বাঙালি তখন ফুটবল-বিরূপ

১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জয় করল মোহনবাগান। সেই হিসেবে বিজয়ী দল মোহনবাগানের এই এগারোজন খেলোয়াড় এ অঞ্চলে এনেছিলেন ফুটবলের প্রথম উন্মাদনা। ছবি: সংগৃহীত
১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড জয় করল মোহনবাগান। সেই হিসেবে বিজয়ী দল মোহনবাগানের এই এগারোজন খেলোয়াড় এ অঞ্চলে এনেছিলেন ফুটবলের প্রথম উন্মাদনা। ছবি: সংগৃহীত

ফুটবল নিয়ে কতই-না উত্তেজনা এখন চারপাশে। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল-ফ্রান্স-রাশিয়া-বেলজিয়াম—বিভিন্ন দলের সমর্থকদের উত্তেজিত তর্ক-বিতর্কে ম-ম করছে দশদিক। প্রতিদিন টেলিভিশনের সামনে রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা মানুষের—কোন দল জেতে। মোদ্দাকথা বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাদনায় মেতে আছে সরা দেশ। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাংলাদেশের মানুষের মনের পালেও লেগেছে নতুন হাওয়া। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বাঙালি এখন যতটা ফুটবলপ্রেমী, এক শ বছর আগেও কি ফুটবলের প্রতি তাদের এই প্রেম ছিল?
উত্তরে অনেকেই ‘অবশ্যই’ শব্দটি উচ্চারণ করবেন। সঙ্গে আরও বলবেন, বাঙালির কাছে ফুটবল তো শুধু খেলা নয়, সেকালে এই খেলা আমাদের স্বদেশি আন্দোলনের মন্ত্রেও উজ্জীবিত করেছিল। তবে আলোর বিপরীতে আঁধার থাকার মতো ফুটবল-বিষয়ে ইতিহাসের ভিন্ন রকম সত্যও আছে। শত বছর আগের পত্রপত্রিকার চিঠিপত্র ও নানান মন্তব্য-মতামতের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেসব ইতিহাস।
না, সেই ঔপনিবেশিক যুগে বাঙালির বড় অংশই ফুটবল নিয়ে আজকের মতো এতটা আকুল ছিল না। শুধু তা-ই নয়, কেউ কেউ এ খেলার প্রতি কতটা বিদৃষ্ট ছিলেন, সেটি জানতে আমাদের চোখ বোলাতে হবে ঢাকা প্রকাশ-এ মুদ্রিত একটি চিঠিতে। আজ থেকে এক শ বছর আগে ঢাকা প্রকাশ-এর সম্পাদকের কাছে নাম প্রকাশ না করে কেউ একজন একটি চিঠি দেন। সম্পাদক গুরুত্ব বিবেচনা করে পত্রিকায় ছাপিয়ে দেন চিঠিটি। ১৯ মে ১৯১৮ সালে ঢাকা প্রকাশ-এ প্রকাশিত সেই চিঠিতে ছিল:
এ দেশের ছেলেরা “ফুটবল” খেলিতে গিয়া কী ভাবে যে আপনাদের সর্ব্বনাশ সাধন করিয়া থাকে এবং তাহাদের উপাধিধারী শিক্ষকগণও কী ভাবে তাহাদের ঐরূপ সর্ব্বনাশের সহায়তা করিয়া থাকে, আমি স্বচক্ষে তাহা প্রত্যক্ষ করিয়াই আপনার পত্রিকায় তাহা প্রকাশ করিবার জন্য এই পত্রখানি লিখিলাম।
‘গত মঙ্গলবার দিন আমি চাঁদপুরের ষ্টিমারে নারায়ণগঞ্জ রওয়ানা হই। ঐ ষ্টিমারে এ জিলার একটা নাম করা স্কুলের (স্কুলের নাম করিলে হয়তো এখনই ইনস্পেক্টর সাহেব উক্ত স্কুলের মঞ্জুরী লইয়া টানা-হেঁচড়া করিবেন—এই আশঙ্কাই স্কুলের নাম গোপন রাখিলাম।) একদল ফুটবল খেলোয়াড় চাঁদপুর হইতে ফুটবল ম্যাচ খেলিয়া নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে আসিতেছিল। ঐ খেলোয়াড়দের দলে উক্ত বিদ্যালয়ের যে তিনজন শিক্ষক ছিলেন, তাহাদের দুইজনই বিএ উপাধিধারী। উক্ত খেলোয়াড়দের দল ষ্টিমারখানিকে যেন গুলজার