবহার করেছেন। আর তার অধিকাংশ, হিন্দু বা মুসলিম কারোরই, বুঝতে অসুবিধা হয় না।যেখানে অপ্রচলিত শব্দ বা বাক্যাংশ লিখছেন, সঙ্গে সঙ্গে তার অর্থও লিখে যাচ্ছেন। লক্ষণীয় যে, ভাষণের আদ্যোপান্ত আরবি-ফারসির মিশেলে লেখা নয়, মান বাংলা ভাষা, যা সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল বাঙালির কাছেই বোধ্য। চট্টগ্রামের ভাষণ ‘মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা’, ফরিদপুরের বক্তৃতা ‘বাঙলার মুসলিমকে বাঁচাও’, কলকাতার ঈদ সম্মিলনীর কথন ‘স্বাধীনচিত্ততার জাগরণ’, আর কলকাতায় ‘মুসলিম-ছাত্রসম্মিলন’-এর ভাষণ ‘আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণ’ এই চারটি লেখাতেই প্রভূত পরিমাণে যাবনী-মিশাল আছে। আরও গোটা কয় ‘যাবনী’ শব্দ আছে কলকাতায় কথাশিল্পী আবু রুশ্দদের বাসার মজলিশে বলা তাঁর ‘রসলোকের তৃষ্ণা’তে। যেমন রওশন, রুহুল আজম, রহমা আর খলিলুল্লাহ। তবে লেখাতে আগাগোড়া ওই মিশাল নেই। এ থেকে বাংলা গদ্যে দোভাষী পুঁথির ভাষাকে প্রতিষ্ঠা দেবার কী প্রমাণ পাওয়া গেল, বুঝতে পারা যায় না। সন্দেহ নেই, নজরুল দক্ষতার সঙ্গে বাংলাভাষাতে আরবি-ফারসি শব্দ মিশিয়েছেন এবং তাতে বিশেষত বাংলা গদ্য নতুন মাত্রা পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। কিন্তু মুসলিম সমাজে চর্চিত দোভাষী পুঁথির প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাবোধ থেকেই নজরুল ভাষায় ওই মিশাল দেন, অতি নিশ্চিতভাবে তা বলার যুক্তি পাওয়া যায় না। ভাষাসচেতন নজরুল আপন সাহিত্য সৃষ্টিতে তাঁর বক্তব্যের উপযুক্ত ভাষা সৃষ্টি করে নিয়েছিলেন, এই মাত্র বলা যাবে। মুসলমানের ভাষা আর হিন্দুর ভাষা নিয়ে সম্প্রদায়কেন্দ্রিক বিবেচনা নজরুল নিজেও কখনো পছন্দ করতেন না, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত পড়বার পর এই মন্তব্য নিশ্চিতভাবে ঘোষণা করা যায়। সকল বাঙালির জন্য শক্তিশালী গদ্য ভাষায় নজরুল তাঁর বক্তব্য তুলে ধরে আমাদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলামের মস্তিষ্কের বিকলতার জন্য আমরা বেদনা বোধ করি। মনে হয়, যথাযথ চিকিৎসা হলে জীবনশেষে নজরুলকে অত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। এই দুর্ভাগ্যজনক অসুস্থতার জন্য আমরা যথার্থভাবেই তাঁর চিকিৎসার অব্যবস্থাকে দায়ী করে থাকি। আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলির পঞ্চম খণ্ডে নজরুলের দীর্ঘ সময়ের চিকিৎসক ডা. ডি. কে. রায় এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন (পৃ. ২২১), ১৯৪২-৪৩ সালে তখনো রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন উন্নত বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার চল হয়নি। ফলে তখনকার রক্ত পরীক্ষা থেকে ধারণা করা হয়েছিল নজরুলের স্মৃতিভ্রংশের কারণ সিফিলিস রোগ। সৈনিকের পেশায় ছিলেন বলে সিফিলিস রোগ থেকেই তাঁর জেনারেল প্যারালাইসিস অফ ইনসেন্স হয়ে থাকবে ভাবা হয়। ১৯৬৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে নিউরোলজিতে এমআরসিপি করে আসা ডা. ডি. কে. রায় নজরুলের চিকিৎসায় যুক্ত হন। তখন ইনিও নজরুলের GPI হয়েছে, ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করলেও পরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, রোগীর ‘GPI নেই’। পরীক্ষা করে জেনেছিলেন, তাঁর শরীরে সেই রোগের কিছুমাত্র লক্ষণ ছিল না। বরং নজরুলের রোগটি হলো Presenile Dementia। এ অসুখে দুটি রোগের লক্ষণ থাকে, যার একটির নাম ‘আলজিমাটিক ডিজিস’। ডা. রায় বুঝলেন, নজরুলের আলঝেইমার নামে স্মৃতিলোপের অসুখ হয়েছিল। ঢাকাতে নজরুলের চিকিৎসায় নিযুক্ত দুজন ডাক্তারও তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালে ঢাকার নজরুল ইনস্টিউটে অনেক ডাক্তার এবং শ্রোতা-দর্শকের সমক্ষে ডা. ডি. কে. রায় নজরুলের রোগ নির্ণয়ের প্রমাণাদি উপস্থাপন করেছিলেন।

