জন্ম ও প্রেম

অলংকরণ: আরাফাত করিম
অলংকরণ: আরাফাত করিম

জুঁই মাঝেমধ্যে ওর গোপন ঘরে ঢুকে পড়ে, যেখানে ওর ছায়া ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু দুটো ঘটনা আছে অদৃশ্য হয়ে। ঘটনার তো কোনো আকার থাকে না। তবে তার সরব উপস্থিতি অদৃশ্য হাঙরের আকারে ভয়াবহ মূর্তির মতো।

একটি ঘটনা ওর জন্মের। অন্যটি প্রেমের। এই দুই ঘটনার সঙ্গে ওর রাতদিনের খেলা আছে। ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে খেলায় ও মাঝেমধ্যে অন্ধকারের সমুদ্রে তলিয়ে যায়। উঠে আসার স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়। আবার দুটি স্মৃতি ওকে স্বপ্নের ঘরে ফিরিয়ে আনে। ছোটবেলা থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত মা-বাবা ওকে বলত, তুই আমাদের জুঁই। বেঁচে থাকার সৌরভ। প্রেমে পড়ার পর অমিত মাঝেমধ্যে বলে, তুমি আমার সব। তোমার দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবী দেখছি। তবে এটুকু খুব অল্প সময়ের বলা। মা-বাবার মতো সব সময় বলে না। মা-বাবা বেঁচে নেই। দুজনে এক সড়ক দুর্ঘটনায় একই সঙ্গে মারা গেছে।

ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া জুঁইকে হাসপাতাল থেকে দত্তক নিয়েছিল ওর পালক মা-বাবা। তারা খুব যত্নে-আদরে ওকে বড় করেছে। নিজের দিকে তাকিয়ে ও মেনে নিতে পারে না যে জন্মের পর ওকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল ওর মা। পালক মা-বাবা লেখাপড়া শিখিয়ে ওকে এক চটপটে তুখোড় মেয়ে বানিয়েছেন। ইউসুফের সঙ্গে প্রেমে পড়ার পর জুঁই জেনেছে, ও অটিস্টিক ছেলে। মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। এমন হ্যান্ডসাম ছেলেটিকে এভাবে বোঝার পর ওর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যায়। এসব নিয়েই এখন ওর দিন কাটছে। প্রেমে পড়ার পর প্রেমের স্মৃতি খুব স্বস্তির নয়। কত অসংখ্য দিন কেটেছে প্রেমের বোঝাপড়ায় নিজেকে কাহিল করে। প্রেমিকের নাম রেখেছে অমিত। প্রাণভরে এই নাম ডেকে জুঁই আনন্দ পায়। ওর আসল নাম ইউসুফ ডেকে কোনো আনন্দ নেই। ওই নাম ওর পরিচয়। অমিত প্রায়ই কেমন আনমনা হয়ে যায়। বিষণ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওর ভাবলেশহীন চেহারায় ওকে খুবই অচেনা মনে হয়। কখনো হাত ধরতে গেলে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নেয়। যেন ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ওকে।

অমিতের মা ছেলেকে ডাকে কচ্ছপ। জুঁইয়ের সামনেও ডেকেছে। বলেছে, আমার কচ্ছপ ছেলেটাকে তোমার ভালো লাগে দেখে আমি খুব খুশি মা গো। দোয়া করি, তোমরা সুখী হও।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে জুঁইয়ের কখনো মনে হয়নি যে ওর মা ওকে কচ্ছপ ডাকছে কেন? ওর জানার ইচ্ছাও হয়নি।

নিজে নিজে ভেবেছে, কচ্ছপ কেন? কারণ কী? দীর্ঘ আয়ুর জন্য? নাকি কচ্ছপের মতো গুটিয়ে থাকা স্বভাবের জন্য? এক মুহূর্ত ভেবে আবার কাজে হাত লাগায় জুঁই। অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের নিয়ে কাজ করে, এমন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে ও। সময় কেমন করে কেটে যায়, তা টের পায় না। বিকেলে বা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে ক্লান্তি ওকে পেয়ে বসে না, বরং একধরনের ভালো লাগায় আবিষ্ট থাকে।

