ফুটবলের মানবিক পৃথিবীতে

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
>তাঁরা সবাই সাংবাদিক, ফুটবল নিয়ে প্রত্যেকেই লিখেছেন বই। সাইমন কুপারের ফুটবল অ্যাগেনস্ট দ্য এনিমি, অ্যালেক্স বেলোসের ফুটবল: দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অফ লাইফ ও ডেভিড উইনারের ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ: দ্য নিউরোটিক ব্রিলিয়ান্স অফ ডাচ ফুটবল। এই ত্রয়ীগ্রন্থে ফুটে উঠেছে নানা দেশের ফুটবলের স্বতন্ত্র সৌন্দর্য। বিভিন্নজনের সাক্ষাৎকার আর বিশ্লেষণে উঠে এসেছে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও যাপনে এই খেলার পরিক্রমাও।

 ১৯৮৮ সাল। ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে জার্মানিকে হারাল নেদারল্যান্ডস। রাতের রাস্তায় নেমে এল লাখ লাখ ডাচ। ছুড়ে ফেলল হাজার হাজার বাইসাইকেল। শুধু কিশোর-তরুণ নয়, এক বৃদ্ধও দৌড়াচ্ছে পতাকা হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত মিত্রবাহিনীর একজন সৈন্য প্রতিক্রিয়া জানিয়ে টেলিভিশন সাংবাদিককে বললেন, ‘অ্যাদ্দিনে যুদ্ধ জিতলাম আমরা!’

সেই রাতে আঠারো বছরের সাইমন কুপার ভাবছিলেন বিস্মিত হয়ে! যুদ্ধে তো জার্মান তেতাল্লিশ বছর আগেই হেরে গিয়েছিল। তাহলে? তারপরও ইতিহাসের ‘বৃহত্তম সাইকেল চুরি’র কথাটি ডাচরা ভুলতে পারেনি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে কোণঠাসা জার্মান বাহিনী যখন নেদারল্যান্ডস ছেড়ে যাচ্ছিল, তখন দ্রুত ফেরার তাগিদে তারা ব্যবহার করেছিল যত রকম মোটরযান পাওয়া যায় তার সব। যখন আর কিছুই ছিল না, সে সময় যেখানে যত সাইকেল পেয়েছিল, তা-ই নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে নেদারল্যান্ডস থেকে ফিরেছিল নিজের দেশের মাটিতে। সাইকেলপ্রিয় ডাচদের জন্য তাই ’৮৮-এর খেলাটি ছিল একটা মধুর শোধ। কিছুদিন পর একটি কবিতার বইও বের হয় এই হার নিয়ে।

শুধু এই রাতই নয়, উগান্ডায় জন্ম নেওয়া সাইমন কুপার, যিনি নিজে নেদারল্যান্ডসে মিডফিল্ডে খেলেছেন, ইংল্যান্ডে খেলতে নেমে বলের দেখাই পেলেন না, মাথার ওপর দিয়ে প্রতিবারই এই গোলাকার বস্তুটি পেরিয়ে গেল তাঁকে। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা আফ্রিকার খেলাও দেখলেন তিনি। সে সময় তাঁর ভাবনা এল, কী জন্য মানচিত্রের একেক রেখায় একই ফুটবল খেলাটার চেহারা এত বদলে যায়? যুদ্ধ, শিল্প, রাজনীতি—সবটাতেই তো দেখি আবার তার ছায়া।

এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য বাইশ বছরের সাইমন কুপার ১৯৯২-এ জুলাইয়ের একদিন ইংল্যান্ড থেকে ফেরিতে চেপে বসবেন, পিঠের ব্যাগে একটা টাইপরাইটার আর সাড়ে তিন হাজার ডলারের ট্রাভেলার্স চেক ছাড়া তেমন কিছুই সঙ্গে থাকবে না। পরবর্তী নয় মাসে বাইশটি দেশ ঘুরবেন তিনি; এবং লিখবেন বই—ফুটবল অ্যাগেইনস্ট দ্য এনিমি বা শত্রুর বিরুদ্ধে ফুটবল। অতঃপর সেই বই প্রকাশিত হবে ১৯৯৪ সালে।