বোঝা যায়, মিথ্যা সন্দেহের দরুনই বাস্তবিক, ভুল পথে চিকিৎসা হওয়াতে নজরুলের সত্যিকারের চিকিৎসা ব্যাহত হয়। আরও দুঃখের বিষয়, এখনো মানুষজন নজরুলকে সিফিলিস রোগী বলেই মনে করেন।

রাঁচি মানসিক হাসপাতালে নজরুলের অবাঙালি চিকিৎসক ডা. মেজর আর. বি. ডেভিসের মেডিকেল রিপোর্টে নজরুল বিষয়ে দুটি গভীর পর্যবেক্ষণ আমাদের বিস্মিত করে। তাঁর ‘অভিভাষণ’-এর কালক্রমিক আলোচনা থেকে যা বোঝা যায়, তার একটি কথা ডা. ডেভিসও বিবৃত করেছেন। ১৯৪০ সালের পরে নজরুল আল্লাহ্‌র রাহে নিবেদিত হয়ে মিস্টিসিজমের দিকে অগ্রসর হন (‘Following, 1940, however, there was some change in the nature of his poetry which became more tinged with religion and mysticism.’)। আর দ্বিতীয় কথা, নজরুল প্রচণ্ড ক্ষোভের সঙ্গে মনে করতেন যে তাঁর প্রাপ্য অর্থ থেকে অনেকে তাঁকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে (‘… obsessed with the idea that people were taking advantage of his mental condition.’)। বাস্তবিক, উন্মাদ রোগের পেছনে প্রবল মানসিক চাপ কাজ করেছে।

আমরা তো জানি, পত্রিকা সম্পাদক আর প্রকাশকেরা নজরুলকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন। সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে তাঁর ভালো ভালো বইয়ের স্বত্ব কিনে নিয়েছেন। নজরুলের ‘পত্রাবলি’ পড়লে দেখা যায় দশটি টাকার জন্য তিনি কতজনকে কাতর অনুনয় করে চিঠি লিখেছেন! তাঁর ‘পত্রাবলি’র ‘এক’ নম্বর পত্র (২৩ জুলাই ১৯১৭-তে লেখা) থেকে শুরু করে ১৭ জুলাই ১৯৪২-এ অসুস্থ অবস্থায় সুফি জুলফিকার হায়দরকে লেখা চিঠি (পত্র নং উনআশি) পর্যন্ত বহু পত্রে অর্থকষ্টের প্রসঙ্গ পাওয়া যায়। চিকিৎসা, বাড়িতে অসুখবিসুখ, ‘পাওনাদারদের তাগাদা’ আর নবযুগ-এর দুশ্চিন্তা থেকে নজরুলের ‘nerves shattered’ হয়ে যাবার সংবাদ পাই। নজরুল দোসরা জানুয়ারি ১৯২৯-এ আবদুল কাদির সাহেবকে লেখা চিঠিতেও (পত্র নং সাতচল্লিশ) দুঃখ করেছিলেন, ‘এতদিন আমার পাবলিশাররাই আমায় ঠকিয়ে এসেছে’। এ সমস্ত প্রতারণা ও অর্থকষ্ট থেকে ভয়ানক ক্ষোভগ্রস্ত নজরুল ধ্বংসের পথে যান। কিছু আলোচকের ধারণামতো এ বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক বলা যাবে না, কারণ হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে এ ব্যবহার করেছেন সকলেই। ধিক্‌ মানুষের লোভ আর প্রতারণার নিষ্ঠুরতাকে। দেশের-জাতির মানসসম্পদবিধ্বংসী এই সব প্রবণতাকে ধিক্কার জানাবার ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না। দুর্ভাগা এই দেশ আর জাতি।