আজ আর রান্নার দরকার নেই। ফ্রিজে গরুর মাংসের ভুনা আছে। ডাল আছে। চুলোয় ভাত বসিয়ে দিয়ে ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস জুস খায় জুঁই। বড় করে শ্বাস টেনে বলে, এখন গান...। পছন্দসই রবীন্দ্রসংগীতের সিডি প্লেয়ারে ঢোকায়। বেজে ওঠে গান, ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়...’।

মাঝেমধ্যে ভিন্ন মাত্রায় পাল্টে যায় অমিত। তখন ওর ক্রোধের মাত্রা নিরূপণ করা যায় না। দৃষ্টির ভাষা আগুনের আভায় চকচক করে। চেনা ছেলেটির অচেনা হয়ে যাওয়ার মাত্রা ওকে আহত করে। সম্পর্কের বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রবল হয়ে উঠলে জুঁই নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে। নিজেকে বোঝায়, অমিত মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। এর বেশি কিছু ভাববে না ও। ঠিক সেই মুহূর্তে ভেসে ওঠে অমিতের মুখ। জেগে উঠেছে ওর কানছোঁয়া হাসি। উজ্জ্বল সাদা দাঁত বেরিয়ে আছে। শুধু চোখে দীপ্তি নেই, সেখানে ভাটির টান, তারপরও বড় সরল দেখাচ্ছিল ওকে। ও একদিন বলেছিল, স্বপ্নে তুমি আর আমি চাঁদে বেড়াতে যাব। চাঁদের বুড়িকে পাটিসাপটা পিঠে খাইয়ে পূর্ণিমার সুতা দিয়ে তৈরি শাড়িটা তোমার জন্য কিনব, জুঁই।

ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে গিয়েছিল ও। যাওয়ার আগে ভেংচি কেটেছিল। জুঁই বুঝেছিল, ওই ভেংচি ফান না। ও ক্রুদ্ধ। ও দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে, কপাল কুঁচকে রেখেছিল। ওর আবেগ প্রকাশ স্পষ্ট নয়। ওর কথা বুকের ভেতর থেকে বের হয় ঠিকই, কিন্তু আবেগহীন। কোথায় যেন প্রবল শূন্যতা ওকে জড়িয়ে থাকে। ও সেই বলয় থেকে বের হতে পারে না। কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে নিজেকে হাতড়ায় জুঁই। উত্তর নেই। ও কী করে বুঝবে আরেকজনের মনস্তত্ত্ব।

রান্নাঘর গুছিয়ে রেখে জানালায় এসে দাঁড়ায় জুঁই। বারোতলার ওপরের ফ্ল্যাট থেকে শহরের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ও জানালার শিকে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। গানের বাণী ও সুর স্পর্শ করে থাকে হৃদয়। ভরে আছে ভেতরটা। কখনো মনে হয়, সুরের স্রোত বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছড়াচ্ছে শরীরেও। এই স্রোত ধারণ করলে বদলে যায় স্মৃতির রং।

: তোমার স্মৃতিতে এখন কী রং লেগে আছে, জুঁই?

: আমার স্মৃতিতে এখন কালো রং লেগে আছে।

: কালো? কালো আমার প্রিয় রং।

: প্রিয় রং কালো?

: হ্যাঁ, তাই তো। কালো তোমার ভালো লাগে না?

: একদম না। কালো কোনো রংই না। তুমি তো একটা কালো ছেলে।

: হা হা, কালো ছেলে, কালো ছেলে; আমি একটা কালো ছেলে। তুমি কি লাল মেয়ে, জুঁই?

: আমি লাল-নীল-হলুদ-সবুজ-বেগুনি-গোলাপি—সব।

: আমিও তা-ই। আমিও লাল-নীল-সবুজ-হলুদ—সব।

: না, তুমি এত রঙের ছেলে মোটেই না।

: রং কি তোমার একার?

: একার হবে কেন? আমি কি বলেছি একার?