লেখককে বিস্মিত করে বইটি পরে ব্রিটিশ উইলিয়াম হিল স্পোর্টস বুক পুরস্কার পায়। ব্রিটিশ লেখক ও পরবর্তীকালে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস-এর ক্রীড়ালেখক সাইমন কুপারের জন্য দিনটি ছিল বিস্ময়ের। তিনি শুধু সাংবাদিকতার একঘেয়ে ট্রেনিং থেকে এক দিনের ছুটি কাটাতেই লন্ডনে গিয়েছিলেন, সেই পুরস্কার অনুষ্ঠানে।

ফুটবল পরিব্রাজনার শুরুতেই কুপারের প্রতীতি হলো, যে খেলাটা কোটি কোটি মানুষের বিষয়, তা মোটেই শুধু একটা খেলা নয়, তা ‘যুদ্ধ ও বিপ্লব’-এর জন্ম দিতে সহায়ক এবং মাফিয়া ও একনায়কের জন্য পরম আকর্ষণীয়। বিপরীতে, এটি কখনো আবার যুদ্ধ থামানোর মোহনমন্ত্রও। বইটিতে লিখেছেন তিনি, পেলেকে একটা ম্যাচ খেলার সম্মান দিতে নাইজেরিয়া-বাইয়াফ্রান যুদ্ধ বিরতি পেয়েছিল এক দিনের।

কুপারের কাছে ফিরে আসার আগে আরেক ব্রিটিশ লেখক ও গার্ডিয়ান পত্রিকার কলাম লেখক অ্যালেক্স বেলোসের ব্রাজিল-তালাশে প্রবেশ করা যাক। ফুটবল: দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অফ লাইফ বইটি তাঁর ব্রাজিল ও ফুটবলের সমার্থক হয়ে ওঠার সুলুক সন্ধান।

১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোল করার পর ম্যারাডোনা। ছবি: সংগৃহীত
১৯৮৬-এর বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় গোল করার পর ম্যারাডোনা। ছবি: সংগৃহীত

তিনি লিখেছেন, ব্রাজিলের মতো একটি দেশ, যা কিনা বহু জাতির মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে নিজস্ব পরিচয় সৃষ্টির জন্য খুঁজছিল একক উপাদান, তা পেয়ে গেল ফুটবলে। তাই ১৮৯৪-এ ব্রাজিলে ব্রিটিশদের আমদানিকৃত ‘বিউটিফুল ফুটবল’ কয়েক দশকের মধ্যে ব্রাজিলের নিজস্বকরণে জাতীয়তার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান হিসেবে রূপ পেল, হয়ে উঠল ‘ফুতবল-আর্তে’ বা ফুটবল–শিল্পে।

এই শিল্পে সাম্বা, সংগীত একাকার। শুধু কি তাই? কঠিন কৌশল নেই, তাই ‘ভদ্দরনোকেরা’ খেলাটাকে আর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে রাখতে পারলেন না! কয়টা মোজা বেঁধে বা কিছু একটা দিয়ে মিলিয়ে গোল বানাও আর অ্যায়সা পেটাও। তারও পর আবার সাদা চামড়ার সঙ্গে গুঁতোগুঁতি এবং এর জের এড়াতে ড্রিবলিংয়ের বিকাশটা হলো বাড়তি সৌন্দর্য নিয়ে। বেলোস দেখলেন, এই খাওয়া-ঘুমানো-যাপনে ফুটবলময় জাতটি কত রকমভাবেই না ফুটবল খেলতে পারে! গাড়ি দিয়ে, গাছের সঙ্গে, ষাঁড়ের সঙ্গে, কাদায়। দীর্ঘ নয় ঘণ্টা মাটিতে না ছুঁইয়ে বল ‘জাগলিং’–এর রেকর্ড আছে এ দেশেরই ফুটবল–তারকা রোনালদোর স্ত্রীর। শেষতক, লেখক এ-ও জানলেন যে সে দেশে শেষকৃত্য পরিচালনাকারীরা মৃতের কফিনের সঙ্গে ক্লাবের ক্রেস্টও দিয়ে থাকে। এ যেন ‘জীবন-মৃত্যুর সীমানা ছাড়ায়ে’ ফুটবল!

