মাহমুদার কাছে যাওয়া না-যাওয়া

কাকের ডাকে ভেঙে যাওয়া কর্কশ সকালটা মাহমুদার ফোনে হঠাৎই ঝনঝনিয়ে যায়। কোথা থেকে, কেন, কীভাবে, কী হয়েছে-এসবের বিন্দু পরিমাণ কিছু না বুঝেই খাবি খেতে খেতে ধারণা করতে পারি, মাহমুদা ফিরেছে। হয়তো একেবারেই ফিরেছে। ছুটির সকালের ঘুমটা চটকে যায়। মাহমুদা বলে, এক্ষুনি আসো!
আমি প্রস্তুতি নিতে থাকি। মাহমুদা… যাকে আমি ভালোবেসেছি সাকল্যে তিনবার। দুটি অভিন্ন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এই তিনটি ভালোবাসা এতটাই পরস্পরবিরোধী যে কখনো কখনো মনে হয় এই ব্যক্তিগুলো আসলে একে অপরকে চেনেই না।

মাহমুদা কানাডা চলে যাওয়ারও অনেক আগে, আমাদের যে একমাত্র মাঠ ছিল মফস্বলে, যেখানে শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন আর গ্রীষ্মের বিকেলে বুড়িচু হতো, আমি আর মাহমুদা তাতে নিষ্ঠাবান খেলোয়াড় ছিলাম। মাহমুদা এক ক্লাস ওপরে বলে তখন নীলড্রেস গার্লস হাইস্কুল আর আমি ছেড়ে দিতে চাওয়া ছোট হয়ে আসা হাফপ্যান্ট। মাহমুদাকে তখন পাড়ার সম্পর্কে ‘মামা’ ডাকি আমি, বলি মাহমুদামা…আর সে আমাকে আমার নাম ধরে আলস্য ও তাচ্ছিল্য মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে ডাকে। খুব রাগ করতে চাই আমি, কিন্তু মাহমুদামার ওপর রাগ করে এমনকি তার বাবাও থাকতে পারে না। আমি তাই শুধু ঘোরলাগা চোখে তাকে দেখি আর বুড়িচু খেলায় একদিন বউ ধরতে গিয়ে তার কামিজ ধরে টান দিই। তাতেই ভেতরের সাদা সেমিজ বেরিয়ে এলে এক নিষিদ্ধ সুন্দর আমাকে জাপটে ধরে অনেক দিনের জন্য। আমি মাহমুদামাকে ভালোবেসে ফেলি।

ভালোবেসে ফেলি, কিন্তু বলার জন্য যে সাহস ও জেদ, তার কোনোটাই আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে না। অথচ মাহমুদামার চিহ্ন ধরে আমি ঠিকই পৌঁছে যাই আমবনে, নদীতে, ব্রিজে। বাতাসে তার ছেড়ে যাওয়া আমলার ঘ্রাণ। আর আমার ভেতর বাড়তে থাকে তালা। গোপন এবং গোপন নিয়ে শৈশবের কবাট বন্ধ হতে থাকে। আমি আরও চুপচাপ হয়ে যাই, হয়ে উঠি আরও বেশি কল্পনাপ্রবণ। কিন্তু তত দিনে মাহমুদামা কলেজ ছুঁয়ে ফেলে। আর আমি তার ঘ্রাণও ছুঁতে পারি না। আমার হাফপ্যান্টগুলো অবহেলায় আলনায় মাথা গুঁজে পড়ে থাকে। নতুন প্রেমের মতো দুটো ফুলপ্যান্ট আমাকে সব সময় আঁকড়ে ধরে রাখে। মাহমুদামার সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে। বাড়তে বাড়তে একদিন ভুলে যাই তাকে আমি ভালোবেসেছিলাম!

এরপর অনেকটা সময় শহরে কলেজপড়ুয়া মাহমুদার কোনো খোঁজ আমি রাখি না। আমি তাকে ভুলতেই বসেছিলাম। কিন্তু মাহমুদার বিয়ের খবরের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেও যখন মফস্বলে ফিরল, তখন তাকে একবার দেখতে যাওয়ার সাবেকি ইচ্ছা আমার হলো। বাড়িতে বিয়ের ধূম…তার মধ্যে মাহমুদা কেমন উচ্ছ্বল…ভীষণ ঈর্ষা হলো আমার। মনে হলো, মেয়েটাকে শক্ত করে ধরে নিয়ে চলে যাই নিমবনে। চোয়ালটা সাঁড়াশি হাতে চেপে ধরে বলি, ভালোবাসি! তারপর কামড়ে খুবলে নিই কণ্ঠনালি! বুকের ভেতর রক্তের দ্রিম দ্রিম শুনি ফুলপ্যান্টের দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে। আবারও ভুলে যাই, মাহমুদাকে আমি শৈশবে একবার ভালোবেসেছিলাম। ভুলে যাই, এই একটু আগে তীব্র ঈর্ষা নিয়ে মাহমুদাকে আমি আমার সমস্ত দিয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলাম!
মাহমুদা বলে, ‘ওহহো, তুমি? কেমন আছ?’
আমি একটা লম্বা উত্তর দিতে চাই, কিন্তু তার আগেই সেখান থেকে সরে যায় মাহমুদা। বুঝতে পারি, আমার উত্তরের কোনো প্রয়োজন আসলে তার নেই।

