ভবের আলীর ভ্রমণ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ভ্রমণে ভবের আলীর সুখ নেই, শান্তি তো নেই-ই; ওই ইয়ের পর থেকেই। প্রথম ছয় মাস, এক বছর ভালোই লাগত। ধীরে ধীরে ভালো লাগায় টান পড়ল। সংসারের চরকায় সুতো কাটতে কাটতে অলক্ষ্যে সুতোতেই বাঁধা পড়ল জীবন। সহস্র ছুতোতেও আর মুক্তি মেলে না। 

সুতরাং মন চাইলেই ভোকাট্টার ভূত মাথা থেকে তাড়াতে হলো। ওসব বাবার হোটেলে চলে। ভবের আলী এখন নিজেই প্রোপাইটার। ভালোবাসার হাওয়াই মিঠাই উবে গেলেও সংসারের কাঠি শক্ত হাতে তাকে ধরে থাকতে হয়। সান্ত্বনা এই, প্রত্যেক পুরুষই তাই করে, শুধু কলকাঠিটাই সে নাড়াতে পারে না।
ভবের আলীর কাছে এখন বেড়াতে যাওয়া মানেই বিরাট ঝক্কি! ছুটি ম্যানেজ করো, লাইনে দাঁড়াও, টিকিট কনফার্ম করো, ব্যাগ-বোঁচকা-বেডিং গোছাও, ঘর গুছিয়ে সব সামলে ‘কই হলো?’ বলে চ্যাঁচাতে থাকো, চেঁচিয়ে সিএনজি ডাকো, জ্যাম ঠ্যালো, ঊর্ধ্বশ্বাসে টার্মিনালে পৌঁছাও; তারপর গিয়ে দেখো ট্রেন ছয় ঘণ্টা লেট। এর কোনো মানেই হয় না।
‘হয় হয়।’ মুখের ভেতর পান গুঁজে দিতে দিতে সালেয়া খাটের ওপর পা তুলে বসে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তাই বলে ছেলেরা ঈদে নানুবাড়ি যাবে না? বছরে তো মাত্র ওই একবার। তা-ও আবার গতবার তোমাদের বাড়িতে গেলাম। সে জন্য যাওয়া হলো না।’
রাজধানীর ঘরে ঘরে এ হলো অলিখিত সমঝোতা। অন্যথা হলেই ঘরে ঘোর অমাবস্যা! এ বছর বাপের বাড়ি, পরের বছর শ্বশুরবাড়ি।
ভবের আলীর কাছে এ নেহাত বাড়াবাড়ি। কিন্তু কে শুনছে সে কথা। তাকেও তাঁতের মাকুর মতো প্রতিবার ছুটতে হচ্ছে!
ড্রয়িংরুম থেকে ছুটে এসে বড়টা হঠাৎ গলায় ঝুলে পড়লÑ‘বাবা, চলো না, বাবা, চলো।’
ছোটটার মুখে এখনো বোল ফোটেনি। বিছানায় চিত হয়ে হাত-পা ছুড়ে খেলছে। ভবের আলীর মনে হলো, সেও যেন তাকে ঠেলছে, ‘বাবা, চলো না, বাবা, চলো যাই।’ অগত্যা ভবের আলীকে আরেকবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হলো। তবে এবার আর ট্রেনে নয়, যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে। এবার হবে জার্নি বাই বাস।
ভবের আলী গাবতলী টার্মিনালে এসে যখন অটোরিকশা থেকে নামল, তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সাহ্‌রি খেয়ে আর ঘুমায়নি, সোজা চলে এসেছে। পাছে জটে পড়তে হয়। অথচ টার্মিনালজুড়ে এই ভোরেও জটলার কমতি নেই। পিঁপড়ের মতো আরও আসছে। এরা সবাই সেয়ানা তাদের আপন রাজত্বে। ভেবেছে তারাই ফার্স্ট। টিকিট কাটবে, উঠে বসবে, তারপর ‘ও মন রম্‌জানের ঐ রোজার শেষে...’ কোরাস গাইতে গাইতে ভ্রুম...ভ্রুম...ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে চলে যাবে। অথচ টার্মিনালে পা দিয়েই টাসকি! লোকে লোকারণ্য! সাতসকালেই বাসের প্যাঁ-পোঁ, কুলিদের হম্বিতম্বি, হকারের হাঁকডাক, দালালের টানাহ্যাঁচড়ায় স্থির হয়ে দাঁড়ানোই দায়।
ভবের আলী দমে যায়। ওদিকে গরমে দম যায় সালেয়ার। অটোরিকশার ভেতর থেকে সে চ্যাঁচায়, ‘হাঁ করে আছ কেন? মালপত্রগুলো নামাও। দেখছ না আমি নামতে পারছি না!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখছি।’ বলেই দু-বগলের নিচে হাত চালিয়ে হ্যাঁচকা টানে অটোরিকশা থেকে বড়টাকে আগে নামায় ভবের আলী। তারপর ওরই পায়ের কাছে বাক্স-পেটরাগুলো একে একে নামিয়ে রাখে। বেডিং ছিল ছাদে, সেটাও নামাতে হলো। ব্যাগই চার প্রকার—হাতব্যাগ, সাইড ব্যাগ, ট্রলি, সুটকেস। এরপর বেডিং; ছোটর বিছানা, বালিশ, তোশক। পানির পট, টিফিন ক্যারিয়ার, ছাতা, চার্জার ফ্যান, টুল এবং অবশ্যই পানের ডিব্বা।
সালেয়া ডোন্ট কেয়ার। তার কাছে কোনোটাই ফেলনা নয়। ভবের আলী রাগে যত গজগজ করে, সালেয়া তত বিড়বিড় করে, ‘বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এক জায়গায় যাওয়া, গ্রামে কারেন্ট থাকে কি না কে জানে! খাবার নিয়ে নিলাম, জ্যামে পড়লে ভাবতে হবে না। কিছু টাকা তো অন্তত বাঁচল।’
‘কিন্তু ওই টুল আমি বইতে পারব না।’ ভবের আলী বলেছিল। ধোপে টেকেনি। সালেয়াও সিদ্ধান্তে টলেনি।
ভবের আলী কাউন্টারের দিকে পা বাড়ায়। যাওয়ার আগে বড়টাকে বলে, ‘মালপত্রগুলো দেখিস। কেউ যেন না ধরে।’
ওমা! দু-পা এগোতেই পেছন থেকে বড়র গলা। সে চেঁচাচ্ছে, ‘বাবা, নিয়ে গেল!’
চকিতে ফিরে তাকাতেই ভবের আলীর চাঁদি গরম। মালপত্র ঘিরে ধরেছে কুলির দল। বড় ওদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। না পারারই কথা। সালেয়ার কোলে ছোট। এক হাতে ছোটকে সামলাচ্ছে। আরেক হাতে পার্স দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো সে নিষ্ফল চেষ্টায় রত।
কুলিরা দারুণ তৎপর। স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তারা মালপত্র মাথায় তুলে নিতে প্রস্তুত। প্রায় তেড়ে এসে তাদের আয়োজনে পানি ঢেলে দিল ভবের আলী, ‘এই রাখো, রাখো। ধরবে না। বাসের হেলপাররাই এগুলো তুলে দেবে। তোমাদের লাগবে না।’
কুলিদের মধ্যে স্যুটকেসটা যে প্রায় মাথায় তুলে ফেলেছিল, কেস ফসকে যাচ্ছে দেখে আকাশ থেকে পড়ল, ‘স্যার, ঈদের বাজারে এত মালপত্র নিয়া তো বাসে যাইতে পারবেন না। ট্রাক ডাইক্যা দেই।’
‘পারব কি পারব না সে আমি বুঝব।’ ভবের আলী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘তুমি বাপু মাল নামিয়ে রাখো। রাখো বলছি।’
