ইংরেজি অনুবাদে 'আয়েশামঙ্গল'

আয়েশামঙ্গল ও দ্য ব্যালাড অব আয়েশার প্রচ্ছদ
আয়েশামঙ্গল ও দ্য ব্যালাড অব আয়েশার প্রচ্ছদ

আনিসুল হকের বই পড়তে শুরু করলে শেষ না করে পারা যায় না। তাঁর গল্পের মেদহীন কাঠামো, তাঁর ভাষার স্পষ্টতা এবং যেকোনো চরিত্রকে গড়ার ক্ষেত্রে তাঁর কুশলতা রয়েছে এই আকর্ষণের মূলে। আনিস রোমান্টিক মেজাজের গল্প লিখেছেন, উত্তরাধুনিক উপন্যাসও লিখেছেন; আবার আমাদের সময়ের ইতিহাস—ব্যক্তি বা সমষ্টির ওপর এর অভিঘাত—নিপুণ রেখায় ফুটিয়ে তুলেছেন এমন কিছু উপন্যাসে, যেগুলোকে ঐতিহাসিক বা এ রকম কোনো শ্রেণিতেও ফেলা যাবে না। আমার বিবেচনায় এগুলো খণ্ড খণ্ড কালচিত্র, যার সঙ্গে বাঙালির আত্মপ্রকাশের ইতিহাস, কিংবদন্তি এবং নিতান্ত ব্যক্তিগত অনেক বয়ান মিলেমিশে থাকে। তাঁর মা উপন্যাসটির কথাই ধরা যাক। এর গল্পজুড়ে উনিশ শ একাত্তরের প্রবল উপস্থিতি, কিন্তু এটি এক নারীর জীবনযুদ্ধের ইতিহাসও, যে যুদ্ধে একাত্তর একটি অনিবার্য পরিণতি এনে দিলেও তাঁর নিজস্ব কষ্ট-দুঃখ, তাঁর আত্মসম্মানবোধ এবং মানুষ হিসেবে নিজের অধিকার আদায়ের গল্পটাও কোনোক্রমে আড়ালে থাকে না। শেষ বিচারে এটি মন কেড়ে নেওয়া এক মানবিক গল্প।

তেমনি আরেকটি উপন্যাস আয়েশামঙ্গল। ১৯৯৭ সালে এটি প্রকাশিত হলেও আমার হাতে এসেছে অনেক পরে। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় ছিনতাই করা জাপানি এক বিমান নামে এবং তার কদিনের মধ্যে বিমানবাহিনীতে—আরও স্পষ্ট করে বললে এর কিছু কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সদস্যের জীবনে—এক বিপর্যয় নেমে আসে। অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে যা হয় আরকি। সামরিক আদালতে বিচার হয় অভিযুক্তদের, যদিও অভিযোগটা ঠিক কী, অনেকে সেটি বুঝতে অপারগ ছিলেন। মৃত্যুদণ্ড যাঁদের দেওয়া হয়, তাঁদের আত্মীয়স্বজনও ঠিক জানতে পারেননি কোথায় ও কখন তা কার্যকর করা হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন ছাপা হয়। আনিসুল হক তাঁর মা এবং অন্য কয়েকটি উপন্যাসে (যারা ভোর এনেছিল, বীর প্রতীকের খোঁজে) একজন সাংবাদিকের অনুসন্ধানী দৃষ্টির ও সংবাদ সংগ্রহের কুশলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। সাংবাদিকতা তাঁর পেশা এবং ’৭৭-এর ঘটনাগুলো তাঁর খেয়ালেও ছিল। ঘটনার অনেক দিন পর ভোরের কাগজ-এ একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল এক অভিযুক্তকে নিয়ে। এর বিপরীতে ছিল আরেকটি ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে এক স্বামীর সন্ধান করে যাচ্ছিলেন তাঁর স্ত্রী। প্রতিবেদনটি পড়ে তিনি কাগজের অফিসে এসে উপস্থিত হলেন, এক সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান-প্রয়াসের ইতিহাসের একজন মানুষ হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠলেন আনিসুল হকের কাছে। তিনি লিখলেন সেই দুঃখিনী স্ত্রীর গল্প, তাঁর নাম দিলেন আয়েশা। এ নামটি তিনি বঙ্কিমচন্দ্র থেকে নিলেন, কিন্তু সাংবাদিকের নিষ্ঠা দিয়ে গবেষণা শুরু করে চরিত্রটিকে দিলেন পূর্ণতা। এটি করতে গিয়ে আনিস গেলেন আমাদের মঙ্গলকাব্যের ঐতিহ্যে। আয়েশার সঙ্গে তিনি মিল পেলেন বেহুলার। আয়েশামঙ্গল জীবন থেকে গল্পে উঠে এল জীবনকে আরও তীব্রভাবে ধারণ করে, আয়েশার বোধ-অনুভূতিগুলো, তাঁর দীর্ঘশ্বাসে মোড়া প্রতীক্ষার প্রহরগুলো অনুরণন তুলল প্রতিটি পাতায়।

