দ্য বস ইজ অলঅয়েজ রাইট ৭

অংলকরণ: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী
অংলকরণ: জুনায়েদ আজিম চৌধুরী

আমাদের বস নতুন এসেছেন। তিনি আমাদের এই শোরুমের ম্যানেজার। আমরা একটা বইয়ের দোকানে কাজ করি। এই বইয়ের দোকানে ক্যাসেট, সিডি, কাগজ, কলম, কফি ও বই পাওয়া যায়। এটা একটা আন্তর্জাতিক চেইনশপের শাখা।

আমাদের এই শাখাটা ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে। আমি এই শোরুমের বিক্রয় বিভাগের প্রধান।

আমাদের নতুন বসের নাম আমজাদ খাঁ। তিনি দেখতে আমির খানের মতো, তাঁর হাসিটা শাহরুখ খানের হাসির মতো, তাঁর গলাটা সাবিনা ইয়াসমিনের মতো।

এটা তাঁর জন্য বিশাল সুবিধা। আমরা কাউকে যখন ফোন করি, অপর পক্ষ কথা বলতে চায় না। আমাদের বস আমজাদ খাঁ কাউকে কখনো কল করলে সাধারণত অপর পক্ষ ফোন রাখতে চায় না।

সুন্দর কণ্ঠের কদর টেলিফোনের সর্বত্র।

নতুন বসের সব ভালো। শুধু প্রকাশ্যে সবার সামনে তিনি নাকের ময়লা পরিষ্কার করেন। এটা না করলেই তিনি সর্বাঙ্গসুন্দর একজন বস হতে পারতেন।

আমাদের সেলস বিভাগের দুই নম্বর ব্যক্তি হলো সামিয়া। সামিয়া মেয়েটাকে দেখতে লাগে ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। তবে সে কবে যেন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লাইব্রেরি সায়েন্স পড়েছিল। সেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে সে বইয়ের শোরুমে চাকরি পেয়েছে।

নতুন বস আমজাদ খাঁ। আপনারা হয়তো জেনে থাকবেন, আমাদের শোরুমে ওস্তাদ আমজাদ খাঁর সিডিও আমরা বিক্রি করি। তিনি একজন বিশিষ্ট উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী, খুব বড় ওস্তাদ।

আমাদের বসও রাগসংগীতের বড় ওস্তাদ। তাঁর গলা চৌরাশিয়ার বাঁশির মতো। আর তাতে সারাক্ষণ রাগ-রাগিণী খেলা করে। মানে তিনি সারাক্ষণ রেগে থাকেন আসলে।

এই যেমন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমি গত ১০ বছরের সেলস দেখলাম। আগে ক্যাসেট বিক্রি হতো দিনে ৫০০ কপি। আর এখন এক কপিও বিক্রি হয় না। এইভাবে আমরা একটা মার্কেট হারিয়ে ফেললাম! এ জন্য কে দায়ী?’

আমি মনে মনে বললাম, আমার কপাল দায়ী। মুখে হেসে বললাম, ‘টেকনোলজি দ্রুত চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে। আগে লোকে ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনত। এখন শোনে না।’

‘তারপরও ক্যাসেট পৃথিবীতে বিক্রি হয় তো?’

আমি বললাম, ‘জি, এখনো কেউ কেউ ক্যাসেট প্লেয়ার ইউজ করেন। প্রধানত করেন সাংবাদিকেরা। ছোট ছোট রেকর্ডার তাঁরা সঙ্গে নিয়ে কাজে যান। তবে সেটাও উঠে যাচ্ছে। এখন তাঁরাও ফিতা ছাড়া রেকর্ডার ইউজ করেন। মোবাইল ফোনেই এখন রেকর্ড করা যায়।’

তিনি বললেন, ‘আগে ফুজি ফিল্ম বিক্রি হতো দিনে ১৩৪টা। এখন একটাও হয় না। এই মার্কেটটা আমরা কেন হারালাম?’

আমি বললাম, ‘এখন সবার হাতে মোবাইল ফোন। ডিজিটাল ক্যামেরা। সেখান থেকে সরাসরি প্রিন্ট নেওয়া যায়। লোকে কেন ফুজি ফিল্ম, কোডাক ফিল্ম কিনতে যাবে?’

তিনি বললেন, ‘আলফাজ মিয়া, আপনার চাকরি নট।’

আমি বললাম, ‘ইয়েস স্যার।’

তিনি বললেন, ‘কী ইয়েস?’

আমি বললাম, ‘আমার চাকরি নট, স্যার।’

সামিয়ার কাছে গেলাম। সামিয়া বলল, ‘কী হয়েছে?’