কোলাহল শুনে দু-চারজন বাসের হেলপার অক্সিলিয়ারি ভার্বের মতো উদয় হয়। তারা কুলিদের দূর দূর করে দূরে সরিয়ে দেয়। তারপর ভবের আলীকে ঘিরে ধরে, ‘স্যার, কই যাইবেন? যশোর, ফরিদপুর, পিরোজপুর, মাদারীপুর, বরিশাল, চাঁদপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা—আল্লাহর কিরা স্যার, ডাইরেক, ডাইরেক...আসেন আসেন।’
উত্তর দেওয়ার আগেই ভবের আলীকে নিয়ে শুরু হয় তাদের প্রতিযোগিতামূলক দড়ি খেলা। ভবের আলী কৃতজ্ঞতা জানানোর আগেই বুঝতে পারে, গরম তাওয়া থেকে সে এবার জ্বলন্ত উনুনে পড়েছে।
ওদিকে কান টানলে যেমন মাথা আসে সেই সূত্রে কেউ কেউ ভবের আলীর সাইড ব্যাগ ধরে টানতে থাকে। ভবের আলীর নিজেকে পুতুলনাচের সেই অসহায় স্ত্রীর মতো মনে হয়; যে কিছুতেই চরিত্রহীন স্বামীর ঘরে যাবে না। স্বামী তাকে ক্রমাগত টানছে আর বলছে, ‘যাবি না ক্যা, ঠেইলাই নিমু, গুঁতাইয়াই নিমু।’
মহাসমারোহে ঠ্যালাগুঁতো চলছে। বাক্স-পেটরা, পরিবার নিয়ে ভবের আলী জেরবার। সবারই জোরালো দাবি, তাদের প্রত্যেকের গাড়ি ডাইরেক্ট, গেটলক, সিটিং। এই হয়েছে এক জ্বালা। সদরঘাটের ঘোড়ার গাড়িগুলোও সিটিং সার্ভিস হয়ে গেছে! ভবের আলী যে এসব বোঝে না তা নয়, কিন্তু এই অনাকাঙ্ক্ষিত অনাচারে তার ভ্রমণ-আকাঙ্ক্ষা উবে যায়। এতটা আদরণীয় হয়েও অনাহূতদের পীড়ায় পৃথিবী টলে ওঠে তার। অথচ তাকে টেনে তোলার কত আয়োজন।
যাত্রীসেবাদানকারীরা কেউ কর্তব্যে ত্রুটি রাখছে না। কেউ টানছে আর বলছে, ‘স্যার, এদিকে, সামনে সিট দিতাছি, আরাম কইরা বইসা যাইবেন।’ কেউ শূন্য গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রেখেছে। যাত্রী পেলেই তাড়া দিচ্ছে, ‘টাইমের গাড়ি, সময় নাই, ওঠেন ওঠেন।’ অথচ টার্মিনালের সঙ্গে বন্ধন ছিন্ন করার কোনো লক্ষণই তাদের নেই। ভ্রম্, ভ্রুমমমম...ইঞ্জিন গরম করে গাড়ি এক হাত সামনে যাচ্ছে, পরক্ষণেই ব্যাক গিয়ারে দু-হাত পিছিয়ে আসছে। ঝাঁকিয়ে টিনে মুড়ি ভরার মতো যাত্রী ভরার এ এক অভিনব কৌশল। কেউ আবার হর্ন দিয়ে মাঝে মাঝেই জানান দিচ্ছে, ছেড়ে দিলাম কিন্তু!
ভবের আলীকে ছাড় দিচ্ছে না কেউই। ঈদের বাজার। দামাদামি-মুলামুলির সুযোগ নাই। পাঁচ শর টিকিট এক হাজার। এক দাম। এক রেট। ছাদে থার্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট। বাতাস বিলকুল ফ্রি।
নাহ্, ভবের আলী আর ভাবতে পারছে না। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে সালেয়ার ওপর। রাগে-ক্ষোভে জ্বলন্ত চোখে গিন্নির দিকে তাকায়। উল্টো নিজেই পোড়ে সালেয়ার আগুনে,Ñ‘এমন বেয়াক্কেল মানুষ জন্মে দেখি নাই! টিকিট বুকিং দিয়া রাখছ বলতে কি শরম লাগে?’