করিয়া তুলিয়াছিল। উহাদের হাব-ভাব দেখিয়া আমি প্রথমে ভাবিয়াছিলাম যে, হয়তো ইহারা কোনো বিবাহের বরযাত্রী হইবে, কিন্তু পরে উহাদিগকে ফুটবল খেলোয়াড় বলিয়া জানিতে পারিলাম। ইহাদের তাস খেলার ভাবভঙ্গি দর্শনে ও অশ্লীল আলাপে জাহাজের অনেক ভদ্রবিশিষ্ট লোকই বিশেষ বিরক্ত হইয়াছিলেন। শিক্ষকে ছাত্রে তাস খেলা এবং শিক্ষকের সহিত ইয়ার্কি করিয়া ছাত্রগণের এরূপ অশ্লীল আলাপ-ব্যবহার চলিতে পারে, এমন কথা স্বপ্নেও কদাচ কেহ ভাবিতে পারে নাই। তাহাদের আলাপের ভাষা প্রকাশ্য সংবাদপত্রে লিখিয়া আর মসী-মুখ কলমকে কলঙ্কিত করিতে চাই না। আমরা অনেক সময় পাকা ফুটবল খেলোয়াড়দের মাদক দ্রব্য সেবনের কথাও শুনিয়াছিলাম। কিন্তু এত দিন তা বিশ্বাস করিতে প্রবৃত্তি হয় নাই। কিন্তু সেদিনের এইরূপ বীভৎস কাণ্ড দেখিয়া বুঝিতে পারিয়াছি যে আমাদের সেসব শোনা কথা একান্ত অলীক বা ভিত্তিবিহীন নহে। কর্তৃপক্ষ অনুগ্রহ করিয়া এ দেশ হইতে ফুটবল খেলা উঠাইয়া না দিলে, এ দেশের ছাত্রগণে ভবিষ্যৎ একান্তই অন্ধকার পূর্ণ হইয়া উঠিবে।
ঢাকা প্রকাশ ছিল ওই সময়ের পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় ও বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক। এই পত্রিকায় তখন এ ধরনের চিঠি প্রকাশের রেওয়াজ দেখা যায় না। সেই হিসেবে ফুটবল খেলার বিরোধিতামূলক এই চিঠিটি আমাদের জন্য খানিকটা চমকপ্রদই। এর আগে অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষ ভাগে এই বিরোধিতার ঘটনা আকছার পাওয়া যায়। ফুটবল নিয়ে আরেকটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যাক: 

ফুটবলে মৃত্যু—সমীরণ-এ (পত্রিকার নাম) দেখা গেল, দিনাজপুরের নিকট রাজারামপুরের একটি ১৪ বৎসরের বালক ফুটবল খেলায় উপুড় হইয়া পড়িয়া বুকে আঘাত লাগাতে প্রাণ ত্যাগ করিয়াছে। রাজশাহী কলেজের স্নেহাস্পদ ছাত্রগণ সাবধান।
এই সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৯-এর ৬ সেপ্টেম্বর রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক হিন্দু রঞ্জিকা পত্রিকায়।
উপরিউক্ত দুটি সংবাদের মাধ্যমে ফুটবলের প্রতি তদানীন্তন বাঙালি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে খানিকটা ধারণা পাওয়া যায়। আবার একইকালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও যখন লেখেন, ‘রাখাল বড় মন্দ বালক—সে সর্ব্বদা খেলিয়া বেড়ায়, সে মোটেই পড়াশোনা করে না’, তখন ফুটবলের প্রতি বাঙালিদের অনেকেই যে বিরূপ ছিল, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আর তখনকার দিনে মানুষের ভাবনা ছিল এমন: খেলা জিনিসটা লেখাপড়ার উল্টো কিছু।

১৯ মে ১৯১৮ সালের ঢাকা প্রকাশ। ছবি: সংগৃহীত
১৯ মে ১৯১৮ সালের ঢাকা প্রকাশ। ছবি: সংগৃহীত