‘আমার চাকরি নট।’

‘কেন?’

‘আমার নতুন বস খুবই খাটুরে। তিনি ব্যাপক খেটেছেন। এই দোকানে ১০ বছর আগে ফুজি ফিল্ম বিক্রি হতো। ক্যাসেট বিক্রি হতো। এখন হয় না কেন? এই নিয়ে তিনি আমার সঙ্গে রাগারাগি করলেন।’

‘আপনি কী বললেন?’

‘আমি আবার কী বলব?’

‘বললেন না যে ফুজি ফিল্মের দুনিয়া আর নাই। ক্যাসেটের দুনিয়া আর নাই।’

‘জি না।’

‘কেন, বলেন নাই কেন?’

‘কারণ, ১০ বছর আগে আমার জন্মই হয় নাই। আমি যদি দায়ী না হই, তাহলে আমার আব্বা অবশ্যই এই জন্য দায়ী।’

‘না না। আপনি হেয়ালি করছেন। এই সব সিরিয়াস ব্যাপার অবশ্যই সিরিয়াসলি ডিল করতে হবে।’

আমি বললাম, ‘সামিয়া, আমার ডেস্কে আসো।’

সামিয়া আমার ডেস্কে এল। আমার ডেস্কের পেছনে একটা ডিসপ্লে বোর্ড আছে। সেটার দিকে আঙুল তুলে বললাম, ‘পড়ো।’

‘কী?’

‘ওই কাগজে কী লেখা আছে?’

সামিয়া পড়ল—রুল নম্বর ওয়ান: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নম্বর টু: ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।

বস সব সময়ই ঠিক।

তিনি আমাদের দোকানের বিক্রি বাড়ানোর জন্য ফিতার ক্যাসেট এবং ফুজি ফিল্মের বিক্রি বাড়ানোর ওপর জোর দিলেন। একটা বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে ডেকে আনা হলো। তারা আমাদের দোকানের দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় ডিসপ্লে বোর্ড লাগালেন। একটা সুন্দরী মেয়ের হাতে ফুজি ফিল্ম, সে বলছে, ‘ফিল্মে ছবি তোলার মজাই আলাদা!’

আরেকজন মডেল একটা সনি অডিও ক্যাসেট হাতে নিয়ে বলছে, ‘সাংবাদিক মানেই টেপ রেকর্ডার। টেপ রেকর্ডার ইউজ করুন।’

এসব করতে গিয়ে আমাদের বিক্রি কমে গেল আরও বেশি। আমাদের দোকানে আসল আয় কফিতে। কফির ওপরে জোর দিলে, কফি নিয়ে ফেসবুক প্রচারণায় নামলে আমরা ভালো করতাম। আমরা যদি ওয়াই-ফাই ফ্রি করে দিই, আর কফির ভ্যারাইটি বাড়াই, তাহলে আমাদের বিক্রি দ্বিগুণ হতে পারে।

কে কাকে এই জিনিসটা বোঝায়।

আমি আর সামিয়া একদিন জোট বেঁধে গেলাম ওস্তাদ খাঁ সাহেবের কাছে।

‘স্যার, বলছিলাম কী, আমাদের কফি মাগগুলো ব্র্যান্ডিং করি। আর এখন ক্যাপাচিনো সবচেয়ে বেশি চলে। আমাদের একটা কফি মেশিন কিনতে হবে। ক্যাপাচিনো, ল্যাটে, হেজলনাট—এইসব কফি বানাতে আমাদের পারতে হবে!’

বস বললেন, ‘এটা কি কফির দোকান নাকি বইয়ের দোকান?’

আমরা বললাম, ‘বইয়ের দোকান।’

‘তাহলে আমরা কেন কফির ওপরে জোর দেব?’

‘বস আমরা তো ক্যাসেট আর ফিল্ম বিক্রির চেষ্টা করে গত বছর ২৩ লাখ টাকা পানিতে ফেলেছি।’

তিনি বললেন, ‘গেট আউট।’

আমি বললাম, ‘ইয়েস, স্যার।’

‘কী ইয়েস স্যার?’

আমি বললাম, ‘আমি গেট আউট স্যার...’

সামিয়া রোজ সন্ধ্যার পর একা একা বাসে চড়ে বাড়ি যায়। আমি তাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। বসন্তকাল। দক্ষিণা সমীরণ বয়। তার পাশে চলতে আমার ভালো লাগে। সে একটা সুন্দর পারফিউম মাখে গায়ে। আহা, আজি এ বসন্তে...

একদিন সে বলল, ‘গতকাল বাস থেকে নামার পর দুটো মাতাল পিছু নিয়েছিল! আমার খুব ভয় ভয় লাগে...’

