সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত চিঠি

সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯—৮ জুলাই ২০০৩)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯—৮ জুলাই ২০০৩)। ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯—৮ জুলাই ২০০৩) যেমন অনেকেই চিঠি লিখতেন, তেমনি তাঁর নিজের রচিত-প্রেরিত চিঠিও পরিমাণে বিপুল-বিশাল। প্রাপ্ত পত্রাবলি ও তৎসংক্রান্ত স্মৃতির মিশেলে তিনি চিঠির দর্পণে (১৯৯৬) নামে একটি আস্ত গদ্যগ্রন্থই লিখে ফেলেছিলেন। চিঠি পেলে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আনন্দিত হতেন, এমনটা তাঁর নানা লেখা থেকেই জানা যায়। তাই চিঠি লিখতে তাঁর কোনো ক্লান্তি না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁর লেখা চিঠির কোনো সংকলন আমাদের জানামতে এখনো প্রকাশ পায়নি। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো পত্রপত্রিকায় কিছু চিঠি প্রকাশ পেলেও তা যথেষ্ট নয়।
সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী শহরের এক তরুণ শিক্ষার্থীকে লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি চিঠি। পত্র-প্রাপক হাসিবুল ইসলাম একসময় অধ্যাপনা করেছেন, পরে পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিজীবন শেষ করে এখন অবসরে। ১৯৭২ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেœস্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন পাঠ্যক্রমের অঙ্গ হিসেবে একটি অভিসন্দর্ভ রচনার প্রয়োজন পড়ে। কলেজে পড়ার সময় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত নাজিম হিকমতের কবিতার বইটি তাঁর মনকে খুব নাড়া দিয়েছিল। সে জন্য রাজশাহীতে কবির রচিত গ্রন্থ ও আনুষঙ্গিক উপাদানের চরম অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েই গবেষণা করবেন বলে শেষমেশ মনস্থির করেন। কাজে নামার পর বিভাগীয় গবেষণা-তত্ত্বাবধায়ক কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের নির্দেশে তিনি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে কিছু দরকারি প্রশ্ন ও তখন অব্দি প্রকাশিত তাঁর বইয়ের তালিকা চেয়ে একটি চিঠি লেখেন। সঙ্গে সামনাসামনি দেখা করার অনুমতিও চান।
দিলদরাজ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও আন্তরিকতার সঙ্গে ত্বরিত ও ইতিবাচক উত্তর দেন ১ নভেম্বর ১৯৭২ তারিখে লেখা বক্ষ্যমাণ চিঠিতে। উল্লেখ্য, মাসখানেক বাদে কলকাতায় তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছিল। পরে হাসিবুল ইসলাম ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কবি ও কবিতা’ শিরোনামে নিজের স্নাতকোত্তর অভিসন্দর্ভটি জমা দিয়ে ডিগ্রিলাভ করেন। সম্ভবত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে এটিই প্রথম গবেষণা। সম্প্রতি তিনি গবেষণাপত্রটি বই আকারে প্রকাশের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন।
ইনল্যান্ড লেটারে লেখা তিন পৃষ্ঠার চিঠিটি এখানে হাসিবুল ইসলামের সৌজন্যে মুদ্রিত হলো। চিঠিটি আকারে সংক্ষিপ্ত হলেও এখানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবন-আলেখ্য ও রাজনৈতিক চেতনা বেশ স্পষ্টরূপে পাওয়া যায়। ফলে এই চিঠির গুরুত্ব নেহাত কম নয়। পাশাপাশি মিলবে তাঁর তখনকার জীবনযাপন-সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা ও দুশ্চিন্তামাখা উদ্বেগের প্রসঙ্গও। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই চিঠিতে বর্তমান বানানরীতি অনুসৃত হয়েছে।

