রশীদ আমিনের রং-রাগ

‘মেঘমল্লার ১’,শিল্পী: রশীদ আমিন
‘মেঘমল্লার ১’,শিল্পী: রশীদ আমিন

এখন শ্রাবণ মাস। শিল্পী রশীদ আমিন এই শ্রাবণের সাক্ষীস্বরূপ গানের গলা না ভেঁজে রঙের সুর তুলেছেন নানা মাত্রার কাগজের ওপর—জলরঙে ও ছাপচিত্র মাধ্যমে। তাঁর চিত্ররাগের নামও হয়েছে ‘মেঘমল্লার’। রশীদ আমিনের এই ভীমসেন জোসি বাজছে ৩ আগস্ট থেকে, চলবে ১৬ আগস্ট, প্রতিদিন ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিল্পাঙ্গন গ্যালারিতে। কিন্তু এই রাগ কানে না শুনে চোখ দিয়ে শুনতে হবে। শ্রাবণ শব্দটির মধ্যেই রয়েছে শ্রবণের প্রসঙ্গ। এখন শ্রুতি ও নজরের সম্মিলনে যে লাবণ্যসুন্দর বাংলার বর্ষা তিনি এঁকেছেন, একটু খেয়াল করলেই চোখে পড়বে আমিনের জলরঙে আঁকা বর্ষার মেঘ ঠিক কবি কালিদাসের মতো ব্যস্ত ডাকপিয়ন নয়। বরং শ্রাবণমেঘ জলভারানত গম্ভীর গর্ভিণীর মতো। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় প্রায় সন্নিকটে, চোখেমুখে তারই এক রাহস্যিকতা খেলে বেড়াচ্ছে আর মোটা তুলিতে ধোঁয়া ছড়িয়ে যাওয়া রং বা পীতাভ পানির সুর চোখ ছাপিয়ে শ্রুতি পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে।

সাধারণত আমরা যখন গ্যালারিতে ছবি দেখি, আমাদের চোখের ডগায় মগজ বেঁধে নিতে হয়, কিছুটা বুদ্ধি খরচের ক্লেশ হয়, যদিও তার স্বাদ আরেক মাত্রার। আমিনের ‘মেঘমল্লার’ শিরোনামের এই সিরিজের ছবিগুলোতে বুদ্ধি-ব্যায়াম না করে শুধু নজরভ্রমণ করেই বর্ষাযাত্রার আনন্দ উপভোগ করা যায়। তবে মেঘমল্লার রাগের মিড়, ঘাটগুলো মনের অজানায় চালান করে দেওয়ার জন্য একটু দাঁড়িয়ে থাকার দাবি রাখে। ছবিগুলো যেমন শান্ত, তেমনি দর্শকও যদি শান্ত হয়ে ছবিগুলো দেখেন, তা আরও বেশি উপভোগ্য হবে।

আমি যতবার ছবিগুলো দেখেছি, ততবারই তীব্র এক নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছি। জলরঙের ছবিগুলোর উৎসভূমি আমিনের জীবনেরই অংশ—টাঙ্গাইলে তাঁর বাড়িটি। এ বাড়ির সঙ্গে সংগত কারণে আমার পরিচয় রয়েছে। ঘন বাঁশবন, ভেতর দিয়ে নানা মাত্রার জ্যামিতি করা বোঝা যায়, বোঝা যায় না এমতো ফাঁকফোকর, অথচ পটভূমির অধিকাংশ জায়গাজুড়েই ঘনবদ্ধ পীতাভ সবুজ, কখনো আবার হঠাৎ হলুদ লাগা নরম আলো, নীল ঢেউয়ের সহজ গতির উচ্ছ্বাস।

আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, আর্দ্রতাঘন জমিনের সারল্যকে সহজ রেখা দিয়ে বিভেদরঞ্জিত করেছেন আমিন। ছবির জমিনের ওপর মূল রেখাগুলোর বেশির ভাগ রেখাই এঁকেছেন উল্লম্ব। এতে বর্ষার প্রকৃতি আরও গাঢ় হয়ে ধরা পড়েছে। যখন আমরা দেখি এই উল্লম্বতা ভেঙে ছবিকে ছন্দ দিতে এবং দৃশ্যব্যঞ্জনাময় করার তাগিদে মোটা তুলিতে দৈগন্তিক রেখা টেনে ছবির জ্যামিতিকে সুবিন্যস্ত করেছেন, তখন আনন্দ আরও বিশেষ হয়ে ওঠে। বৃষ্টিসিক্ত বাংলার এই প্রকৃতিরূপ দেখার সৌভাগ্য হলো অনেক দিন পর।

প্রিন্ট মাধ্যমটি মনে হয় এই আর্দ্রতাস্বভাবকে খুব গ্রাহ্য করে না, কিন্তু শিল্পীর দক্ষতায় সবুজের সঙ্গে মিল খাওয়া অন্যান্য রং বা রঙের স্তরপরম্পরার এই ছবিগুলোও বর্ষাকে ধারণ করে রোমান্টিকতায়, যদিও তা অত পেলব নয়, বরং দার্ঢ্য, যেন বেশ কয়েক দিন বিরামহীন বৃষ্টির পর সামান্য সময়ের বিরতি পেয়েছে। জলরঙের ছবিগুলো ঠিক যে কথা বলতে চায়, প্রিন্টগুলো ঠিক তা-ই বলে না। ফলে, আমরা বর্ষার বৈচিত্র্য বা দ্বন্দ্বও খানিকটা ছুঁয়ে ফেলতে পারি। এই দ্বন্দ্ব ঠিক বিরোধ নয়, বরং সহোদরার মতো, দুই বোনের চেহারা নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে আলাদা। এখন এই বিষয়টা নির্ভর করবে গ্যালারিতে একাধিক মাধ্যমের ছবিগুলো কীভাবে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত হবে বা হয়েছে, তার ওপর।

আমিন তাঁর ছবিতে বহুবিচিত্র রং ব্যবহার করেননি। গাঢ় বঙ্গীয় সবুজ, কদম-আভাষিত হলুদ, নরম রোদের কমলা, স্মৃতিকাতর নীল—মোটামুটি এই তাঁর রংবাহার। সেসব রং প্রযুক্ত হয়েছে খুব যে নিপুণ ড্রয়িংয়ে, তা নয়, আমার বিবেচনায় বর্ষার শুদ্ধ মূর্ততাকে তিনি হাজির করেননি ইচ্ছা করেই। বরং রোমান্টিক থরথরতা, বিনয়ী অপটুতা বরং ছবিগুলোকে এবং বর্ষাকে অধিকতর প্রকাশসম্ভব করে তুলেছেন এক বিরল বিমূর্ত শর্তে। দরকার শুধু দর্শকের চিদ্‌মুহূর্তের জন্য ছবির সামনে দাঁড়িয়ে সামান্য সময় দেওয়া। অনেকটা আলোকচিত্রী কার্তিয়ার ব্রেসঁ যেমন বলেন ‘নির্ধারক মুহূর্ত’, তার জন্য অপেক্ষা করা। কেননা, নিবিড় সময়-বিরতিই রতিসংক্রমণের মুহূর্তটি এনে দেয়, যেহেতু আমিনের ছবি শুধু দেখার নয়, শোনারও। যেন ভীমসেন জোসির কম্বুকণ্ঠে মেঘমল্লারের সুর: গরজে ঘটা ঘন কারে রি...।