তাই তো! মনেই ছিল না। বুদ্ধিটা সালেয়াই দিয়েছিল। বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ‘লাইনে দাঁড়াবে কেন? এখন অনলাইনের যুগ।’ ভবের আলী তাই করেছে। অনলাইনে টিকিট বুকিং দিয়েছে। কথাটা বলতেই যেন জোঁকের মুখে লবণ পড়ল, ‘ধুর মিয়া, আগে কইবেন না!’ বলেই ওরা ভবের আলীকে ছেড়ে অন্য যাত্রীসেবায় মনোযোগী হলো।
ভবের আলী এযাত্রা বেঁচে গেল। মনে মনে ভাবল, নাক কেটেও যদি এযাত্রা ভেস্তে যেত মন্দ হতো না। সে আড়চোখে গিন্নির দিকে তাকাল। চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি। বড়টাও খুব বিরক্ত করছে। শিসি দেবে। ভবের আলী একটু দূরে আড়াল দেখিয়ে দিল। বড়র মন ভরল না। সে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে শরীর মোচড়াতে লাগল। তার ইজ্জতজ্ঞান টনটনে। টয়লেট ছাড়া হবে না। ভবের আলী জানে, সেখানে ফ্রি সেবা মিলবে না। ত্যাগের মূল্য দিতে হবে। উপরন্তু আছে ছোট-বড় ক্ল্যাসিফিকেশন। ছোট পাঁচ, বড় দশ। তবে হ্যাঁ, বড়টা করলে ছোটটা ফ্রি।
ভবের আলী পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করে বড়র হাতে দিয়ে বলল, ‘যা সেরে আয়।’ তারপর নিজে চলল শান্তির খোঁজে। ওই শান্তি পরিবহনেই টিকিট বুকড করা আছে।
শান্তি খুঁজে পেতে সময় লাগল না। কিন্তু সেখানেও ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই—ছোটো সে তরী...’ অশান্তির চূড়ান্ত। কাউন্টারে যাত্রী গিজগিজ করছে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল ভবের আলী। তারপর ভিড় ঠেলে কৌশলে এগোতে লাগল। বলা যায় কোনোক্রমে ক্রল করে ডেস্কের সামনে চলে এল। তারপর সহযাত্রীর বগলের নিচ দিয়ে মাথাটা চালান করেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘হ্যালো ভাই, হ্যালো। এই যে...হ্যালো।’
‘জি, বলুন।’ ডেস্কের ওপাশ থেকে বিরক্ত কণ্ঠে টাইঅলা একজন বলল।
‘আমার দুটো টিকিট বুকড করা আছে।’
‘নাম?’
‘ভবের আলী।’
‘ভূতের গলি?’
‘অ্যা, না না...।’
‘আরে ভাই, তোতলান ক্যান! নাম বলেন, নাম।’ টাইঅলা তাড়া দেয়।
ভবের আলী কষ্টে নিজেকে সামলায়। শান্ত সুরে নাম বলে। টাইঅলা মনিটরে চোখ রাখে। কিছুক্ষণ কি-বোর্ডে খুটখুট করে মুখ না তুলেই বলে, ‘পেমেন্ট বাকি আছে।’
‘এক্সকিউজ মি।’ পাশের জনকে ঠেলে ভবের আলী বাঁ পাশে কাত হয়। তারপর মানিব্যাগ থেকে টাকা টেনে বের করতে করতে বলে, ‘কত?’
‘দু-হাজার।’
এ তো হাজার পাওয়ারের শক! ছিটকে ওঠে ভবের আলী। চৌদ্দ শ টাকার টিকিট দু-হাজার কেন?
‘ঈদে সবাই বোনাস পাচ্ছে। আমাদেরও দু-চার জায়গায় দিতে হচ্ছে।’ টাইঅলা বলে, ‘দেশে আছেন, খাচ্ছেন-দাচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন আর দেশের খোঁজ রাখেন না! ওসব সরকারকে গিয়ে বলুন।’
‘দিচ্ছি আপনাকে, সরকারকে বলব কেন?’
