রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা

গোধূলি-লগ্ন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

ওই সন্ধ্যা আসে, যেন কি শঙ্কা সন্দেহে,
ধূসর উত্তরীখানি আবরিয়া দেহে।

* * * * * * *
এই মত একদিন আলোয় আঁধারে,
এসেছিলে তুমি মোর স্বপনের পারে।
তার আগে মোরে তুমি চিনিতে না কভু,
আমার পূজার মালা নিয়েছিলে তবু।
তারপরে—আজ পথে চলেছিনু একা,
গোধূলিতে তোমা সাথে পুন হ’ল দেখা।
তোমার দখিন হাতে ওই দীপখানি,
নীরবে আমার প্রাণে কি কহিল বাণী।
তারপর হ’তে খুঁজি বন-বীথিকায়,
তোমার আসনখানি পাতিব কোথায়।

২০ মার্চ্চ, ১৯৩১ শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জোড়াসাঁকো

সংগ্রহ ও ভূমিকা: ভূঁইয়া ইকবাল

‘গোধূলি-লগ্ন’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো কাব্যগ্রন্থ বা বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলীতে (৩৩ খণ্ড) নেই। কবিতা সমগ্রেও (অনাথনাথ দাস সম্পাদিত, পাঁচ খণ্ড, ২০১০) কবিতাটি গরহাজির।
এটি ১৯৩১-এর ২০ মার্চ জোড়াসাঁকোতে লেখা হয়েছিল। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, কলকাতায়, নিউ এম্পায়ার রঙ্গমঞ্চে নবীন গীতিনাট্য অভিনয়ের সময়ে কবি জোড়াসাঁকোতে ছিলেন (১৭-২২ মার্চ ১৯৩১)।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতা ‘রচনা’র একটি ইতিহাস আছে। কবির বাল্যসখী ইরাবতীর (১২৬৮-১৩২৫) পুত্র [কবির বড় বোন সৌদামিনী দেবীর (১৮৪৭-১৯২০) দৌহিত্র] অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘অনামি’ শিরোনামে একটি চতুর্দশপদীর কবি কর্তৃক সংশোধিত ও পরিমার্জিত রূপ এটি।
জলধর সেন (১৮৬১-১৯৩৯) সম্পাদিত মাসিক ভারতবর্ষ (১৩২০-৪৫) পত্রিকায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশ পায় (পৌষ ১৩৩৮, বর্ষ ১৯ খণ্ড ২ সংখ্যা ১ পৃ. ১৩৮)। প্রকাশকালে পত্রিকা সম্পাদক উল্লেখ করেন:
বিশ্বকবি শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ ভগিনী শ্রীযুক্তা সৌদামিনী দেবীর দৌহিত্র—শ্রীমান অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাঁহার ‘অনামি’ শীর্ষক সনেটটী তাঁর দাদামশাই রবীন্দ্রনাথকে সংশোধনের জন্য দেখান। সংশোধন-ফলে ভাবটা যদিও এক রহিল—ভাষায় সম্পূর্ণ পরিবর্ত্তন ঘটিল। রবীন্দ্রনাথ কবিতাটীর একটী নূতন নাম দিয়া দেন।
ওপরে উদ্ধৃত রবীন্দ্রনাথের ‘নবসৃষ্ট রচনা’ ‘গোধূলি-লগ্ন’-এর সঙ্গে অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মূল কবিতা ‘অনামি’ও গ্রথিত হলো। অরুণরঞ্জনের সেই ‘অনামি’ কবিতাটি এবার দেখে নেওয়া যাক:

অনামি
অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত

ওই দেখো সন্ধ্যা আসে গগনের কোনে,
ধূসর তিমির ছায়া মিলাইয়া দেহে।
প্রভাতের দীপ্ত রবি গেছে অবসান,
কী পুলকে কেঁপে উঠে বল্লরী-বিতান।
এইরূপ একদিন জেগেছিলে তুমি
আমার মানস-পটে, হাতে লয়ে তুলি।
তোমার অজানা ছিল হৃদয় আমার,
তবু কিন্তু লয়েছিলে আরতি পূজার।
তারপর একদিন সাথে তব দেখা,
দেখাইলে সেই দিন অসীমের সীমা।
দিলে মোরে সেই দিন তোমার বারতা,
গহন কানন-পথে জ্বালি দীপ-শিখা।
তোমারে বরিব কোথা ভাবিয়া আকুল
হৃদেতে মানসে—কিবা পরান ব্যাকুল।

উল্লেখ্য, এই লেখার সঙ্গে সংযুক্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা এবং ভারতবর্ষ থেকে উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে তৎকালীন বানানরীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এটিও বলতে হবে যে অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের ‘অনামি’ কবিতাটি পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের সৌজন্যে।