আমি একটা মোটরসাইকেল কিনেছি। ছোটবেলা থেকেই আমি বাইক চালাই। আমার আব্বার বাইক ছিল। ভাবছি, সামিয়াকে নিয়ে মোটরবাইকের পেছনে তুলে ওর বাসায় রেখে আসা যাবে।

বস বললেন, ‘এই, তোমার হাতে ওটা কী?’

‘হেলমেট স্যার।’

‘তুমি মোটরবাইক চালাও।’

‘জি বস।’

‘লাইসেন্স আছে।’

‘জি বস।’

‘শোনো, তুমি কিন্তু আবার সামিয়াকে তোমার বাইকের পেছনে তুলতে পারবে না।’

‘কেন বস?’

‘অফিসের একটা ডেকোরাম আছে।’

‘বস, ও তো রোজ সন্ধ্যার পরে বাড়ি যায়। পথে গুন্ডারা ওকে হামলা করতে পারে। আজকাল...’

‘সেটা আমি দেখব। তোমাকে দেখতে হবে না।’

আমি আমার ডেস্কে গিয়ে বসলাম। ভীষণ মুড অফ। ‘লাশা লাশা...দাজামরাহা...দাজামরাহা...’ বলে বলে রাগ কমানোর চেষ্টা করলাম। তারপর চোখ গেল আমার সেই বাণী চিরন্তনীর দিকে:

রুল নম্বর ওয়ান: দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। রুল নম্বর টু: ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান।

নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করলাম। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকুরি...’

বস বললেন, ‘এটা কী?’

‘এটা কী, জানি না তো বস...’

আমাদের অফিসের কর্মচারীদের জন্য একটা কিচেনমতো আছে। এটা ক্রেতাদের কফি কর্নারের উল্টো দিকে। গোপন চিপা জায়গায়। সেইখানে একটা ছোট্ট প্যাকেট পড়ে আছে।

তিনি বললেন, ‘এটা হলো ব্রাজিলের স্পেশাল কফি। গতকাল ইরা আমাকে দিয়েছে। ভুল করে এখানে ফেলে রেখে গেছি।’

আমি বললাম, ‘বাহ্। খুব ভালো কফি হবে।’

‘মাত্র একটাই প্যাকেট আছে। আমি খাই? কী বলো।’

আমি বললাম, ‘অবশ্যই। দেখি বস, কী লেখা।’

আমি পড়লাম। দেখি, লেখা আছে, ‘ইনসেক্ট কিলার। ইফ ইউ ইট বাই মিসটেক, ভমিট। কল ইমার্জেন্সি ইমেডিয়েটলি।’

বস তাঁর চশমা ডেস্কে ফেলে এসেছেন।

আমি বললাম, ‘মনে হয় এটা কফি না-ও হতে পারে।’

‘না না এটা কফি। ইরা দিয়ে গেছে, আমার মনে আছে।’

আমি মনে মনে বললাম, ১. দ্য বস ইজ অলওয়েজ রাইট। ২. ইফ দ্য বস ইজ রং, সি রুল নম্বর ওয়ান। খা ব্যাটা। বিষ খা।

বস কাপে গরম পানি নিলেন। তেলাপোকা মারা আর ইঁদুর মারা বিষ গোলালেন তিনি।

তারপর কফি নিয়ে গেলেন তাঁর টেবিলে।

আমি আমার ডেস্কে চুপচাপ বসে আছি। ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত দেখে যাওয়া উচিত। তিনি একটু পরে গোঁ গোঁ করতে করতে ডাকলেন, ‘আলফাজ আলফাজ...’

আমি ছুটে গেলাম।

‘ভালো করে পড়ে দেখো তো প্যাকেটটায় কী লেখা...’

আমি প্যাকেট আনতে গেলাম। এর মধ্যে তাঁর ফোন এল। আমি প্যাকেট হাতে শুনছি—‘কী বললা, কফির প্যাকেটের বদলে ভুল করে তেলাপোকা-ইঁদুর মারা বিষের প্যাকেট রেখে গেছ...’

আমি বললাম, ‘বস, আপনাকে বমি করাতে বলেছে। গোবর খেলে নাকি বমি হয়। গোবর কই পাই এখন...’

সামিয়া দৌড়ে এসেছে।

‘কী হয়েছে?’

‘বস তেলাপোকা মারার বিষ খেয়ে ফেলেছেন।’

‘কী হবে এখন?’

‘শোনো, আজকালকার বিষ খেয়ে তেলাপোকা মরে না। বসও মরবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো...’