কবি যদিও বাঙালিকে দুটি পয়সা জুটলে উদরপূর্তির পরপরই ফুল কিনতে আহ্বান করেছেন, নেপলসের (ইতালি) লোকে পেটে দুটো অন্ন ফেলতে পারলেই দৌড়াবে ম্যাচের টিকিটের জন্য। খেলা দেখা শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে হিসেব করবে, গাঁটে আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না। রাতে মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই খুঁজতে হবে তো।

ব্রাজিলের বন্দোবস্তও মন্দ নয়। সেখানে নাকি এমন কোনো গ্রামই নেই, যেখানে ন্যূনতম একটি চার্চ আর ফুটবলের মাঠ নেই। তা-ই কী? মাথা চুলকে ব্রাজিলবাসী বলবে, চার্চের বিষয়ে সন্দেহ আছে। জিকো, গারিঞ্চা, রোনালদোদের তারা ডাকে নামের প্রথম অংশ দিয়ে এবং পৃথিবীকেও সেইভাবেই চেনায়। ঘরের ছেলেই যে!

ফুটবল: দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অফ লাইফ-এ বেলোস আরও বলছেন, কোপাকাবানায় বাস চালানো এক মেয়ের কথা। এখন ফারো আইল্যান্ডে মাছের আড়তে কাজ করে সে। মেয়েটির স্বামী এই দ্বীপের ক্লাবের ফুটবলার, ব্রাজিল থেকে প্রায় দশ হাজার মাইল দূরের এই বরফের দেশে স্বামী তার বিরাট সম্মান পান, এ-ই তার সুখ।

ফারো থেকে ফিরে বেলোস ঠিকুজি খুঁজছেন রিওডি জেনিরোতে তেমন আরেক ফুটবলারের। সমুদ্র–সমতলে ধনীদের পাড়া পেছনে ফেলে গরিবদের বস্তি। পাহাড়ের গায়ে গুটি গুটি বস্তির মধ্য দিয়ে হেঁটে যান তিনি। পেরিয়ে যান দেবতাদের উদ্দেশে রাখা চালের থালা, ঘুড়ি ওড়ানো শিশুদের, মদ খেয়ে মাতাল হওয়া মানুষ আর লড়াইয়ে নামানোর জন্য খাঁচায় আটকে রাখা যুযুৎসু মোরগগুলোকেও। দূরে নীল আটলান্টিকের ইশারা। এখানে দূরপরবাসী এক ফুটবলারপুত্রের মা মুখোমুখি বেলোসের। তিনি গর্বিত তাঁর পুত্রকে নিয়ে, ফুটবল যেন তাঁকে দানিয়াছে ‘খ্রিস্টের সম্মান’। মায়ের মনোভঙ্গি এমন, কোনো দিন যদি সে না-ও ফেরে, তবু সে ঠিকই করেছে।