: তাহলে বলছ কেন আমি অনেক রঙের ছেলে না।

: কারণ, আমি তোমাকে এত রঙের মধ্যে দেখতে পাই না।

: তুমি না পেলে কী হবে, আমি আমাকে দেখতে পাই।

: ছাই পাও।

: তুমি আমাকে রাগিয়ে দিচ্ছ। তুমি একটা অসভ্য মেয়ে। তোমাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেব।

: তোমার চোখের ভাষায় আমি একজন খুনিকে দেখতে পাচ্ছি, অমিত।

: পাবেই তো। আমি তোমাকে খুন করব।

: এটা কি প্রেমের ভাষা?

: হ্যাঁ, প্রেমের ভাষা। খুন করার আগে তোমাকে বলব ভালোবাসি। বুঝবে ভালোবাসা কী। বুঝবে ভালোবাসার ভাষা কেমন।

: কষ্ট, কষ্ট, তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছ।

: হা হা হা, কষ্ট আমার হাসি। হা হা হা, কষ্ট আমার বাঁশি। হা হা হা, কষ্ট আমার পিসি। হা হা হা, কষ্ট আমারÑআমার...

বেরিয়ে গিয়েছিল অমিত। স্থাণুর মতো বসে ছিল জুঁই। এখন এই জানালার শিকে মাথা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আর সেই সময়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সময় একইভাবে স্থবির। রাতের এই সময়ে একলা ঘরে দাঁড়িয়ে স্মৃতির সঞ্চয় থেকে বেরিয়ে আসা সংলাপ সংগীতের মতো বাজে। ভরিয়ে রাখে কিছুটা সময়। তারপর ফিতা ছিঁড়ে যায়। রং ফুরিয়ে যায়। যে স্মৃতিতে রংধনুর বর্ণালি আভা বিচ্ছুরিত হয়, সেটা ধূসর হয়ে যেতে সময় লাগে না। একসময় গান বন্ধ হয়ে যায়।

মাথা সোজা করে জুঁই। আলোজ্বলা শহরের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে যায় ওর সামনে। মনে হয় পুরো শহর গাঢ় অন্ধকারে আড়াল হয়ে গেছে। এখন এই শহরে সাদা-কালোর কোনো তফাত নেই। তাহলে এই মুহূর্তে অমিতই কি সত্য আমার সামনে? ও কালো রং নিয়ে বর্ণিল? হায়, এভাবে জীবনকে ফুরিয়ে ফেলেছি আমি! আমার স্বপ্ন দেখার পথ খোলা নেই। চারদিকের দুয়ার বন্ধ। উহ্! মা গো।

জুঁই জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ঘরের বাতি বন্ধ করে। বাইরে থেকে হালকা আলো এসে আলোছায়া তৈরি করেছে ঘরের ভেতর। ও টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিওরো ট্রাইবল বইটি পাতা খোলা অবস্থায় টেবিলের ওপর আছে। কদিন ধরে বইটি ও পড়ছে। বইটি ওকে দিয়েছে অফিসের একজন। পুরো বইটি ফটোকপি করে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। বইয়ের নামের নিচে লেখা আছে ‘দ্য লিগ্যাসি অব অটিজম অ্যান্ড হাউ টু থিংক স্মার্টার অ্যাবাউট পিপল হু থিংক ডিফারেন্টলি’। চেয়ার টেনে বসে ও বইয়ের খুলে রাখা অংশের খানিকটুকু পড়ে।

: এই বইটা তুমি অনেক দিন ধরে পড়ছ, জুঁই।

: পড়ছি তো। তোমাকেও পড়তে দিতে চেয়েছিলাম, তুমি নাওনি।

: আমার পড়তে ভালো লাগেনি, সে জন্য নিইনি। এ তো সোজা কথা। বুঝতে পারো না।

: পারি তো। পারব না কেন? আমি তো তোমার মতো অটিস্টিক ইয়াং না।

: বাজে কথা বললে ঘুষি মেরে তোমার মাথা উড়িয়ে দেব।

: অমন করে তাকাবে না। ঘুষি তুমি মারতেই পারো, সেই গায়ের জোর তোমার আছে। শুধু শুধু আমাকে শাসিয়ো না।