>

৫/বি ডা. শরৎ ব্যানার্জি রোড
কলকাতা-২৯
১। ১১। ৭২

কল্যাণীয়েষু,
গতকাল তোমার চিঠি পেলাম। তোমার গবেষণার বিষয় হয়ে আমার খুব মজা লাগছে। আমারও অসুবিধেগুলো তোমাকে জানিয়ে রাখি। অগোছালো, বাউন্ডুলে এবং লক্ষ্মীছাড়া স্বভাবের জন্যে শুধু আমার কবিতা সম্পর্কে অন্যের লেখা নয়, আমার নিজের লেখারও কোনো নকল আমার কাছে পাওয়া যাবে না। যেমন, পুরোনো পরিচয়ে প্রকাশিত ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেনের একটি সুদীর্ঘ প্রবন্ধ। পরে পরিচয়ের সংকলনে কিছুটা বোধ হয় কাটাছাঁটা হয়ে বেরিয়েছিল। আরও অনেকের লেখাই এখন আমার নজরের বাইরে।
যাই হোক, তুমি এলে একে-ওকে ধরে একবার খোঁজপাতা করে দেখতে পারি।
এবার সাধ্যমতো তোমার প্রশ্নাবলির উত্তর দিই:
(ক) জন্মসাল—১৯১৯ (উনিশ শো উনিশÑ মাঘ–সংক্রান্তি)।
বাল্যকালের পরিবেশÑ—আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।
(খ) আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। ক্লাস ফাইভ থেকে কলকাতায়। দর্শন নিয়ে এমএ পড়েছি। রাজনীতির দরুন পরীক্ষা দেওয়া হয়নি।
(গ) সমকালীন চিন্তাধারাÑ কথাটা ঠিক পরিষ্কার বুঝিনি। আমার সময়ের চিন্তাধারা? না ইদানীং আমি কী ভাবছি? তুমি এলে এ সম্বন্ধে বলা যাবে।
আমরা বড় হয়েছিলাম স্বাধীনতাসংগ্রামের আবহাওয়ায়। ব্রিটিশ শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে আমাদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড জ্বালা। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম শোষকশ্রেণির কোনো জাত নেই। জাতীয়তাবাদ তাদের কাছে মুখোশমাত্র। যখন পড়ে-শুনে একটু চোখ খুলল, তখন আমরা হলাম সেকালের রাগী ছোকরা। পুরোনো মূল্যবোধে আস্থা হারালাম, দেবদ্বিজে ভক্তি উবে গেল। কাউকে মানি না, কিছুতে বিশ্বাস নেই, সমস্ত ব্যাপারেই সন্দেহ—এই রকমের একটা ভাব। ভাঙার দিকেই একান্ত ঝোঁক। এই সময় পেলাম মার্ক্সবাদের খোঁজ। জগৎকে নতুনভাবে দেখতে শিখলাম। বিপ্লবের রাজনীতিকে ব্রত করলাম। লেখা ছেড়ে আন্দোলনে ডুবে গেলাম। এই ব্রতী জীবন আবার আমাকে লেখার রাজ্যে ভাসিয়ে তুলল। তারপর অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত। ঠেকেছি শিখেছি। কিন্তু বিশ্বাস হারাইনি।
(ঘ) ‘বামপন্থী’ শব্দটা আমার কাছে খুব সন্তোষজনক নয়। ইংরেজদের সংসদীয় ব্যবস্থায় এটা সরকারের বিরোধীপক্ষকে বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হতো। আমাদের দেশে এখন ‘বামপন্থী’ বলতে বোঝায় সমাজতন্ত্রবাদী। কিন্তু তার মধ্যে প্রচুর ভেজাল। আমার রাজনৈতিক ভাবনা এবং দলের দলী হওয়ার ক্রমবিকাশ ঘটে সংক্ষেপে এইভাবে: গোড়ায় জাতীয়তাবাদের অনুগামী। ক্রমশ গান্ধীবাদে অনাস্থা, সন্ত্রাসবাদে ঝোঁক, পরে গণ আন্দোলনে আস্থা। ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে বামপন্থীদের সঙ্গে সংযোগ। বামপন্থার সূত্রে মার্ক্সবাদে দীক্ষা। মার্ক্সবাদের সূত্রে শ্রমিক আন্দোলনে (ডক শ্রমিক) যোগ দেওয়া। প্রথমে লেবার পার্টি, পরে কমিউনিস্ট পার্টি। আমার পদাতিক লেখা হয় যখন আমি শ্রমিক আন্দোলনে নবাগত।
(ঙ) প্রকাশিত গ্রন্থ:
কবিতা: পদাতিক, চিরকুট, অগ্নিকোণ, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা, যত দূরেই যাই, কাল মধুমাস, এই ভাই, ছেলে গেছে বনে। অনুবাদ: নাজিম হিকমতের কবিতা, দিন আসছে।
গদ্য: আমার বাংলা, যখন যেখানে, নারদের ডায়রি, ডাকবাংলার ডায়রি, যেতে যেতে দেখা, ক্ষমা নেই, কথার কথা, ভূতের বেগার, বাঙালীর ইতিহাস, জগদীশচন্দ্র বসু, বাংলা সাহিত্যের সেকাল একাল। অনুবাদ: রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ, ব্যাঘ্রকেতন, কত ক্ষুধা, ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন, চে গুয়েভারার ডায়রি, রুশ গল্প সঞ্চয়ন।
ঠিক এই মুহূর্তে আমি একটু অব্যবস্থিত অবস্থায় আছি। একটা আংশিক সময়ের কাজ ছিল, অবস্থাচক্রে সেটা ছাড়তে হয়েছে। এক মাসের সংস্থান আছে। তারপর সংসার অচল। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
এই অনিশ্চয়তা আমার জীবনের সঙ্গী।
আশা করছি, তুমি এলে এবং আমি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় দেখা হবে।
স্নেহাশিস জেনো।
সুভাষ মুখোপাধ্যায়