আমার উজ্জ্বল হালিমা আপা

>হালিমা খাতুন ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। তোমাদের জন্য লিখেছেন গল্প ও ছড়া। ৩ জুলাই, ৮৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। কেমন মানুষ ছিলেন তিনি? তাঁর সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন শিশুসাহিত্যিক আখতার হুসেন

হালিমা খাতুন, আমার হালিমা আপার সঙ্গে হঠাৎ করেই পরিচয়। বলা যায় একটু নাটকীয়ভাবেই।
১৯৭৩ সালের শেষ দিকের কথা। আমি তখনকার সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য বিভাগে চাকরি করি। সেদিন কী উপলক্ষে যেন অফিস ছুটি ছিল। বাংলা একাডেমি ছিল খোলা। আমি সুযোগ পেলেই তখন পুরোনো বইপত্রের দোকানে ঢুঁ মারতাম—সদরঘাট থেকে শুরু করে নীলক্ষেতের পথের পাশের দোকানগুলোতে। খোঁজ করতাম নানা কিসিমের দুর্লভ সব বই। বেশ সস্তাও ছিল।
তো সেদিন আর আমি পুরোনো বইয়ের দোকানে যাইনি। গিয়েছিলাম বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে। তখন লাইব্রেরি ছিল বর্ধমান হাউসের নিচতলায়—ডান ও বাঁ পাশজুড়ে। বিশাল বইয়ের রাজ্য। অবশ্য লাইব্রেরির কর্মচারীদের কাছ থেকে বলে-কয়ে বই নিয়ে পাঠকদের তা পড়ার ব্যবস্থা ছিল ডান পাশের ঘরে।
সেদিন লাইব্রেরির পড়ার এই ঘরে পাঠক বলতে আমরা দুজন—ফরসামতো গোলগাল চেহারার মাঝ বয়সী এক মহিলা আর আমি। মহিলার এক চেয়ার পরেই আমি বসেছি। তিনি আমার একটু আগেই এসেছিলেন। একঝাঁক বই তাঁর সামনে। একটু উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম সবই ছোটদের উপযোগী বই—ছড়া, গল্প ও উপন্যাস। আমার একটু কৌতূহল হতেই একটু ভালো করে মহিলার বইগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরালাম। দেখলাম এখলাসউদ্দীন আহমদের এক যে ছিল নেংটি, হাবীবুর রহমানের আগডুম বাগডুম-এর দুই খণ্ড, সংকলন সপ্তডিঙা, ফয়েজ আহমেদের জোনাকী, আতোয়ার রহমানের তেপান্তরের রূপকথা, মোহাম্মদ নাসির আলীর লেবুমামার সপ্তকাণ্ড এবং একটু ইতিউতি করতেই দেখতে পেলাম আমার জীবনের প্রথম গল্পের বই সমুদ্র অনেক বড়। আমি একটু অবাক হলাম সব বড় বড় নমস্য লেখকদের বইয়ের সঙ্গে আমার বইটি দেখে। ভেতরে ভেতরে আমি উল্লসিত হতে থাকি এই ভেবে যে তাহলে আমি লেখক হতে পেরেছি, না হলে এই ভদ্রমহিলা প্রবীণ সব লেখকের বইয়ের সঙ্গে আমার বইটি বেছে নেবেন কেন? হঠাৎ একটা অস্থির ভাব পেয়ে বসে। আমি স্থির থাকতে পারি না। মহিলাকে গলা নিচু করে সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করি, ‘আপা, মাফ করবেন। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
আমার দিকে তিনি ফিরে বলেন, ‘না, মনে করার কী আছে! বলুন কী বলবেন?’
‘আপনি আখতার হুসেনের সমুদ্র অনেক বড় বইটা পড়তে নিয়েছেন কেন? সে তো নতুন লেখক।’
ভদ্রমহিলার জবাব, ‘বইটার কথা এখলাস সাহেব আমাকে বলেছেন। বলেছেন বইটা তাঁর কাছে খুব ভালো লেগেছে। আমি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্য নিয়ে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখতে যাচ্ছি তো, তাই এই জোগাড়যন্তর।’
কত ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমি! লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ঝটপট বলে ফেলি, ‘জানেন আপা, বইটার লেখক আমি। আমার নাম আখতার হুসেন।’
তিনি আমার দিকে ঝকঝকে দৃষ্টিতে তাকান। তবে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তাঁকে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘আপা, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনার নামটা যদি...।’
‘আমার নাম হালিমা খাতুন। আমিও লিখি। ছোটদের জন্যই।’
‘আপনি হালিমা খাতুন?’ আমি যেন আকাশ থেকে পড়ি। তারপর বলি, ‘আপনি আজ থেকে আমার বড় আপা। জানেন, আপনার লেখা ছোটগল্পের বই সোনা পুতুলের বিয়ের গল্পগুলো আমার অসম্ভব প্রিয়। আমি কতবার যে পড়েছি, তার শেষ নেই। আমার ছোট ভাইবোনদেরও পড়তে দিয়েছি। তারা তো পড়ে মহাখুশি!’
‘আমি আজ আপনার সমুদ্র অনেক বড় নিয়ে যাচ্ছি লাইব্রেরি থেকে ইস্যু করে। পড়ে মন্তব্য জানাব। অনুগ্রহ করে আপনার টেলিফোন নম্বরটা দেবেন কি?’
আমি ঝটপট কাগজে লিখে দিই আমার অফিসের টেলিফোন নম্বর এক্সটেনশন নম্বরসহ। কী অবাক করা ব্যাপার, দুদিন পরেই হালিমা আপার টেলিফোন, ‘আখতার হুসেন বলছেন?’
‘জি বলছি।’
‘আমি হালিমা আপা বলছি। আপনার সমুদ্র অনেক বড় পড়ে শেষ করেছি। বিশ্বাস করুন, এ বইয়ের প্রতিটি গল্প সুন্দর। আমার চোখে পানি এনে দিয়েছে দুটি গল্প ‘চকরি’ আর ‘খেলনা পুতুল’। তারপর একটু দম নেন। নিয়ে বলেন, ‘আমার বাসায় আপনার একদিন দুপুরের দাওয়াত রইল।’
কথা রেখেছিলেন হালিমা আপা। চার প্রকারের ছোট-বড় মাছ দিয়ে, সঙ্গে আরও কিছু ঝোল-অম্বল দিয়ে আমাকে দাওয়াতি খাওয়া খাইয়েছিলেন। তাঁর রান্নার হাতও ছিল অপূর্ব।
ধীরে ধীরে তাঁর সম্পর্কে জেনেছি। বাগেরহাটে তাঁর জন্ম। ১৯৩৩ সালের ২৫ আগস্ট। শিক্ষিত ঘরের সন্তান। গ্রামে ও মফস্বলে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও বাংলাসাহিত্যে, শেষে ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি (মোট ৩ বার) লাভ করেন। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গবেষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্দার্ন কলেরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ছিল তাঁর সক্রিয় ভূমিকা। তাঁকে বাদ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সত্যিই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঢাকা শহরের তখনকার স্কুল-কলেজের মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সমবেত করার ব্যাপারে হালিমা আপার যে সক্রিয় প্রয়াস, তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। একবার আমি আপাকে বলেছিলাম ভাষা আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণের কথা স্মৃতিকথার আকারে লিখতে বলেছিলাম। কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু লেখা হয়ে উঠেছিল কি না, জানতে পারিনি। অনেক দিন যাবৎ তাঁর সঙ্গে আমার আর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
তবে তাঁর বই যখন যেটা বেরিয়েছে, কিনতে দ্বিধা করিনি। কেননা, হালিমা আপার ছোটদের লেখার জগৎ অন্যদের থেকে একেবারে আলাদা। ৫০টিরও বেশি তাঁর বই। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য: হরিণের চশমা, কুমিরের বাপের শ্রাদ্ধ, কাঁঠাল খাব, পশুপাখির ছড়া, পাখির ছানা, বাঘ ও গরু, বাচ্চা হাতির কাণ্ড, সবচেয়ে সুন্দর ও মানিক পেয়ে রাজা।
তাঁর সাহিত্য কৃতির স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮১ সালে শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি পুরস্কার, নুরুন্নেসা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী সাহিত্য পুরস্কার, সুন্দরম সাহিত্য সম্মেলন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট পুরস্কার ও তমদ্দুন মজলিশ মাতৃভাষা পুরস্কার ইত্যাদি।
হালিমা খাতুন নিরহংকারী মানুষ ছিলেন এবং রসিকও ছিলেন। একবার তাঁর অসুখের কথা শুনে ইন্দিরা রোডের বাসায় তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। দিয়ে দেখি, কোথায় তাঁর অসুখ? দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন ঘরজুড়ে। বললাম, ‘আপনার না অসুখ, আপা?’
‘স্রেফ মিথ্যে কথা। অসুখের কথা না বললে কি তুমি আমাকে দেখতে আসতে? তাই অসুখের কথা ছড়িয়ে তোমাদের ডেকে আনা।’
এই তো হালিমা আপা। সেই হালিমা আপা চলে গেছেন সেই না-ফেরার দেশে, যেখানে আগে-পরে সবাইকেই যেতে হবে। তবে রয়ে গেছে তাঁর স্মৃতি, তাঁর কাজের ইতিহাস এবং তাঁর ছোটদের জন্য রচিত সাহিত্য, যা কোনো দিন মুছে যাবে না।