শান্তি সারথিদের স্বর্ণালি স্মৃতি

শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী

আফ্রিকার দেশগুলো শুধু ঘন সবুজ অরণ্যে শ্বাপদসংকুলই নয়, একই সঙ্গে ভয়ংকর রকম সংঘাতপ্রবণ। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই মহাদেশে জাতিগত সংঘাতের নতুন এক মাত্রা যুক্ত হয়েছে। রুয়ান্ডায় হুতি-তুতসিদের (১৯৯৪) প্রাণঘাতী সংঘাত বিশ্বজুড়ে নৃশংস গণহত্যার উদাহরণ হিসেবে আজও কুখ্যাত। এ ছাড়া সিয়েরা লিওন থেকে শুরু করে সদ্য স্বাধীন দক্ষিণ সুদানে সংঘাত-সংঘর্ষ, প্রাণহানি, রক্তপাত চলছেই। আর এই সংঘাতের মধ্যেই হালকা নীল রঙের হেলমেট পরে, জীবন হাতে নিয়ে শান্তির জলপাই পাতা ফেরি করে আসছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। শুধু সংঘাত নিরসনেই নয়, অবকাঠামো নির্মাণে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সংঘাত থামানো ও অবকাঠামো উন্নয়নের এই কর্মযজ্ঞে প্রাণও বিসর্জন দিচ্ছেন লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা। সবশেষ তথ্যে জানা যায়, বিশ্বে শান্তির পতাকা ওড়াতে এখন পর্যন্ত ১৩৪ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী প্রাণ দিয়েছেন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন দুই শতাধিক।
শান্তিরক্ষী শিরোনামের বইটি মূলত শান্তি সারথিদের কথা। ৩৩ অনুচ্ছেদের অনন্য এক সংকলন। বিশ্ব শান্তিতে ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশ যে অবদান রেখে আসছে, সেই সব সোনালি অধ্যায়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে মেজর মো. দেলোয়ার হোসেন গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন। শান্তিরক্ষীরা তাঁদের মূল্যবান অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন বইটির পাতায় পাতায়। এতে যেমন রয়েছে ডিআর কঙ্গোর আ্যভেবায়ের রক্তারক্তির কাহিনি, আছে আইভরি কোস্টের বিস্কুট ও বুলেটের কথা। বিস্কুট ও বুলেটের গল্প তুলে ধরতে গিয়ে মেজর মোহসীন হাসান ইমরান (বিএসপি) বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে গ্রামের তুলনামূলক বর্ণনা দিয়েছেন। আইভরি কোস্টের একটি গ্রামের বর্ণনায় তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের গ্রামজুড়ে যে স্নিগ্ধতা থাকে তার ছিটেফোঁটাও নেই এখানে; বরং কেমন একটা মন খারাপ করা বিষণ্ন ভাব আর রুক্ষতা ছড়িয়ে আছে চারপাশে।’ সহজেই অনুধাবন করা যায়, কতটা প্রতিকূল পরিবেশ আর মানসিক চাপ নিয়ে কাজ করতে হয় সৈন্যদের।

শান্তিরক্ষী সম্পাদনা: মেজর মো. দেলোয়ার হোসেন প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন ঢাকা, প্রকাশকাল: মে ২০১৮, ৩১৬ পৃষ্ঠা  দাম: ৬০০ টাকা।
শান্তিরক্ষী সম্পাদনা: মেজর মো. দেলোয়ার হোসেন প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন ঢাকা, প্রকাশকাল: মে ২০১৮, ৩১৬ পৃষ্ঠা দাম: ৬০০ টাকা।

আফ্রিকার পরিবেশগত রুক্ষতা ও মিলিশিয়াদের বর্বরতার গা শিউরানো বর্ণনা পাওয়া যায় মেজর মো. হাসান শাহরিয়ারের ‘ভিলেজ চিফ মাগুরো’ স্মৃতিকথায়। এতে উঠে এসেছে একজন গ্রামপ্রধান (মাগুরো), অপহৃত ইউরোপীয় সাংবাদিক এবং ইউএনডিপির উন্নয়নকর্মীদের কীভাবে উদ্ধার করেছিলেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা।
শান্তিরক্ষীতে পাওয়া যাবে এমন অনেক গৌরবগাথার বিস্তর বিবরণ। ১৯৫২ সালে রক্তের বিনিময়ে যে ভাষা আমরা পেয়েছিলাম, সেই বাংলা ভাষাকে সিয়েরা লিওন সরকার তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ২০০২ সালে। ভাষার সেই গৌরব অর্জন আর বর্তমানে আফ্রিকার বুকে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে বিস্তর বর্ণনা দিয়েছেন মেজর (অব.) মো. আসাদুল্লাহ (পিএসসি)। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতায় লিখেছেন, ‘আমাদের মাতৃভাষা দিয়েই একটা বিবদমান দেশের মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব মিটিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছি। এরই প্রতিদান হিসেবে একদিন পুরো বিশ্ববাসীকে অবাক করে দিয়ে সিয়েরা লিওন সরকার বাংলা ভাষাকে তাদের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করল।’ আসলেই কী অনন্য অর্জন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের, কী অসাধারণ অর্জন বায়ান্নর শহীদদের। তাঁদের আত্মত্যাগ আর সেনাবাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের আন্তরিক পেশাদারির ফলাফল হিসেবে আজ আফ্রিকার গহিনে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলা শব্দ। মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করছে আমাদের বাংলা ভাষায়। এ রকম নানা অর্জন আর বিসর্জনের কাহিনিই পাঠকের জন্য অপেক্ষা করছে শান্তিরক্ষী নামের বইয়ে।
শান্তিরক্ষা মিশনে বর্তমানে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তারাও কৃতিত্বের সঙ্গে অবদান রাখছেন। ফলে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ফিরোজ আল মুজাহিদ খানের একটি স্মৃতিকথা স্থান পেয়েছে এখানে। তিনি লিখেছেন সার্জেন্ট মারভিনের কথা। জ্যামাইকার পুলিশ সার্জেন্ট মারভিনের দুঃখগাথা বর্ণনা করতে গিয়ে তুলে ধরেছেন লাইবেরিয়ার সংঘাত আর সংকটের নানা গল্প। এই অংশে একজন প্রাণোচ্ছল, সহজ-সরল, হাসিখুশি মারভিনের জীবনকথা পাঠকের ভালো লাগতে পারে।
তবে বইটিতে শান্তি মিশনে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া বাংলাদেশি সৈনিক-অফিসারদের সম্পর্কে আরও বেশি কিছু থাকলে আরও ভালো হতো। তাঁরাই তো এ দেশের সাম্প্রতিক সময়ের প্রকৃত ‘বীর’, যাঁরা মাথায় নীল হেলমেট আর হাতে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে শান্তি স্থাপনে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আশা করছি, আগামীতে সেসব কাহিনি আরও বিস্তারিতভাবে উঠে আসবে। এ রকম বিচিত্র বিষয় নিয়ে চমৎকার একটি বই প্রকাশ করার জন্য প্রথমা প্রকাশনকে ধন্যবাদ।