: এক শ বার শাসাব।

: শাসাও। আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না।

তুমি যেদিন বললে, অমিত, তুমি মাইল্ড অটিজমে আক্রান্ত। সেদিন আমার পৃথিবী থেকে রোদ ফুরিয়ে যায়। মা-বাবার সঙ্গে আসামে বেড়াতে গিয়ে আমি কার্তিক বিহুর কথা জেনেছিলাম। এখন বুঝতে পারি আমার প্রেমের মধ্যে কার্তিক মাসে যে অভাব থাকে, সেই অভাব আছে।

কার্তিক মাসে ঘরে খাবার থাকে না। মানুষ অভাবে দিন কাটায়। তারপরও অভাবের মাঝে উৎসব পালন করে মানুষ। যাদের ঘরে খাবার থাকে, তারা জোট বেঁধে উৎসবের আয়োজন করে। দুঃখী মানুষকে আনন্দ দিতে চায়।

দুঃখী মানুষেরা খেতে গিয়ে আকাশপ্রদীপ জ্বালায়। সেই আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকে ধানের খেত। তুমি আমার প্রেমের আকাশপ্রদীপ হতে পারোনি। তুমি আমার প্রেমে অভাব। আমার জীবন থেকে কার্তিকের অভাব কাটবে না। গুডবাই।

: তুমি অনেকবার আমাকে গুডবাই বলেছ অমিত, পরক্ষণেই আবার তুমি নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেছ। আমি তো জানি নিজের জগতে তুমি বাদশাহ। তোমার চারপাশে তুমি কাউকে চাও না। অমিত, প্রেমিক আমার, তোমাকে ভালোবেসে স্বপ্নের পৃথিবী গড়তে চেয়েছিলাম। দেখলাম তোমার জগতে তুমি এত ডুবে থাকতে পারো যে তোমার চারপাশে কেউ না থাকলে তোমার কিছু এসে যায় না।

: ঘুষি মেরে তোর মাথা আমি ভেঙে দেব পেতনি। হা হা হা...

জুঁইয়ের মনে হয়, ও অমিতের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ঘর ভরে গেছে হাসির শব্দে। ও ঘড়ি দেখে। বারোটা বেজে গেছে। ঘুমোতে যাওয়া দরকার। পরমুহূর্তে মন খারাপ হয় ওর। অমিতের হাসি তো হাসি নয়। এ হাসির মধ্যে উন্মত্ততা আছে। এই উন্মত্ততার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণের সংগতি নেই। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে উদ্ভট ভঙ্গিতে হিংস্র হয়ে ওঠে ও। ওর আবেগ প্রবলভাবে আহত হয়। ওর কানে হাসির শব্দ বাজতেই থাকে। গালে হাত দিয়ে বসে থাকে ও। সামনে খোলা বই। বুঝতে পারে না আজ রাতে ও ঘুমোতে পারবে কি না।

স্মৃতি আবার ধূসর হয়ে ওঠে।

: তুমি আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো, মা।

: কীভাবে আমি ঝুঁকি নেব?

: লক্ষ্মী মা আমার। সোনা মা আমার। আমি তোমাকে দোয়া করি। তুমি আমাকে কথা দাও, মা।

: কথা?

: হ্যাঁ, কথা। তুমি বলো যে কোনো দিন ওকে ছেড়ে যাবে না।

: আমাকে যেতে হবে অনেক পথ। জানি না কত দিন ও আমার হাত ধরে হাঁটবে। জানি না কখন ও সোজা পথ ছেড়ে অন্য পথে চলে যাবে। জানি না ওর বুকের ভেতরে ভালোবাসার ফুল কত দিন সতেজ থাকবে। শুকিয়ে যাওয়া ফুলের পাপড়ি নিয়ে ও কি আমাকে বলবে, বিদায় জুঁই? নাকি আমি ওকে বলব, এখন আমার যাওয়ার সময় হয়েছে। আমাদের প্রেমের শস্যক্ষেত্রে আকাশ নেমে এসেছে। এখানে আর কোনো দিন আকাশপ্রদীপ জ্বলবে না। কার্তিকের বিহু উদ্‌যাপিত হবে না। আমি আপনার ছেলের জন্য কিছুই করতে পারব না, মা। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