ব্যক্তির এই অহংকার মূলত ভূমি-কাল-পরম্পরায় জড়াজড়ি চেতনারই একটা প্রকাশ। যেমন দেখান ইংরেজ লেখক ও সাংবাদিক ডেভিড উইনার তাঁর ব্রিলিয়ান্ট অরেঞ্জ: দ্য নিউরোটিক ব্রিলিয়ান্স অফ ডাচ ফুটবল-এ (২০০০)। বইয়ের শুরুতেই ব্যতিক্রমী সূচির ৫, ৭, ৯, ১৪, ১০, ১ বিন্যাস প্রসঙ্গে উইনার বলছেন, ‘পাঠক, টোটাল ফুটবলের প্রেরণায় সূচিকে দেখুন স্কোয়াড নম্বর হিসেবে।’ ডাচদের ফুটবল-সংস্কৃতি আদতে ডাচ সংস্কৃতির বিকাশের একটি আয়না। চাবির ফুটো দিয়ে দেখার মতো ক্ষুদ্রভাবে নয়, দূরে দাঁড়িয়ে সবটুকু দেখার বড় ছবিটিই তাঁকে টেনেছে—ডেভিড উইনারের এই বই তাই ইতিহাস, ভূগোল, স্থাপত্য আর চিত্রকলাকে ফুটবলের সঙ্গে বাঁধার একটা চেষ্টা।

সেটি কেমন? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শহর আর মাঠের প্রতি বর্গসেন্টিমিটার জায়গার হিসাব বহু চিন্তা, তর্ক করে ডাচদের নির্ধারণ করতে হয়েছে। কারণ দেশটির অর্ধেক জমিই সমুদ্রতলে। তারা বলে, ঈশ্বর গড়েছেন পৃথিবী, কিন্তু নেদারল্যান্ডসকে গড়তে হয়েছে ‘আমাদেরই’। ডাচরা জানে জায়গার সদ্ব্যবহার কী। মাঠের প্রতি বর্গসেন্টিমিটারের সম্ভাবনাকে আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে তার টোটাল ফুটবলের ধারা। উইং পর্যন্ত জায়গা ব্যবহার, প্রতিটি নড়াচড়া ও দৌড়ের হিসাব এবং একই নীতিতে প্রতিপক্ষের নড়বার জায়গাটি সীমিত রাখা। মাঠকে তো আর টেনে বাড়ানো যাচ্ছে না, কেবল তাকে ব্যবহারের কৌশল বাড়ানো ছাড়া—বইয়ের ‘ডাচ স্পেস ইজ ডিফরেন্ট’ অধ্যায় সে কথাই বলছে।

উইনার-আখ্যানে আমরা দেখি রাশিয়ার এক নাচিয়ের চোখ দিয়ে ইয়োহান ক্রুইফের ফুটবলকে, দেখি সংগীত ও নাচের মতোই ফুটবল হলো স্বতন্ত্র এক শিল্প, যার স্পন্দনকে ধরার উপমা শুধু সে নিজেই।

এ পর্যায়ে আবার ফেরা যাক বাইশ বছরের সেই উৎসুক সাইমন কুপারের কাছে। ঘটনার মধ্যে তিনি। তাঁর সঙ্গে আমরাও ‘ঈশ্বরের হাত’ধারী বড় শিশুটির তুমুল দুরন্তপনার সাক্ষী হই স্টেডিয়ামে। কোকেনের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ার পর ম্যারাডোনা প্রথম ম্যাচ। সেকেন্ড হাফে পা দিয়ে তিনি কাদার দলা ছুড়ে দিলেন রেফারি ফিলিপ্পির দিকে। কিন্তু তিনি করেননি সেটি! প্রমাণ, ‘ওটা তো রেফারির গায়ে লাগেনি।’

আর্জেন্টিনার জান্তা সরকার আর তার আয়োজন করা বিপুল বিশ্বকাপ কেমন করে আর্জেন্টিনার ইতিহাসকে ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে দিতে শুরু করে কুপার তার দীর্ঘ কাহিনি বলেন।