জীবনে আমরা আয়েশাদের ভুলে যাই। কিন্তু আয়েশামঙ্গল-এর আয়েশাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।

আনিসের একটি গুণ আমার খুব পছন্দের, তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত রসবোধ। কিন্তু তার প্রকাশ তো আয়েশামঙ্গল-এ আশা করা যায় না। এর বদলে আনিস যা করেছেন, তা এক তীক্ষ্ণ আয়রনির প্রকাশ। এই আয়রনি আমাদের বাধ্য করে ইতিহাসের পাঠকে প্রশ্ন করতে, তদন্ত করতে।

আয়েশামঙ্গল উপন্যাসটি সম্প্রতি ইংরেজি অনুবাদে দ্য ব্যালাড অব আয়েশা নামে বাজারে এসেছে। এটি আমাদের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। এর আগে একই লেখকের মা উপন্যাসটি ফ্রিডমস মাদার নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয়ে ভারতে ও অন্যত্র বিপুল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। দ্য ব্যালাড অব আয়েশাও নিশ্চয়ই পাবে। কারণ, এই অনুবাদকর্মটি একই সঙ্গে মূলানুগ এবং সাবলীল হওয়ায় ইংরেজিভাষী পাঠকের কাছে উপন্যাসটি মনোগ্রাহী হবে বলে আমার বিশ্বাস। অনুবাদটি করেছেন ইনাম আহমেদ, যিনি নিজে সৃষ্টিশীল লেখক হওয়ায় এবং ইংরেজিতে লেখালেখি করায় দুটো সুবিধা হয়েছে: আয়েশামঙ্গল-এর ইতিহাস-সত্য এবং কল্পনা-সত্য—দুটোই সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এবং উপন্যাসের বয়ানের ভাষাটি রূপান্তরিত হলেও ভাষাগত কোনো অস্পষ্টতা বা অসম্পূর্ণতা তৈরি হয়নি। বাংলা থেকে ইংরেজিতে যেকোনো সৃষ্টিশীল লেখা অনুবাদ করতে হলে জোর দিতে হবে এর সাংস্কৃতিক অনুবাদের দিকে। একটি ভাষা থেকে অন্য একটি ভাষায় অনুবাদ করা হচ্ছে একটি সংস্কৃতিকে অন্য একটি সংস্কৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া। দুই সংস্কৃতির কথোপকথন যত সহজ হবে, অনুবাদটি তত সফল হবে। ইনাম আহমেদ সফল একটি অনুবাদ করেছেন, এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায়।

আয়েশামঙ্গল-এর ‘মঙ্গল’ অংশটি অনুবাদে কেন ব্যালাড হলো, সে প্রশ্ন আসতে পারে। ইংরেজিতে ব্যালাডের যে বৈশিষ্ট্য, মঙ্গলকাব্যেও তা প্রতিফলিত। স্বামীর সন্ধান পাওয়ার জন্য আয়েশার যে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, আনিসের বর্ণনায় তা তার সবল অসহায়তা, কষ্ট, ক্ষোভ ও অনিশ্চয়তার মুহূর্তগুলো ধারণ করে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ব্যালাডের বর্ণনা অংশটি বর্ণিত জীবন বা ঘটনাকে যে রকম জীবন্ত করে তোলে, ঠিক সে রকমভাবেই।

পাঠকের জন্য ইংরেজি অনুবাদটিতে একটি বাড়তি পাওনা আছে। সেটি হলো এখানে লেখক আনিসুল হকের সঙ্গে অনুবাদক ইনাম আহমেদের একটি কথোপকথন ছেপে দেওয়া হয়েছে। ইংরেজিভাষী পাঠক এটি পড়ে যেমন আয়েশার গল্পটি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পাবেন, তেমনি এর সঙ্গে বেহুলা ও মঙ্গলকাব্যের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টির একটি ব্যাখ্যাও পাবেন। আনিসুল হক সম্পর্কে কিছু কৌতূহলও সাক্ষাৎকারটি মেটাবে। বইটি বাজারে এনেছে হারপার পেরেনিয়াল।