এক্ষণে নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে, আজ থেকে শতবর্ষ আগে ফুটবলের প্রতি বাঙালি আমজনতার দৃষ্টিভঙ্গি অতটা প্রসন্ন ছিল না। একদিকে বঙ্গদেশে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে ফুটবল, অন্যদিকে এই খেলা সম্বন্ধে নিজেদের উদ্বেগ ব্যক্ত করছেন বিভিন্ন মানুষ—ঊনবিংশ শতকে এমন ঘটনার সংখ্যা কম নয়। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র-এর মাসিক বসুমতী পত্রিকার দিকে এবার চোখ ফেরানো যাক। এখানে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত ফুটবল সম্পর্কে বাঙালির সাধারণ অনুভূতি সম্পর্কে সত্যেন্দ্রকুমার বসু উল্লেখ করেন:
ইহা [ফুটবল] বিজাতীয় বিদেশীয় খেলা, পরন্তু ইহা বহুব্যয়সাধ্য খেলা। এই হেতু ইহা আমাদের ধাতুসহ নহে। আমাদের জাতীয় খেলা হাডুডুডু (চুচু অথবা সেল কপাটী) অথবা গুলীডাণ্ডা আমাদের ধাতুসহ। এই দরিদ্র দেশে যে খেলায় গাঁটের কড়ি ব্যয় নাই, সেই খেলাই আমাদের মতো দরিদ্র জাতির ধাতুসহ। এ সব খেলায় য়ুনিফরম নাই, গোল পোষ্ট নাই, বল নাই, ব্ল্যাডার নাই, এসোসিয়েশান বুট নাই, নেট নাই, হাফটাইম নাই, মাঠভাড়া নাই, তাঁবু নাই, মালী নাই, কিছু নাই,—আছে কেবল নিছক মালকোচ মারা আর মাঠে নামিয়া পড়া, ঘন্টাখানেক ছুটাছুটি করিয়া দম করিয়া ঘরের ছেলে ঘরে ফিরিয়া আসা!
খেলাধুলা সম্পর্কে বাঙালির প্রচলিত ধারণা কেমন ছিল? ভারতবর্ষ পত্রিকায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যায় ‘খেলা’ শিরোনামের লেখায় সতীশচন্দ্র ঘটক লিখেছিলেন:
অনেকে খেলা বললে বোঝেন বাজে কাজ—অর্থাৎ যার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজনীয়তা নেই,—যা কেবল কোনরকমে সময় অতিবাহিত করবার উপায়।...খেলাতে সমাজের কি উপকার হয়, দশের কি উপকার হয়?...অনেকে ভাবেন, খেলা করাটা বাজে কাজ, অর্থে কুঁড়ের কাজ। হাতে অন্য কাজ না থাকলে লোকে খেলে।...অনেকে বলেন, খেলাটা জীবনের গভীর উদ্দেশ্যের অঙ্গীভূত নয়—উহা অবাস্তব ও কৃত্রিম। আমাদের জীবন উদ্দেশ্যমূলক বাস্তব কাজের দ্বারা গঠিত, খেলার দ্বারা উহার সামান্য অংশও গঠিত হয় নাই।...যে সব ছেলে লেখাপড়া করতে কষ্ট বোধ করে, তারা খেলতে আনন্দই বোধ করে।...অনেকে বলেন, খেলার সঙ্গে অন্য কাজের তফাৎ এই যে, অদ্য কাজ বেশী করলেও দোষ নেই, কিন্তু বেশী খেল্লেই সর্ব্বনাশ।...বেশী খেলেছ কি, আখেরে পস্তাতে হবে। সেইজন্য খেলা জিনিসটাই খারাপ, ওটা যত না করা যায় ততই ভাল।
ফুটবলের বিরোধিতার পক্ষে বাঙালি যে কারণগুলো দাঁড় করায়, আলোচ্য লেখায় সতীশচন্দ্র সেগুলো উল্লেখ করে তা খণ্ডন করার চেষ্টাও করেছিলেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে—যখন পাশ্চাত্য থেকে আমদানিকৃত ফুটবল বঙ্গদেশে প্রবেশ করছে—সেই সময়ে এ খেলার ব্যাপারে তেমন কোনো আকর্ষণ লক্ষ করা যায় না।। দু-একটি মিশনারি স্কুল ছাড়া অন্যত্র ফুটবল বা পাশ্চাত্য থেকে আগত খেলাগুলোর চর্চা ছিল না বললেই চলে। খেলার মধ্যে বাঙালির প্রিয় ছিল শতরঞ্জ, পাশা, তাস আস্তা-কাস্তে, দশ-পঁচিশ, বাঘবন্দী, হাডুডু, ডান্ডাগুলি, ঘুড়ি ওড়ানো, কুস্তি, ভেড়ার যুদ্ধ, বুলবুল ও মোরগের লড়াই, যোগব্যায়াম, সাঁতার, চৌগান, জিমনেসটিক, গেণ্ডুয়া, গুলতি প্রভৃতি। বাঙালির খেলাধুলার দর্শন সম্পর্কে প্রবাদ আছে, ‘দৌড়ের চেয়ে হাঁটা উত্তম, হাঁটার চেয়ে দণ্ডায়মান, দণ্ডায়মান অপেক্ষা বসা উত্তম আর শয্যাগ্রহণ সর্বোত্তম।’