আবার কাঁপা কাঁপা হাঁটু নিয়ে ক্যামেরুনের কিংবদন্তি ফুটবলার রজার মিলাকে কুপার জিজ্ঞেস করেছেন, ক্যামেরুনের সাফল্যকে তিনি আফ্রিকার সাফল্য মনে করেন কিনা? ১৯৯০-এর বিশ্বকাপের শুরুতেই ক্যামেরুন ফেবারিটস আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে সবাইকে চমকে দেয় এবং সেবারই প্রথম কোনো আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচ জেতে। প্রশ্নের জবাবে মিলা বললেন, ‘কিসের আফ্রিকা? এই জয় তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের।’ এই কথার পর হঠাৎ কান খাড়া করে ফেলতে হয় কুপারের যুক্তিটি শুনে! তিনি বলছেন, সেই সময় ইংল্যান্ডের কাছে ক্যামেরুনের হারের পর বাংলাদেশ, হ্যাঁ, বাংলাদেশেরই একজন লোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল এবং এক নারী আত্মহত্যা করেছিল, তার সুইসাইড নোটে লেখা, ‘ক্যামেরুন যখন নেই, এ জীবনেরও প্রয়োজন নেই।’ যদিও এই ঘটনাটি কতটা সত্যি, তা জানার উপায় এখন আর নেই!

ফ্রান্সে লিগে খেলতে গিয়ে কতটা বর্ণবাদী আচরণের মুখে পড়েছেন? মিলা এর উত্তরে বলেন, সত্তরের দশকে প্রথম সেখানে যাওয়ার পর তাঁকে জঙ্গলে ফিরে গিয়ে কলা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

ওদিকে ব্রাজিলে? ফুটবল: দ্য ব্রাজিলিয়ান ওয়ে অফ লাইফ-এ বেলোস বলছেন সক্রেটিসের জবানে। একসময়ের মধ্যমাঠে ব্রাজিলের আক্রমণের পুরোধা, রাজনৈতিক চেতনা আর চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়া—সব মিলিয়ে সক্রেটিস এক বর্ণময় ‘আইকন’। বেলোস তাঁকে বলেন, মাঠের বাইরে দুর্নীতি আর মাঠে অতীত কীর্তিকে টিকিয়ে রাখার এক নিরন্তর সিসিফাসের লড়াই, তারপরও কি সক্রেটিস স্বপ্ন দেখেন তাঁর দেশের উত্তরণের? সক্রেটিস বললেন, এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় শক্তি বহু জাতি আর তাদের জীবন ও পৃথিবীকে দেখার দৃষ্টি। ব্রাজিল এক ‘দারুণ সুখী সংস্কৃতি’। হয়তো তারা অত গোছানো নয়, তাই বিপর্যয় আসে সত্যি, কিন্তু এটিই কি মানবতারও সারাংশ না? অত গোছানো হলে, মৌলিক বৈশিষ্ট্যই যায় হারিয়ে—হারায় ইন্দ্রিয়ের সরলতা, হাসি।

কীভাবে ফুটবল একটি জাতিকে একাত্ম করে? বেলোস টেনে আনেন ঔপন্যাসিক কার্লোস টনির বর্ণনা, মারাকানায় ১৯৫০-এর ব্রাজিল-উরুগুয়ের সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ। জুলাইয়ের ওই বিকেলে সমস্ত স্টেডিয়াম চুপ। বিকেলের আলো এসে পড়েছে মাঠে। এমনকি কান্নার শব্দও নেই। একসঙ্গে এতিম হওয়ার মতো মারাকানায় সমবেত মানুষ তাদের বেদনার মধ্য দিয়ে এক হয়ে ওঠে। ওই দিনটি ব্রাজিল আজও ভুলতে পারে না।

কিন্তু এক জাতি হয়ে ওঠা কিংবা শত্রুর বিরুদ্ধে এককাট্টা হওয়ার আবেগী উপাদান, নব্বইয়ের আগের ফুটবল আর এখনকার ক্লাব-যুগে খেলাটির ভূমিকা কেমন?

ফুটবল অ্যাগেইনস্ট দ্য এনিমি লেখার বিশ বছর পর এসে কুপার বলেন, ফুটবল অনেক বদলে গেছে। বিশ্বায়নের উপাদান সে, ভূমিজরেখা পেরিয়ে যাওয়ার মানবিক আকাঙ্ক্ষার দাগ এই ফুটবলের গায়ে। তাই ২০০৬ বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে স্টেডিয়ামে হলুদ জার্সি গায়ে যারা চিৎকার করছিল, তাদের মধ্যে কজন ব্রাজিলিয়ান ছিল—সে হিসাব খুব একটা জরুরি নয়।

এত বছর পর জন্মভূমি উগান্ডায় গিয়ে কুপার দেখেন, খোদ ইংল্যান্ডে তাঁর নিজের ক্লাবগুলো নিয়ে এত আয়োজন নেই, যতটা উগান্ডায়। ট্যাক্সি, জামা, খেলনা, দোকান কোথায় নেই! উগান্ডান যুবার গায়ে আর্সেনালের জার্সি দেখে জানতে চাইলেন, সবাই কেন এখানে এসব জার্সি পরে? সে বলল, জানি না। আমি নিজেও ম্যানচেস্টার সাপোর্ট করি। কুপার বলছেন, কোনো আমেরিকান বৈমানিক ওর মাথায় বোমা ফেললে ওর তবু একটা সান্ত্বনা থাকবে যে, দুজনের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল!

এই উন্মাদনা বাংলাদেশকে মনে করিয়ে দেয় নাকি? এক মহাদেশের ফুটবলাররা আরেক মহাদেশে খেলছেন। আরও দূরের এই সবুজ বদ্বীপে তাদের জেতার লড়াইয়ে শামিল অসংখ্য মানুষ। এদেরও দ্বৈরথ চলছে, তবে কথায়। নির্বাচন, বাজার, টিভির পর্দা, চায়ের দোকান, বিশ্ববিদ্যালয়, বস্তি, নগর, গ্রাম—সব একাকার।

এটি সেই খেলা, মানচিত্রের সমস্ত দাগ, মতবাদের ঘুলঘুলিয়া আর লক্ষ্মীর পয়গাম ছাপিয়ে মানুষের এক হওয়ার পিপাসাকে যে ধারণ করে। কয়েক সেকেন্ডের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায়, নিঃশব্দ প্রার্থনা, অশ্রু অথবা উল্লাসে অদেখা পৃথিবীকে সে নিমেষে বেঁধে ফেলে।

বেলোস মনে করিয়ে দেন ১৯৯৮ বিশ্বকাপের পতিত দেবতা রোনালদোকে। দুঃসহ সেই ফাইনাল। পরের বিশ্বকাপে তাঁর প্রত্যাবর্তন, ব্রাজিলের পেন্টাজয়, মিডিয়ায় লেখা হলো পুরাণের সেই নায়ক তিনি, ‘মর্ত্যের সে-ই প্রথম মানুষ, যে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ পেয়েছে এবং নতুন করে লিখিয়েছে নিজের জীবনী’।

কিন্তু তাঁকেও নয়, বেলোস কাফুকে দেন নিঃশব্দ নায়কের আসন, জয় উদ্‌যাপনের প্রারম্ভে তিনি সতীর্থকে বলেছেন, ‘আমার জার্সিতে “জার্দিম ইরেনি” লিখে দাও।’ যখন তিনি দেবপুত্রের মতো বিশ্বকাপ নিয়ে দাঁড়ান, বেলোস বলতে ভোলেন না যে, ‘কাফুজো’ কালো এবং ইন্ডিয়ানদের সংকর জাতির নাম, পরপর তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা একমাত্র অধিনায়ক তিনি, শৈশব কাটিয়েছেন জার্দিম ইরেনি নামের বস্তিতে এবং আজ তিনি বিশ্বজয়ের স্মারক উঁচিয়ে ধরেছেন পৃথিবীর সামনে। ওই উঁচানো হাত সমস্ত মানুষের।