জুঁই ঘরের চারদিকে তাকায়। ওর চোখ বুঝি কাউকে খুঁজছে। ঘরে কেউ নেই। হাসির শব্দও থেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগে যে ধূসর স্মৃতি অমিতের মায়ের কণ্ঠস্বরে ভেসে উঠেছিল, সেটা এখন নেই। বদলে এক গোলাপি আভা ওর স্মৃতিকে রঙিন করেছে। ও ভাবছে, হাসির শব্দ কি রঙিন?

জুঁই কান খাড়া করে। হাসির শব্দ আর শোনা যায় না। ও স্মৃতির সবকিছু ঝেড়ে ফেলে টেবিলের বইয়ের ওপর মনোযোগ দেয়। পড়তে পড়তে এসে থমকে যায় এক জায়গায়—শিশু সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার লিও কান প্রথম খেয়াল করেছিলেন তাঁর কাছে আসা শিশু রোগীদের মধ্যে এগারো জন অন্যদের চেয়ে আলাদা। তারা চারপাশের অন্যদের উপেক্ষা করে নিজেদের ভুবনে থাকে। ছোট একটা কিছু নিয়ে ওরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মগ্ন থাকতে পারে। কিংবা ওদের বলা কোনো একটি কথা অনবরত বলে যেতে থাকে। এই অন্য রকম শিশুদের অবস্থাকে লিও কান ‘অটিজম’ নামে উল্লেখ করেন। শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ অটোস থেকে। এর অর্থ, এরা বিচ্ছিন্ন নির্জনতায় সুখী থাকে। এরা নিওরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডারের শিকার।

ও বইটি বন্ধ করে রাখে। কয়েক দিন ধরে বইটি টেবিল থেকে সরায় না। ঘুরেফিরে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ওল্টায়। বিভিন্ন জায়গা পড়ে বোঝার চেষ্টা করে। যেন এটি ওর কাছে এক পবিত্র গ্রন্থ। বইটি পড়ার পর মাথার ভেতরে নিতে থাকে নানা কিছু। রাতের এই মুহূর্তে বারবারই ভেসে ওঠে একটি বাক্য—দে সিমড হ্যাপিয়েস্ট ইন আইসোলেশন। চমক ভাঙে জুঁইয়ের। শুনতে পায় অমিতের কণ্ঠস্বর, প্রেম কী, জুঁই?

: কাউকে পছন্দ হওয়া।

: শুধু এইটুকু?

: হ্যাঁ, তাই তো। আমি তো এটুকুই বুঝি।

: তাহলে তো নিজের সঙ্গে প্রেম হয়। আমি তো নিজেকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি।

: এটা প্রেম না।

: তাহলে কী?

: ভালোবাসা।

: আমি অন্যকে ভালোবাসব কেন?

: তাহলে আমি তোমার কে, অমিত?

: কেউ না। একদম কেউ না।

: তুমি জানো না আমি তোমার কে?

: না, জানি না।

: তাহলে প্রেমের শুরুর দিনে কেন বলেছিলে, জুঁই, চলো আমরা হাত ধরে বসি। কেন বলেছিলে?

: জানি না।

: প্রেম কী, অমিত?

: জানি না।

: আমি তোমার কে?

: কেউ না। কেউ না...কেউ না...

: এ জন্য তোমার প্রেমের বিহুতে কার্তিকের অভাব আছে।

মধ্যরাত ভেদ করে ভাসতে থাকে কণ্ঠস্বর। কেউ না কেউ না শব্দ জুঁইয়ের ঘরজুড়ে স্মৃতির অন্ধকার হয়ে তড়পায়। এই মুহূর্তে ওর স্মৃতির রং নেই। ও বাতি বন্ধ করে বিছানায় যায়। ঘুম আসে না। মাথা টনটন করছে। বালিশে মাথা রাখার পরই শারীরিক অস্বস্তি প্রবল হয়ে ওঠে। এই আকস্মিক পরিবর্তন ওকে বিমূঢ় করে। ও বিছানায় উঠে বসে। হাঁটুর ওপর মাথা রাখে।