এ ধরনের আবহাওয়ায় বাস করার পরেও বাঙালিদের কিছু অংশের মধ্যে পশ্চিমা খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ যে একেবারেই ছিল না সেটিও পুরোপুরি সত্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত শারীরিক যোগ্যতার ঘাটতি আর অভিজ্ঞতার অভাবের কারণে বাঙালির খেলাধুলার উদ্যোগ বারবারই হোঁচট খেয়েছে। পত্রপত্রিকার নানাবিধ লেখাজোকায় ছড়িয়ে আছে তার নিদর্শনও। ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের মাসিক বসুমতীর চৈত্র সংখ্যায় সত্যেন্দ্রকুমার বসু লিখেছেন:
এ দেশে প্রথমে রাগবি খেলার আমদানি হয়। প্রথম মনে পড়ে, গড়ের মাঠের মনুমেন্টের কাছে একটা মাঠে “বাফস” নামক গোরা সেনাদলের সহিত বাঙ্গালী “ওকস” নামক দলের এক রাগবি ম্যাচ হইয়াছিল। বাঙ্গালীরা খালি পায়ে খেলিয়াছিল ও পেট ভরিয়া হারিয়াছিল। তাহাদের কাহারও কাহারও দাঁত ভাঙ্গিয়াছিল, কাহারও মাথা ফাটিয়াছিল, কাহারও হাত পা মচকাইয়া গিয়াছিল। ইহার পর “ওকস” দল পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হয়। ইহা বোধ হয় ১৮৮৫-৮৬ খৃষ্টাব্দের কথা।
ফুটবলসহ প্রায় সব আধুনিক ক্রীড়ার পূর্বশর্ত হলো উন্নত শারীরিক সামর্থ্য। শারীরিক দুর্বলতার কারণে বাঙালি দীর্ঘদিন নিজেকে আধুনিক খেলাধুলা থেকে দূরে রেখেছে—এ নজির দুর্লভ্য নয়। বাঙালির শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভাষ্য হলো, ‘পূর্ব্বকালে বাঙ্গালিরা যে বাহুবলশালী ছিলেন এমত কোনো প্রমাণ নাই। পূর্ব্বকালে ভারতবর্ষস্থ অন্যান্য জাতি যে বাহুবলশালী ছিলেন, এমত প্রমাণ অনেক আছে, কিন্তু বাঙ্গালিদিগের বাহুবলের কোন প্রমাণ নাই। হোয়েন্ত সাঙ (হিউয়েন সাঙ) “সমতট” রাজ্যবাসীদিগের যে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা পড়িয়া বোধ হয় পূর্ব্বে বাঙ্গালিরা এইরূপ, খর্ব্বাকৃতি দুর্ব্বল গঠন ছিল। (বঙ্গদর্শন, শ্রাবণ ১২৮১)। আরও এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘বাঙ্গালিদের শারিরিক দৌর্ব্বল্যই তাহাদের পৌরুষাভাবের প্রধান কারণ।’ (বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১২৮৯)। এরও আগে পত্রিকায় প্রকাশ পায়, ‘বাঙালির অধঃপতনের জন্য নিম্নমানের শারীরিক যোগ্যতাকে দায়ী করলে তা বাড়িয়ে বলা হবে না।’ (ঢাকা রিভিউ, জুন ১৮৭৬)।
এক শ্রেণির বাঙালির এমন অভিযোগ ছিল, ফুটবল এবং পাশ্চাত্য থেকে আমদানি করা সব খেলাধুলাই বিজাতীয় খেলা এবং আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। একসময় তারা এসব ক্রীড়াকে দেশীয় সংস্কৃতির ওপর সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন বলে মনে করতেন। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রচারণাও ছিল জোরালো। প্রথম দিকে বাঙালির ফুটবল-বিরূপতার পেছনে সম্ভবত এটিই ছিল বড় কারণ।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ধীর-লয়ে বাঙালি সংস্কৃতিতে স্থান করে নিতে শুরু করে ফুটবল। বদলাতে শুরু করে ফুটবলের প্রতি সাধারণ বাঙালির নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও। বিশেষত ১৯১১ সালের মোহনবাগান ক্লাবের আইএফএ শিল্ড জয়ের মাধ্যমে বাঙালির ফুটবল দর্শনে ঘটে যায় নীরব বিপ্লব। এর এক যুগ পরে বাঙালির ফুটবলপ্রীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সে সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের পুনরায় মাসিক বসুমতীর ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত সত্যেন্দ্রকুমার বসুর লেখার দিকে তাকাতে হবে। তিনি লিখলেন:
ফুটবল খেলায় মোহনবাগান বা অন্য কোন বাঙ্গালীর প্রিয় খেলোয়াড় দলের হারজিত সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক হাতাহাতিতে পরিণত হইতে দেখা গিয়াছে। লীগ, শিল্ড, ট্রেডস্ বা অন্য কাপ-খেলা হইলে সহরের ও সহরতলীর ১৫ আনা ভাগ ছেলে বেলা ১টার পর হইতেই মাঠে ছুটিতে থাকে, ইহা বোধ হয়, অনেকে প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। ট্রাম, বাস, ট্যাক্সির কোথাও তিলধারণেরও স্থান থাকে না। গাঁটের পয়সা খরচ করিয়া, ঘুষাঘুষি ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি করিয়া, কাপড়-জামা ছিড়িয়া, লাঞ্ছিত অপমানিত হইয়া, মাঠ হইতে “ম্যাচ” দেখিয়া ফিরিতে বাঙ্গালীকে অনেকেই দেখিয়াছেন। এক এক ম্যাচে কত হাজার হাজার টাকার ছিনিমিনি খেলা হইয়া যায়, তাহাও অনেকে জানেন। বাঙ্গালীর ছেলেকে ফুটবল ক্লাবের ঠিঁকুজী-কুলুচি জিজ্ঞাসা করিলে খেলোয়াড়দের নামধাম বিষয়ে উর্ধ্বতন চতুর্দ্দশ পুরুষ পর্য্যন্ত অনর্গল আওড়াইয়া যাইবে, “পাল”, “রবি গাঙ্গুলী”, “বলাই চাটুয্যে” বলিতে সে অজ্ঞান হইবে, কিন্তু তাহার নিজের পিতামহের নাম জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে পারিবে না। এমনই বাঙ্গালীর ফুটবলের নেশা!
মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড বিজয় ও বাঙালির ফুটবল দর্শনে এর প্রভাব বিষয়ে ক্রীড়া ইতিহাসবিদ কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বিশ শতকের প্রথমার্ধে অবিভক্ত বাংলার সমাজ জীবনের একটি দৈনন্দিন বৈশিষ্ট্য ছিল ফুটবল খেলার বিকাশ ও জনপ্রিয়করণ। একটা ক্রমবর্দ্ধিত সংখ্যক মানুষ খেলাটিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। খেলোয়াড় বা কর্মকর্তা হিসেবে, দর্শক হিসেবে কিংবা পাঠকরূপে। বলা যায় যে, উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের যে রূপ ধর্ম, সমাজ, সাহিত্য ও চিত্রকলার মতো সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রত্যক্ষ হয়েছিল, তা ক্রমশ ফুটবল মাঠেও স্পর্শ করেছিল।’ (১৯১১: বাঙালির ঐতিহাসিক ফুটবল যুদ্ধ, পৃ. ৫)।
এই যে বদলে গেল বাঙালির ফুটবল দর্শন, ফুটবল-বিরূপ বাঙালি আস্তে আস্তে হয়ে উঠল ফুটবলপ্রেমী, এর নেপথ্যে মোহনবাগান ক্লাবের ঐতিহাসিক জয় ছাড়াও ছিল আরও নানান ঘটনা, যার মধ্যে স্বদেশিকতা ছিল অন্যতম এক অনুষঙ্গ। বাঙালির ফুটবল-বিরূপতা ও ফুটবল-প্রেম—সবই আমাদের সামাজিক ইতিহাসের অংশ। ফলে ফুটবলের উন্মাদনার এই প্রহরে বাঙালির ফুটবল-বিরূপতার অনালোচিত অধ্যায়ের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আমরা নিশ্চয় কোনো অপরাধ করিনি।