অনেক অনেক অনেক দিন পর, মাহমুদাকে পাই ফেসবুকে। কী আশ্চর্য! মাহমুদা কানাডায় থাকে…কী আশ্চর্য, মাহমুদার সঙ্গে এখন চাইলেই কথা বলা যায়! মাহমুদাকে ‘তুমি’ করে বলা যায়, চাইলে তুইও। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, মাহমুদা জানত আমার হাফপ্যান্ট পরা শৈশব আমি তাকেই উৎসর্গ করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে আমি হেসে জানাই, আমার ফুলপ্যান্ট পরা কৈশোরও আসলে মাহমুদাতেই ছিল! মাহমুদা হাসে। আবার কাঁদেও। হাসে আর কাঁদে। কাঁদে আর হাসে। তার ডাক্তার স্বামীটি একটা পাকিস্তানি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। তাকে নিয়েই এখন সে থাকে। কানাডায়, বলতে গেলে, মাহমুদা এখন, একার চেয়েও অনেক বেশি একা।

আমার ভেতর থেকে হাফপ্যান্ট ফুলপ্যান্ট জেগে ওঠে। মাহমুদা কেন একা হবে? আমার শৈশব, আমার কৈশোর আর আমার যৌবন…সবই মাহমুদার!

দুই.
রিকশা নিয়ে ছুটি। গত এক বছরের ফেসবুক চ্যাটে আমরা এখন পরস্পরকে আগের চেয়ে ঢের বেশি চিনি জানি। মাহমুদা কানাডার রান্না খুব পছন্দ করে। অবশ্য সবচেয়ে পছন্দ করে সামুদ্রিক খাবার। অক্টোপাস খেয়ে তার কী ভীষণ উচ্ছ্বাস!
আমি অবশ্য পারি না। কোথাও গিয়ে একটু বেশি খেলে, কিংবা সীমালঙ্ঘন করতে গেলেই কেমন যেন গা গুলায় আমার। মাহমুদা চ্যাটবক্সেই বলে, ‘গাঁজা খেয়েছ কখনো?’
: একবার। আর কখনো খাইনি।
: আমি মাঝে মাঝে টানি কিন্তু।
: আচ্ছা।
: তোমাকে যদি বিয়ে করি, গাঁজা খেতে দেবে আমাকে?
: আমাকে বিয়ের প্রসঙ্গ আসছে কেন?
: কেন? আমাকে বিয়ে করবে না তুমি? তুমি তো আমার কথা ভেবে ভেবে শৈশব-কৈশোর গলিয়ে ফেলেছ, জানি না আমি? নাকি আমি ডিভোর্সি?
: তোমার ডিভোর্স এখনো হয়নি!
: হয়ে যাবে, চিন্তা করো না। সাপ খেয়েছ কখনো?
: নাহ!
: হারাম, না?
: মদও তো হারাম!
: তাহলে?
: ইচ্ছা করেনি। সামনে এনে দিয়েছিল…কী সুন্দর রং! কিন্তু খেতে পারিনি।
: সংস্কার?
: কী জানি!
: আগামী সপ্তাহে দেশে যাব, তৈরি থেকো!
: সাপ খাওয়াবে?
: না, অক্টোপাস!
: হি হি হি।
: আই হেট স্ট্রবেরি, মনে রেখো!

তিন.
বনানীর এই গলিটায় আগে কখনো আসিনি। গলির শেষ বাড়িটাই ৪৭। মাহমুদার নিজের বাড়ি এখন। রিকশা বাড়িটার সামনে এসে থামতেই ফোন।
: পৌঁছে গেছ?
: নীরবতা।
: কোথায় আছ?
: নীরবতা।
: কথা বলছ না কেন?
: নীরবতা।
: হ্যালো হ্যালো…হ্যালো…! মাহিন…হ্যালো!
রিকশা ঘুরে যায় আমার। ফোনের ওপার থেকে মাহমুদার ডাক ভেসে আসতেই থাকে। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। আমি বলি, আমাদের নিয়ে চলেন! রিকশাওয়ালা আমার আশপাশ দেখে রিকশায় টান দেয়। মাহমুদা এখনো ডাকছে। ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু এই মাহমুদাকে কেমন যেন অচেনা মনে হয় আমার। আমরা ফিরে আসতে থাকি। আমরা মানে আমি আর আমার শৈশব আর কৈশোর। তারা মাহমুদাকে চিনেছিল এবং সম্ভবত তারাই কেবল মাহমুদাকে ভালোবেসেছিল!