‘আপনার এই কেন-এর উত্তর আমি দিতে পারব না ভাই। টিকিট নিলে নেন, না হলে সাইডে চাপেন। নেক্সট নেক্সট।’ টাইঅলার কণ্ঠে এবার স্পষ্ট বিরক্তি।
ভবের আলীও তেতে ওঠে। ‘নিলে নেন’ কথাটার মানে কী? ছয় চাকার গাড়ি চালিয়ে এরা দশ চক্রে ফেলে যাত্রীদের ভূত বানাবে। বললেই উল্টো বল দেখাবে। কিম্ভুত ব্যাপার! সে ঠাস্ করে ডেস্কের ওপর ডান হাতটা রাখে। তারপর ঝুঁকে এসে বলে, ‘ভদ্রতা শিখুন বুঝেছেন। আপনি আমাকে এভাবে সাইডে চাপতে বলতে পারেন না। এ রুটে আরও গাড়ি চলে।’
‘চলে তো যান। দাঁড়িয়ে ভিড় বাড়াবেন না।’ টাইঅলার ভঙ্গি মাছি তাড়ানোর মতো।
মাথায় আগুন ধরে যায় ভবের আলীর। উত্তেজিত তর্জনী বার কয়েক উঁচুতে ঝাঁকিয়ে সে বলে, ‘যাব কি দাঁড়িয়ে থাকব, সেই সিদ্ধান্ত দেওয়ার আপনি কে? হু আর ইউ? ফার্স্ট এই রুটে যখন গাড়ি চলে তখন আপনার জন্মই হয়নি। তখন থেকে এই রুটে আমরা যাতায়াত করি, বুঝেছেন?’
কে শোনে কার ইতিহাস। হট্টগোল বাড়ছে। ভবের আলীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে খেপে উঠেছে, ‘জমিদার আশরাফ-উদ-দৌলার নাম শুনেছেন? তাঁরই ছেলে নেয়ামত-উদ-দৌলার সুপারিশে ব্রিটিশরা এই রাস্তা বেঁধে দিয়েছিল। তাঁর ছেলে অখণ্ড ভারতের সেই আমলের বিরাট ব্যারিস্টার। ওই ব্যারিস্টার সাহেবের প্রাইভেট কার আসা-যাওয়ার জন্য এই রাস্তা প্রথম পাকা হয়। তাঁর ছেলে কিসমত দৌলা পাকিস্তান আমলে প্রথম গাড়ির ব্যবসায় নামে। দোলা ট্রাভেলস নাম শুনেছেন? শুনবেন কীভাবে? জন্মই তো হয়নি। হ্যাঁ, ওই সময় আমার দাদা এই রুটে ফক্সওয়াগন চালাত। এখনো আমাদের গোয়ালঘরে চাড়ি বানিয়ে রাখা আছে। গিয়ে দেখে আসতে পারেন। ওর উল্টো পিঠে গরুগুলো খাবার খায় হ্যাহ্।’
পেছন থেকে কে যেন বলল, ‘ভাই, ওই দোলা দোল খেতে খেতে এখন শান্তি হয়েছে। প্লিজ, আর অশান্তি বাড়াবেন না। অন্যদের সুযোগ দিন।’
ভবের আলী দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে বলে, সে সুযোগ তোরা পাবি না শয়তান।
সে টাকা বুঝিয়ে দিয়ে টিকিট নিয়ে বেরিয়ে আসে। মনে মনে একটু খুশিও হয়। ঈদের বাজার। সিটটা ভালো জায়গায় পেয়েছে। সিট পাওয়া মানে যেন ঢাকার বুকে একখণ্ড জমি পাওয়া! কিন্তু তার এই আনন্দ স্থায়ী হয় না। গাড়ির খবর নিতে গিয়ে জানতে পারে, তাদের বাস এখনো টার্মিনালে এসে পৌঁছায়নি। দুপুরের মধ্যে পৌঁছাবে, সে সম্ভাবনাও নেই। নয় কিলোমিটার জ্যাম! ডাউন ট্রিপে ফেরার পথে আটকে আছে।
ভবের আলীর দম বন্ধ হয়ে আসে। সালেয়াকে বলে, ‘চলো ফিরে যাই।’ সালেয়া রাজি হয় না। সে ভবের আলীর দিকে টুলটা এগিয়ে দেয়। তারপর ফিডার হাতে ছোটকে স্বামীর কোলে বসিয়ে রেখে ফেসবুক ওপেন করে। কখন বাড়িতে পৌঁছাবে কে জানে, বিষয়টা জাতিকে জানানো দরকার।