জানে একদিন ও নিজেই অমিতকে ভালো লাগার কথা বলেছিল। ওর উজ্জ্বল হাসি দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। ওর নাম দিয়েছিল। নিভৃত ওকে এই নামে ডাকবে—এমন উৎফুল্ল চিন্তায় আপ্লুত হয়েছিল। এমন দ্রুত ইচ্ছার প্রকাশ জুঁইয়ের ভেতরটা ভরিয়ে দিয়েছিল। আবেগে উচ্ছ্বসিত স্বরে বলেছিল, তোমাকে আমি অমিত ডাকব।

: অমিত? অমিত ডাকবে কেন?

: আমি তোমাকে ভালোবাসি।

: ভালোবাসো?

: খুব ভালোবাসি। ভীষণ!

: আমি কি তোমাকে ভালোবাসি?

: তুমিই বলো। আমি তোমার কথা শুনতে চাই।

: বলতে পারব না। ভালোবাসা-টাসা আমি জানি না। জানি না।

ক্রুদ্ধ স্বরে কথা বলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল ও। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল। এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা ঠিক হয়নি। কিন্তু কাউকে তো সামনে এগোতে হয়। মুখ খুলতে হয়। ভালো লাগা তো বুকের ভেতর আটকে রাখার বিষয় নয়। যাকে ভালোবাসার কথা বলা, সে তো সাড়া না-ই দিতে পারে। তা বলে এমন আচরণ? এভাবে কথা বলতে হবে? ও আহত হয়েছিল। ক্ষুব্ধ ছিল কয়েক দিন। মন খারাপও ছিল। একদিন অমিত নিজেই কাছে এসে বসেছিল। বলেছিল, চলো বেড়াতে যাই।

আশ্চর্য প্রসন্ন দৃষ্টি ছিল সেদিন। ওর সামনে বিমূর্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা অমিত বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম হিসেবে প্রতিভাত হয়েছিল। ও ভুলে গিয়েছিল ওর অশোভন আচরণের কথা। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, কোথায় যাব?

: রমনা পার্কে। দুজনে হাত ধরে হাঁটব। ফুল কুড়াব। পাতা ছিঁড়ব। ঘাসের ওপর বসব। লেকের পানিতে শুকনো পাতা ভাসাব। একটি শালিক পাখি যদি দেখতে পাই...

: থামলে যে? খুব সুন্দর করে তো বলছিলে?

: আর তো কিছু মনে আসছে না।

: আমি বলব?

: না, তুমি বলবে না।

: কেন বলতে না করছ?

: আমার খুশি। আমার যা করতে ইচ্ছা হয়, আমি তা-ই করতে চাই।

: বাব্বা, এ রকম!

: যাও, বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে পেঁয়াজ খাও।

: পেঁয়াজ? কী বলছ?

: হা হা হা। আমি গেলাম।

: আমরা এখনই তো এলাম।

: বলেছি বাড়ি যেতে। বাড়ি যাও।

হনহন করে চলে যেতে যেতে ও একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল জুঁই। তারপরও ওকে ভালোবাসার রেশ ফুরোয়নি।

আজ রাতের অবসরে অমিতই ওর জীবনের প্রেম, যে হ্যাপিয়েস্ট ইন আইসোলেশন।

প্রেমের সুরভিতে আচ্ছন্ন জুঁই ভাবে, অমিতকেই প্রেমের ঠিকানায় আটকে রাখবে। কারণ, ও কোনো দিন ওর জন্মের সূত্র জানতে চায়নি। ডাস্টবিনে কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ের এর চেয়ে বেশি কী চাওয়ার আছে? ও নিজেও প্রেমের সুখে নিজেকে বলবে, হ্যাপিয়েস্ট ইন আইসোলেশন। পরিচয়হীন জন্ম ও অটিজম-আক্রান্ত প্রেম নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিতে চাই—রাতের অন্ধকার ফুল ফুটিয়ে রাখুক আমার জীবনে।