শৈশবে লেখাপড়ায় খুব খারাপ ছিলাম না
আবার ভালো ছাত্রের তকমা পাওয়ার জন্য কখনো বইয়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকিনি
মাতৃভাষা বাংলা, ইংরেজি কিংবা অন্য বিষয়ে মোটামুটি উতরে গেলেও
অঙ্কে আটকে যেতাম। ক্লাসে বারবার ভুল করতাম বলে
গণিতের শিক্ষক মৃদু ভর্ৎসনা করে বলতেন, ‘গবেট, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’
মনে আছে, আমাদের গণিত স্যার ছিলেন খুব চটপটে
দ্রুত বুঝিয়ে দিতেন সব সরল ও জটিল অঙ্ক
যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের নিয়মকানুনগুলো মুখস্থ বলতে পারতেন
ব্ল্যাকবোর্ডে একের পর এক সংখ্যা বসিয়ে তিনি
অতি জটিল অঙ্কও মুহূর্তে মেলাতে পারতেন
অথচ আমি কিছুই বুঝতাম না। স্যারের ভয়ে
আমি একেবারে পেছনের বেঞ্চে গিয়ে বসতাম
অথচ তাঁর ত্রিমাত্রিক চোখ আমার দিকে দৃষ্টির বর্শা নিক্ষেপ করে
জানতে চাইত: বল তো এক সের দুধে এক পোয়া পানি মেশালে
এক মণ দুধে পানির পরিমাণ কত হবে?
পানি, দুধ, পোয়া—কিছুই আমার মাথায় ঢুকত না।
গণিতের শিক্ষক হতাশ হয়ে বলতেন, ‘গবেট কোথাকার।’
প্রবেশিকা পরীক্ষায় কী করে যেন টেনেটুনে অঙ্কে পাস করলাম।
এরপর থেকে আমি গণিত থেকে শত হাত দূরে থাকি।
মনে মনে ভাবি, ‘যাক বাঁচা গেল, আমাকে আর অঙ্ক শিখতে হবে না।’
কিন্তু জীবনের অলিম্পিয়াডে এসে দেখি প্রতিটি পরতে অঙ্ক ছড়িয়ে আছে
জটিল-কুটিল আর কিম্ভূত কিমাকার সব অঙ্ক।
যাঁরা গণিতে পাকা, তাঁরা তরতর করে সফলতার শীর্ষে উঠে যান
কারও সাফল্য হিমালয়ের চূড়া ছাড়িয়ে মহাকাশ স্পর্শ করে
আবার কাউকে কাউকে সফলতার জিয়ন কাঠি ছুঁতে গিয়ে
ধপাস করে খাদের নিচে পড়ে যেতেও দেখেছি। কিন্তু আমি
ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চার ছাত্র, এখনো সবার পেছনে আছি
জীবনের সরল-গরল কোনো অঙ্কই যে আমি মেলাতে পারি না।
মেলাতে মেলাতে কোথায় যেন আটকে যায়
না মেলা অঙ্কের সমাধান খুঁজতে খুঁজতে এখনো লজ্জায় মুখ ঢাকি।
ক্লাসে যাঁরা অঙ্কে ভালো ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ
ডাক্তার-প্রকৌশলী কিংবা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়েছেন।
কেউ ঠিকাদারি ব্যবসায় আখের গুছিয়ে নিয়েছেন
তার চেয়েও ধীমান যাঁরা, ফটকা বাজারে বুদ্ধি খাটিয়ে
মোটা অঙ্কের দাও মেরেছেন। কেউবা লন্ডন, দুবাই, টরন্টোতে
সেকেন্ড হোম বানিয়েছেন। সমাজে তাঁদের কত নাম-যশ,
কত গৌরবের আসন—শুধু অঙ্ক জানার জন্য।
কখনো গণিতের শিক্ষকের সঙ্গে দেখা হলে বলতাম, ‘স্যার,
আপনার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে,
ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চের সেই ছাত্রটি এখনো ব্যাকবেঞ্চে পড়ে আছে।’