সম্পাদকমণ্ডলীর কথা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে আমরা শহীদ শিক্ষকদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি। কাজটি যে এত জটিল হবে, শুরুতে তা বুঝতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্র শহীদদের পুরো বিবরণ নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে নথিপত্র পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। শহীদদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেও যোগাযোগ অনেক ক্ষেত্রেই বিচ্ছিন্ন। প্রকাশিত তথ্যের মধ্যেও কিছু অমিল চোখে পড়েছে। শহীদদের পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখার কাজ আরও অনেক সময় নিয়ে করা উচিত বলে আমরা মনে করি, যাতে শহীদদের জীবনীতে কোনো ভুল না থাকে।

আমরা এই পরিচিতি লেখার ব্যাপারে মূলত প্রকাশিত তথ্যের ওপর নির্ভর করেছি। যেসব তথ্য আমরা ব্যবহার করেছি তা হচ্ছে:

ক. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত শহীদদের ব্যক্তিগত নথিপত্র
খ. বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ ১৯৮৪
গ. বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ ১৯৮৫
ঘ. Journal of the Asiatic Society of Bangladesh, Vol. XVI, No 3 1971
ঙ. বাসন্তিকা, হীরকজয়ন্তী সংখ্যা, জগন্নাথ হল, ১৯২১-৮১
চ. মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, আনোয়ার পাশা। আকরম হোসেন সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ১৯৭২
ছ. শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারক গ্রন্থ, সরদার ফজলুল করিম ও রংগলাল সেন সম্পাদিত, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৬
জ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ (দলিলপত্র), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
আমরা খুব চেষ্টা করেছি যেন তথ্যে কোনো ভুল না থাকে; তবু কিছু ভুলভ্রান্তি থেকে যেতে পারে। তেমন কিছু যদি কারও চোখে পড়ে কিংবা নতুন কোনো তথ্য যদি কেউ দিতে পারেন, তাহলে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হব।

শহীদ কর্মচারী ও ছাত্রদের যে তালিকা সংযুক্ত হয়েছে, তা অসম্পূর্ণ। এই তালিকা ২৫ মার্চের কালরাতের নিধনযজ্ঞে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন, তাঁদের তালিকা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ নয় মাস যেসব ছাত্রছাত্রী শহীদ বা নিখোঁজ হয়েছেন, তাঁদের নাম এই তালিকায় নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রোকেয়া হলে বর্বর পাকবাহিনী প্রবেশ করেছিল। এই হলের অনেক কর্মচারী তাদের হাতে শহীদ হয়েছেন। সেই সময় হলে কোনো ছাত্রী ছিল কি না, থেকে থাকলে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সেই তথ্য এখনো অনাবিষ্কৃত। ইতিহাসের স্বার্থেই এই রহস্য উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন।

শহীদ শিক্ষকদের পরিচিতি প্রকাশের ক্ষেত্রে আমরা যে সহযোগিতা বাংলা একাডেমির কাছ থেকে পেয়েছি, শুধু ধন্যবাদে সেই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। বাংলা একাডেমির উপপরিচালক জনাব ওবায়দুল ইসলাম যে আন্তরিকতা ও ভালোবাসা সংকলনটির জন্য দেখিয়েছেন, তার তুলনা নেই। তথ্য ও উপাদান সংগ্রহে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক জনাব রশীদ হায়দার এবং প্রেসের প্রোডাকশন অফিসার জনাব আফজাল হোসেনের সহযোগিতা আমরা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি দেরিতে হলেও একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছে। সমিতির কর্মকর্তাদের, বিশেষ করে, সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এম. আমিনুল ইসলাম, সহসভাপতি অধ্যাপক মো. মসিহুজ্জামান এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ড. আবদুল মান্নানকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

হুমায়ূন আহমেদ

নির্বাহী সম্পাদক

সংগ্রহ ও ভূমিকা

সৌমিত্র শেখর

হুমায়ূন আহমেদ শহীদের সন্তান, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর আবেগ গিরিশৃঙ্গের তুষারপ্রবাহের মতো, মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অসাধারণ কিছু সাহিত্য ও চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেছেন তিনি—এসব চূড়ান্ত সত্য। এর সঙ্গে এখন যোগ করতে হয় এই তথ্য: মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের তালিকা তৈরিতেও তিনি কাজ আরম্ভ করেছিলেন। যদিও কাজটি সামবায়িক, তবু এর প্রায় কেন্দ্রে ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। সারা দেশের শহীদদের তালিকা নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের তালিকা করে প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সীমাহীন হলেও এই প্রতিষ্ঠানের শহীদের সংখ্যা কত, তা ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ছিল সম্পূর্ণ ধারণার বিষয়। তৎকালীন শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে শহীদের তালিকাকরণ ও তা প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে সূত্রে গঠিত কমিটির নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন রসায়ন বিভাগের সেই সময়ের শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ। ওই কমিটি শহীদ শিক্ষকদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ নামের তালিকার সঙ্গে শহীদ কর্মচারী ও ছাত্রদের তালিকাও তৈরি করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের নাম ও পরিচিতি সংগ্রহ ও প্রকাশের এটিই প্রথম উদ্যোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ স্মরণে (১৯৮৮) নামের একটি ২০ পাতার পুস্তিকায় এই উদ্যোগের বাস্তবায়ন ঘটে। আর পুস্তিকাটি সম্পাদনা করেন হুমায়ূন আহমেদ। এই পুস্তিকায় ‘সম্পাদকমণ্ডলীর কথা’ শিরোনামে তিনি যে ভাষ্যটি রচনা করেন, তাতে শহীদদের নাম অনুসন্ধানে গৃহীত পদ্ধতির উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি শহীদদের নামে তালিকাকরণের আগ্রহটিও সমানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে, মুক্তিযুদ্ধকালে রোকেয়া হলে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রবেশের যে কথা হুমায়ূন আহমেদ উল্লেখ করেছেন, তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস রচনার স্বার্থে হুমায়ূন আহমেদ রচিত অনুপ্রেরণা প্রদায়ী সম্পাদকীয় লেখাটি, যা তাঁর কোনো গ্রন্থও অন্তর্ভুক্ত হয়নি—আবার পাঠ করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, ‘সম্পাদকমণ্ডলীর কথা’ শিরোনামে হুমায়ূন আহমেদের অগ্রন্থিত এই লেখা বর্তমানে প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম আলো বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে।