বাংলাদেশি শিল্পীর জন্য দুর্লভ সম্মাননা

‘অর্ডার অব দি রাইজিং সান’সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত  হিরোইয়াসু ইজুমি, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ও অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন। ছবি: সংগৃহীত
‘অর্ডার অব দি রাইজিং সান’সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইয়াসু ইজুমি, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, ও অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন। ছবি: সংগৃহীত

জাপানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়েছেন বাংলাদেশি শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন। জাপান সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা হচ্ছে ‘অর্ডার অব দি রাইজিং সান’। ১০টি ধাপের এই সম্মাননা প্রতিবছর দেওয়া হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। মূলত জাপানি নাগরিকদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মানিত করা এর উদ্দেশ্য হলেও বিদেশের কিছু গুণীজনকেও প্রতিবছর পদকপ্রাপ্তদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়। নিজেদের কাজের মাধ্যমে নিজের দেশে জাপানের পরিচয় আরও ভালোভাবে তুলে ধরার জন্য বিদেশিদের দেওয়া হয় এই সম্মাননা। জাপান সরকার এ বছর যাঁদের এই সম্মানের জন্য বেছে নিয়েছে, সেই বিদেশিদের দলে আছেন বাংলাদেশের শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন। তাঁর অন্তর্ভুক্তি এ কারণে তাৎপর্যপূর্ণ যে, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগতে তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তিত্ব, যিনি জাপানের এই সম্মানিত পুরস্কারে ভূষিত হলেন। কয়েক দিন আগে ঢাকার জাপানি দূতাবাসে আয়োজিত বিশেষ এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিরোইয়াসু ইজুমি সম্মাননা পদক ও সনদ তুলে দিয়েছেন শিল্পীর হাতে।

কাজী গিয়াস উদ্দীন দীর্ঘকাল ধরে জাপানপ্রবাসী হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত তিনি কোনো অবস্থাতেই নন। ঢাকার অদূরে নিজের তৈরি করে নেওয়া স্টুডিও-বাসভবনে বছরের অর্ধেক সময় তিনি কাটান। শিল্পীর ভাষায়, এটা হচ্ছে তাঁর সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশের সময়। মূলত বড় আকারের ছবিগুলোর ওপর এখানে বসে কাজ করেন তিনি, যদিও এই সব ছবির মধ্যে জাপানের প্রভাব লক্ষ করা যায় বেশ ভালোভাবেই। সেদিক থেকে গিয়াস উদ্দীন হলেন জাপান-বাংলাদেশ দুই দেশের সংস্কৃতির বলয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অবদান রাখা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ফলে জাপানে এই শিল্পীর সম্মানিত হওয়া একদিকে যেমন বাংলাদেশের চারুকলার জন্য জন্য বড় এক প্রাপ্তি, অন্যদিকে একই সঙ্গে তা জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রীর বন্ধনে যুক্ত হওয়া নতুন এক মাইলফলকও।

বিমূর্ত ধারার শিল্পী কাজী গিয়াস উদ্দীন। বিমূর্ত শিল্পীদের কাজের ব্যাপ্তির গভীরতার আঁচ পেতে হলে তাঁদের সম্পর্কে জানা থাকা অনেক বেশি সহায়ক হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ফ্রান্সিসকো গয়া কোন অবস্থার মুখে পড়ে কিছুটা বিমূর্ত ধারার ব্ল্যাক আর্টের দিকে সরে গিয়েছিলেন, তার উৎসের সন্ধান পেতে হলে যেমন শিল্পীর জীবনের উত্থান-পতনের খোঁজ জানা প্রয়োজন, একইভাবে বিপ্লব-পরবর্তী রাশিয়ায় মালেভিচ-রদেচেঙ্কোদের সম্পূর্ণ বিমূর্ত ছবির পেছনে যে সেই সময়ের সামাজিক জীবনে বয়ে যাওয়া উথাল-পাতাল অবস্থার প্রতিফলন রয়েছে, তা জানা না থাকলে তাঁদের ছবিকে মনে হতে পারে এ যেন ভাঁওতাবাজি। শিল্পী তো সমাজ বিচ্যুত প্রাণী নন। আমাদের চারপাশে যা ঘটছে, একজন শিল্পীর ওপর তার প্রভাব পড়ে অনেক বেশিমাত্রায়। সেই প্রভাব শিল্পীর কাজের ওপর ফেলে ছায়া। কাজী গিয়াস উদ্দীনের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জাপানে চারুকলার ওপর উচ্চশিক্ষা গ্রহণ তাঁকে নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছে, তাঁর কাজই হচ্ছে এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তবে দেশজ চিত্রকলার প্রভাব থেকেও মুক্তি চাননি তিনি।

বাংলাদেশের বরেণ্য শিল্পীদের মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়াকে গুরু মানেন গিয়াস উদ্দীন। দুজনের মধ্যে নানা দিক থেকে বেশ কিছু মিলও পরিলক্ষিত হয়। তাঁরা দুজনই ছবি আঁকার উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন জাপানে। এই শিক্ষা তাঁদের সৃজনশীলতার ধারাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে নিয়ে গেছে নতুন এক পথের দিকে। মোহাম্মদ কিবরিয়া সেটা জাপানি ছাপচিত্রকে বাংলাদেশের আদলে রূপান্তরিত করে নেওয়ার চেষ্টা করলেও, গিয়াস উদ্দীনের প্রেরণার উৎসে আছে জাপানের মৃৎশিল্প। মৃৎশিল্পের চমকজাগানিয়া শৈল্পিক দিকগুলো অবশ্য শৈশব থেকেই আকৃষ্ট করে আসছে গিয়াস উদ্দীনকে। বেশ কয়েক বছর আগে নিজের সম্পর্কে এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ছেলেবেলায় কীভাবে বিস্ময়ভরা চোখ নিয়ে দেখতেন, গ্রামবাংলার কুমারদের কাদামাটির তৈরি নানা রকম বস্তুর আগুনে পোড়ানো বাহারি সৌন্দর্য।

১৯৭৫ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য জাপান যাওয়ার পর সে দেশের মৃৎশিল্পীদের কাজ তাঁর মধ্যে নিয়ে এসেছিল নতুন এক উদ্দীপনা। জাপানের মৃৎপাত্রে রঙের পরিমিত ব্যবহার এবং মৃৎশিল্পীদের কাজে রং আর আলো-ছায়ার অদ্ভুত প্রতিফলন অবাক করে দিয়েছিল গিয়াস উদ্দীনকে। নিজের ছবিতে তা তুলে ধরার প্রচেষ্টা তখন থেকেই করে এসেছেন তিনি।

শিল্পীর ভাষায়, জাপান নামের দেশটি হচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় স্বদেশ। চার দশকের বেশি সময় জাপানে বসবাসকালে কেমন করে পাওয়া যায় শিল্পের উৎসের খোঁজ, তার দীক্ষা পেয়েছেন তিনি। তবে একে ক্যানভাসে তুলে আনার প্রয়োগগত দিকটিতে তিনি আবার ধরেছেন বাংলাদেশের প্রকৃতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া সৌন্দর্য। ফলে কাজী গিয়াস উদ্দীন হলেন ভিন্ন দুই সত্তা ধরে রাখা এমন এক শিল্পী, জাপান আর বাংলাদেশকে যিনি নিজের সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে খুবই সুনিপুণভাবে একক একটি বিন্দুতে নিয়ে এসেছেন।

বাংলাদেশের যেসব বিশিষ্ট নাগরিক এর আগে জাপান সরকারের ‘অর্ডার অব দি রাইজিং সান পদক’-এ ভূষিত হয়েছেন, তাঁরা কেউই শিল্প-সংস্কৃতির জগতের মানুষ নন। তাঁদের কেউ সরকারের উচ্চপর্যায়ের আমলা, কেউ ব্যবসায়ী, কেউবা রাজনীতিবিদ। তাই গিয়াস উদ্দীনকে সম্মানিত করার এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জাপান সরকারও মনে হয় দৃষ্টি প্রসারিত করে নিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির দিকে আলোকপাত করার সুযোগ পেল। আশা করা যায়, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির জগতের আরও কিছু অগ্রণী ব্যক্তিত্বের জন্য সম্মানিত হওয়ার দুয়ার খুলবে।