ভালোবাসা, ভালোবাসা, কেবলই ভালোবাসা

>

‘লাভ, লাভ, লাভ অ্যালোন’ নামে ভি এস নাইপলের গল্পটি তাঁর কিশোরজীবনের স্মৃতির ওপর ভিত্তি করে লেখা। ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ‘মিগেল স্ট্রিট’ নামে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থে স্থান পেয়েছে গল্পটি। ১৯৬১ সালে এই বই জিতে নেয় ‘সমারসেট মম পুরস্কার’। ‘মিগেল স্ট্রিট’-এর গল্পগুলোর অনেক কিছুই ঘুরেফিরে এসেছে একই কিশোরের জবানিতে। বাংলায় অনুবাদের সময় গল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভালোবাসা, ভালোবাসা, কেবলই ভালোবাসা’। অনুবাদ: উম্মে ফারহানা

একটার দিকে একটা শবযান আর একটা মোটরগাড়ি এসে থামল মিস হিলটনের বাড়ির সামনে। একজন লোক আর একজন ভদ্রমহিলা নামলেন গাড়ি থেকে। দুজনই মধ্যবয়সী, আর কালো পোশাক পরে ছিলেন। লোকটা যখন কফিনের গাড়ির লোকের সঙ্গে নিচু স্বরে কথা বলছিলেন, মহিলা কাঁদছিলেন।
মিস হিলটনের শেষকৃত্য হলো মিগেল স্ট্রিটের সবচেয়ে দ্রুত আর নিরিবিলি শেষকৃত্য। গতবারেরটা ছিল আরেক বুড়ি বিধবা সমাজকর্মী মিস রিকডের, পাড়ার ভালো দিকটাতে থাকতেন। সেবারে উনআশিখানা গাড়ি আর একটা বাইসাইকেল ছিল, গুনেছিলাম আমি।
ওঁরা দুজন বিকেলের দিকে ফিরে গেলেন আর উঠানে বড় একটা আগুন জ্বেলে তোশক, বালিশ, বিছানার চাদর, কম্বল সব পুড়িয়ে ফেলা হলো। দেখলাম ধূসর কাঠের বাড়িটার সব কটি জানালা খোলা, এমন আগে আর কখনো দেখিনি। সপ্তাহের শেষে আমগাছে একটা সাইনবোর্ড লাগানো হলো, ‘বিক্রি হবে’।
পাড়ার কেউ মিস হিলটনকে চিনত না। তিনি যখন বেঁচেছিলেন, তাঁর বাড়ির সামনের ফটকে সব সময় তালা ঝুলত। কেউ কোনো দিন তাঁকে বেরোতে বা কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেখেনি। তাই চাইলেও তাঁর জন্য শোক করা যাচ্ছিল না।
তাঁর বাড়িটার কথা ভাবলেই দুটো রং দেখতে পেতাম শুধু—ধূসর আর সবুজ। আমগাছের সবুজ আর বাড়িটার ধূসর, পাঁচিলের ওপর লোহার যে শিকগুলোর জন্য আম পাড়া যেত না, সেগুলোও ছিল ধূসর।
ক্রিকেট খেলার সময় মিস হিলটনের উঠানে বল পড়লে কখনো ফেরত পাওয়া যেত না। মিস হিলটন যখন মারা গেলেন, সেটা আমের মৌসুম নয়। কিন্তু প্রায় ১০-১২টা ক্রিকেট বল ফিরে পেলাম আমরা।
নতুন লোকজন আসার আগেই আমরা তাঁদের অপছন্দ করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিলাম। বোধ হয় আমরা ছিলাম বেশ চিন্তিত। একজন লোক হামেশাই আমাদের নামে পুলিশের কাছে নালিশ করত, গলিতে আমরা ক্রিকেট খেলি, এই বলে। ক্রিকেট না খেললেও বলত আমরা নাকি বেজায় গোলমাল করি।
একদিন স্কুল থেকে ফিরতেই হ্যাট বলল, ‘এক লোক আর এক মহিলা। মহিলাটা দেখতে সুন্দর, লোকটা জঘন্য। পর্তুগিজ, দেখে মনে হলো।’
আমি বেশি কিছু দেখলাম না। সামনের ফটকটা খোলা ছিল, জানালাগুলো আবার বন্ধ।
একটা কুকুরের রাগী ডাক শুনলাম।
একটা জিনিস দ্রুতই বোঝা গেল। এরা যে-ই হোক, পুলিশকে ফোন করে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে বলে নালিশ করবে না আমাদের নামে।
সে রাতে অনেক আওয়াজ শোনা গেল ওই বাড়ি থেকে। রেডিও বাজছিল তারস্বরে, মাঝরাতে ত্রিনিদাদ রেডিও বন্ধ হওয়া অবধি। কুকুরটা চেঁচাচ্ছিল, লোকটাও। মহিলার গলা শুনলাম না।
পরদিন সকালে সব শান্ত।
আমি স্কুলে যাওয়ার আগে মহিলাকে দেখলাম। বোয়ি বলল, ‘এই মহিলাকে আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। মুকুরাপোয় দুধ দিতে যেতাম, সেখানে বোধ হয়।’
ভদ্রমহিলাকে মিলিয়ে স্ট্রিটের অন্যদের সঙ্গে মানাত না। তিনি ছিলেন ভীষণ সুসজ্জিত, একটু বেশিই সুন্দরী আর বেজায় পরিপাটি। তাঁকে অন্য মহিলাদের সঙ্গে মেরির দোকানে চাল আর ময়দার জন্য ঠেলাঠেলি করতে দেখলে হাসিই পেত।
মনে হলো, বোয়ি ঠিকই বলছে। তাঁকে মানাত মুকুরাপোর সুন্দর বাড়িগুলোর একটাতে—শর্টস পরে বাগানে বেড়াতে গেলে, উর্দিপরা চাকরসমেত।
কিছুদিনের মধ্যেই লোকটার দেখা পেলাম। পাতলা, লম্বা, মুখটা বিচ্ছিরি আর গোলাপি ব্রণে ভরা।
বোয়ি বলল, ‘ঈশ্বর, এ তো এক নম্বরের মাতাল।’
আমার একটু সময় লাগল বুঝতে যে লম্বুটা আসলেই ২৪ ঘণ্টা টাল থাকে। ওর গা থেকে বাজে রামের গন্ধ বেরোত আর আমি ওকে ভয়ও পেতাম। দেখলেই চলে যেতাম রাস্তার ওপারে। তার বউ, কিংবা যে-ই হোক, যদিওবা পাড়ার অন্য সবার তুলনায় সে ছিল সুসজ্জিত মহিলা, কিন্তু ওর জামাকাপড় ছিল আমাদের যে কারও চেয়ে খারাপ। এমনকি জর্জের চেয়েও নোংরা।
লোকটা কোনো কাজ করে বলে মনে হতো না।
আমি হ্যাটকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এত সুন্দরী মহিলা কী করে এমন একটা লোকের সঙ্গে মেশে?’
হ্যাট বলল, ‘তুই বুঝবি না বাপ, আমি বললেও তুই বিশ্বাস করবি না।’
তখন কুকুরটাকে দেখলাম।
দেখতে একটা রামছাগলের মতো বড়, আর ষাঁড়ের মতো বজ্জাত। মুখটা সরু, মালিকটার মতোই। দুটোকে একসঙ্গেই দেখা যেত।
হ্যাট বলল, ‘একটা জিনিস খুব আশ্চর্য, বুঝলি। এরা কোনো আসবাব আনেনি। মনে হচ্ছে ওদের ওই একটা রেডিওই আছে।’
এডোস বলল, ‘ওদের কাছে আমি অনেক জিনিস বেচতে পারি।’
আমি ওদের কথা প্রায়ই ভাবতাম, আর মহিলাটার জন্য দুশ্চিন্তা করতাম। তাঁকে বেশ মনে ধরেছিল—তিনি যেভাবে বোঝাতে চাইতেন সবকিছু বেশ ঠিকঠাক আছে। তিনি পাড়ার আর দশজন মহিলার মতোই, বিশেষভাবে লক্ষ করার মতো কিছু নেই তাঁর মধ্যে—এ সবকিছুর জন্যই ভালো লাগত তাঁকে।
তখনই শুরু হতো মার।
মহিলা চেঁচিয়ে দৌড়ে বেরোতেন। আমরা শুনতাম ভয়ানক কুকুরটার ঘেউ ঘেউ আর লোকটার চিৎকার শাপশাপান্ত আর গালিগালাজ।
হ্যাট বড়দের বলল, ‘সবাই মিলে গিয়ে দেখি না কেন কী হলো?’
এডয়ার্ড আর এডোস হাসল।
আমি বললাম, ‘কী হয়েছে হ্যাট?’
হ্যাট হেসে বলল, ‘তুই বড্ড ছোট, ফুলপ্যান্ট পরা পর্যন্ত সবুর কর।’
একদিন ক্রন্দনরত মহিলাকে দেখলাম হঠাৎ করে। মনে হলো লাজলজ্জার মাথা খেয়েছেন। কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় দৌড়াচ্ছেন, আর যাকেই দেখছেন, বলছেন, ‘বাঁচাও, বাঁচাও, ও আমাকে ধরতে পারলে মেরে ফেলবে।’

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

একদিন তিনি এলেন আমাদের বাড়িতে। আচমকা ঢুকে পড়ার জন্য মাফটাফ চাইলেন না। তখন তিনি এতই আতঙ্কিত যে কাঁদতেও পারছিলেন না।
আমার মাকে আগে কোনো দিন কাউকে সাহায্য করার জন্য এত উতলা দেখিনি। মহিলাকে চা আর বিস্কুট দিলেন। সে সময় তিনি বললেন, ‘আমি বুঝতেই পারছি না টোনির ইদানীং কী হয়েছে। কিন্তু শুধু রাতেই এমন করে, জানেন। সকালবেলায় খুব ভদ্র। বিকেল হতেই কী যেন হয়, মাথাটা বিগড়ে যায় ওর।’
শুরুতে মা বাড়াবাড়ি রকমের ভদ্র ব্যবহার করছিলেন মহিলার সঙ্গে, খুব শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলছিলেন। কিন্তু তিন-চারবার আসার পর মা নিজের মতো হয়ে গেলেন—লারা বা মিসেস বাকুর সঙ্গে যেমন, তেমনই।
একদিন বললেন, ‘বলুন তো মিসেস হেরেইরা, এই অপদার্থটাকে ছেড়ে যাচ্ছেন না কেন?’
মিসেস হেরেইরা বললেন, ‘বললে খুব বোকা বোকা শোনাবে। কিন্তু আমি টোনিকে পছন্দ করি, ভালোবাসি।’
‘এ কেমন হাস্যকর ভালোবাসা?’
মিসেস হেরেইরা টোনির ব্যাপারে এমনভাবে কথা বলতে থাকলেন যেন সে একটা বাচ্চা ছেলে, ‘ওর অনেক গুণ আছে জানেন। আর ওর হৃদয়টাও খুব চমৎকার, সত্যি।’
‘হৃদয়ের বিষয়ে আমি জানি না, আমি শুধু জানি ওর পাছায় খুব কশে মারা দরকার, যাতে ওর হুঁশ ফেরে। এমন একটা লোক আপনাকে এভাবে অপদস্থ করে। আপনি সহ্য করেন কী করে, বলুন দেখি?’
‘যুদ্ধের পর এমন হয়েছে, বুঝলেন। সে নাবিক ছিল, দুবার টর্পেডো হামলায় ডুবতে বসেছিল।’
‘আবার চেষ্টা করা দরকার।’
‘এভাবে বলা উচিত নয় আপনার।’
‘আমার যা মনে হয়েছে তা-ই বললাম। আপনি তো আমার কাছে পরামর্শের জন্যই এসেছেন।’
‘আমি পরামর্শ চাইনি।’
‘আপনি এখানে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন, আমি সাহায্য করার চেষ্টা করছি, এই যা।’
‘আমি আপনার সাহায্য বা উপদেশ কোনোটাই চাই না।’
মা শান্তভাবে বললেন, ‘আচ্ছা, আমারই ভুল হয়েছে সাদা লোকদের ব্যাপারে জড়ানোটা। ক্যালিপ্সোদের ওই গানটা শুনেছেন, “ভালোবাসা, ভালোবাসা, কেবলই ভালোবাসা/ যে কারণে এডওয়ার্ডের রাজাসন ছেড়ে আসা।” একটা কথা বলি, আপনি কিন্তু রাজা এডওয়ার্ড নন। যান, আপনার মহান প্রেমিকের কাছে যান।’
মিসেস হেরেইরা বেরোতে বেরোতে বললেন, ‘আর কখনো এখানে আসব না আমি।’
কিন্তু পরের সন্ধ্যায় আবার তিনি ফিরে এলেন।
টোনিকে আমরা ঘেন্না করতাম।
হ্যাট বলল, ‘ব্যাটাছেলের জন্য মাঝেমধ্যে বউ পেটানো ভালো, কিন্তু এই লোকটা একেবারে ব্যায়ামের মতো করছে বাবা।’
লোকটার মাতলামিও অসহ্য। যেখানে-সেখানে পড়ে থাকত, পাঁড় মাতাল হয়ে।
কয়েকবার আমাদের সঙ্গে ভাব জমাতেও এসেছিল।
বলত, ‘কী খবর খোকারা?’
মনে হতো ওইটুকু আলাপই সে করতে পারে। তখন বড়রা যেন একটু দয়া করেই তার সঙ্গে কথা বলত। আমার মনে হতো, টোনি আসলে কিছুই শুনছে না। হঠাৎ করেই উঠে চলে যেত কিচ্ছু না বলে, কেউ হয়তো তখন কোনো কথা সবে অর্ধেকটা বলেছে।
হ্যাট বলল, ‘এ-ও এক ভালো। আমার মনে হয়, ওর দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে বমিই করে ফেলব। মাঝেমধ্যে সাদা চামড়াও কী ভীষণ নোংরা হয় দেখেছিস!’
সত্যিই, ওর চামড়াটা ছিল বিচ্ছিরি। কেমন যেন হলুদ আর গোলাপি আর সাদা, তার ওপর খয়েরি-কালো ছোপ। বাঁ-চোখের ওপরের ত্বকটা একটা মাংস বেরোনো পচা গোলাপি ধরনের।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওর সরু আর কোঁচকানো হাত দুটো দেখলে ওর জন্য কষ্টই লাগে, বিরক্তি আসে না।
সম্ভবত মিসেস হেরেইরা শুধু ওর হাতগুলোই দেখেন।
তিনি শেষের দিকে মায়ের বেশ বন্ধুই হয়ে গিয়েছিলেন। আমি শুনতে পেতাম তাঁর বিভিন্ন পরিকল্পনা। একদিন বললেন, কিছু আসবাব আনবেন, মনে হয় এনেও ছিলেন।
কিন্তু অধিকাংশ সময়ে কথা বলতেন টোনিকে নিয়ে, এমনভাবে বলতেন, যে কেউ শুনলে ভাববে টোনি আর দশজনের মতোই। বলতেন, ‘টোনি ত্রিনিদাদ ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছে। আমরা বারবাডোজে একটা হোটেল খুলব।’ অথবা, ‘টোনি সুস্থ হলেই আমরা একটা ক্রুজে যাব।’ আবার কখনো, ‘টোনি আসলেই খুব নিয়মের মানুষ, জানেন। আর মনোবলও ভীষণ, সত্যি। আবার ও শক্ত-সমর্থ হয়ে উঠলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তবে টোনি নিজের এসব পরিকল্পনার কথা জানত বলে মনে হতো না। সে আরও বর্বর আর অসহনীয় হয়ে উঠছিল। মনে হতো গোটা মানবজাতি সম্পর্কেই তার একটা দারুণ বিতৃষ্ণা। অপরিচিত কাউকে দেখলেই শাপশাপান্ত করতে শুরু করত সে।
হ্যাট বলল, ‘টোনির ব্যাপারে কিছু করা উচিত।’
যেদিন ওরা টোনিকে পেটাল, সেদিন আমিও ছিলাম সেখানে।
সে এক বীভৎস ব্যাপার। মার ফেরত দেওয়ার কোনো চেষ্টাই সে করেনি। ভয় পায়নি, কাঁদেনি, কাকুতি-মিনতি করেনি। শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাচ্ছিল।
‘ও মোটেই সাহসী নয়’ হ্যাট বলল, ‘শুধু বদ্ধ মাতাল।’
শেষে নিজের ওপরেই রেগে গেল হ্যাট, ‘আমি অযথা সুযোগ নিচ্ছি। ছেড়ে দাও তো। এর কোনো অনুভূতিই নেই।’
আর মিসেস হেরেইরার কথায় মনে হলো, তিনি জানেনই না আসলে সেদিন কী হয়েছিল।
‘যাক বাবা, বাঁচা গেল’, হ্যাট বলল।
এতগুলো দিন ধরে একটা প্রশ্নই আমাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘মিসেস হেরেইরার মতো মহিলা কী করে টোনির সঙ্গে জড়ালেন?’
হ্যাট বলল, সে জানতে চায় মিসেস হেরেইরা আসলে কে, আমরাও তা-ই চাইতাম; এমনকি মা-ও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
বোয়ি একটা বুদ্ধি বের করল। বলল, ‘হ্যাট, তুমি জানো কারও বউ বা জামাই ভেগে গেলে তারা কী রকম বিজ্ঞাপন দেয়?’
হ্যাট বলল, ‘বোয়ি, তুই তো খুব তাড়াতাড়িই বড় হয়ে যাচ্ছিস। তোর মতো পুঁচকে ছেলে এত কিছু জানে কী করে?’
বোয়ি এটাকে প্রশংসা হিসেবেই নিল।
হ্যাট বলল, ‘তুই কীভাবে জানলি মিসেস হেরেইরা ভেগে এসেছে? আর টোনির সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি?’
বোয়ি বলল, ‘আমি বলছি তো, হ্যাট, আমি ওই মহিলাকে দেখেছি মুকুরাপোতে, দুধ দিতে যেতাম যখন।’
হ্যাট বলল, ‘সাদারা এসব করে না, এই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া-টেওয়া।’
এডোস বলল, ‘কী বলছিস এসব হ্যাট, কয়টা সাদা লোককে চিনিস তুই?’
শেষে হ্যাট কথা দিল এরপর থেকে আরও মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়বে। তখনই বড় হাঙ্গামাটা বাধল।
মিসেস হেরেইরা আর্তনাদ করে বেরিয়ে এলেন তাঁর বাড়ি থেকে, ‘ও পাগল হয়ে গেছে, একদম পাগল, আমাকে এবার মেরে ফেলবে নিশ্চিত।’
মাকে বললেন, ‘ও একটা ছুরি নিয়ে আমাকে তাড়া করেছে আর বলছে, “তোমাকে আমি মেরে ফেলব, মেরে ফেলব।” “মেরে ফেলব” কথাটা খুব ঠান্ডাভাবে বলেছে।’
‘আপনি কিছু করেছেন নাকি?’ মা জিজ্ঞেস করলেন।
মাথা নাড়লেন মিসেস হেরেইরা, বললেন, ‘এই প্রথম আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। আর আসলেই মারবে।’ বাচ্চা মেয়ের মতো কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
বলতে থাকলেন, ‘টোনি ভুলে গেছে আমি তার জন্য কী কী করেছি, যখন অসুস্থ ছিল আমি কীভাবে ওর সেবা করেছি। বলুন, এটা কি ঠিক? আমি ওর জন্য সব করেছি। সব। টাকাপয়সা, পরিবার, সব ছেড়েছি ওর জন্য। বলুন, ওর কি আমার সঙ্গে এমন করা উচিত? হা ঈশ্বর, আমি কী করেছি যে আমার কপালে এসব জুটছে?’ বলতে বলতে বিলাপ করতে থাকলেন তিনি। আমরা তাঁকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিলাম। মা বললেন, ‘টোনিকে দেখে মনে হয় ও সহজেই খুন করতে পারে। আপনি আজ রাতটা এখানে থাকতে চান? আমার ছেলের বিছানায় ঘুমাতে পারেন, ও মেঝেতে শোবে।’
মিসেস হেরেইরা কিছুই শুনছিলেন না। মা তাঁকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে একই কথা আবার বললেন। তিনি বললেন, ‘আমি ঠিক আছি। গিয়ে টোনির সঙ্গে কথা বলি। হয়তো আমার কোনো কাজে ও আহত হয়েছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করি কী সেটা।’
মিসেস হেরেইরা ফিরে গেলেন। আমি আর মা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম, একটা চিৎকারের জন্য। কিন্তু কিছুই শুনলাম না।
পরদিন সকালে মিসেস হেরেইরা আবার আগের মতো নিপাট গোছানো।
কিন্তু দিনে দিনে তাঁর সজীবতা আর সৌন্দর্য কমতে থাকল। মুখে বলিরেখা পড়ছিল। চোখগুলো ফোলা আর লাল হয়ে থাকত, চোখের নিচে কালি পড়ে বিশ্রী দেখাত।
হ্যাট একদিন আমাদের একটা ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনের কলাম দেখাল। সাতজন ব্যক্তি তাঁদের স্ত্রী বা স্বামীকে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আমরা হ্যাটের দেখানো অংশটুকু পড়লাম:
‘আমি, হেনরি হিউবার্ট ক্রিস্টিয়ানি, ঘোষণা করছি যে আমার স্ত্রী, অ্যাঞ্জেলা মেরি ক্রিস্টিয়ানি, আমার হেফাজতে নেই, এবং তাঁর কোনো দেনার জন্য আমি দায়গ্রস্ত থাকব না।’
আধঘণ্টার মধ্যে পুরো পাড়ায় খবরটা রটে গেল।
মা বললেন, ‘আপনি বরং পুলিশ ডাকুন।’
মিসেস হেরেইরা বললেন, ‘না, না, পুলিশ না।’
‘মনে হচ্ছে আপনি পুলিশকে টোনির চেয়েও বেশি ভয় পান?’
‘কেলেঙ্কারি হবে...।’
‘ছাতার কেলেঙ্কারি, আপনার জান নিয়ে টানাটানি আর আপনি কেলেঙ্কারির কথা ভাবছেন। মনে হচ্ছে লোকটা আপনাকে যথেষ্ট বেইজ্জত করেনি? আপনি আপনার স্বামীর কাছে ফিরে যাচ্ছেন না কেন?’
মা যেন আশা করছিলেন এ কথায় মহিলা চমকে উঠবেন। কিন্তু তিনি খুব শান্ত থাকলেন। বললেন, ‘আমার তাঁর জন্য কোনো অনুভূতি নেই। আর ওই পরিচ্ছন্ন ডাক্তারের গন্ধটা আমার সহ্য হয় না। দম আটকে আসে।’
টোনি আরও অসভ্য হয়ে উঠছিল। সে বাড়ির সামনের সিঁড়িতে বসে থাকত আধবোতল রাম আর কুকুরকে নিয়ে। মনে হতো পৃথিবীর সঙ্গে তার সব সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। কোনো অনুভূতিই আর তার নেই। এটা শক্ত হলেও কল্পনা করা যায় যে মিসেস হেরেইরা কিংবা মিসেস ক্রিস্টিয়ানি টোনির প্রেমে থাকতে পারেন। তবে এটা কল্পনা করা একেবারেই অসম্ভব যে ও নিজে কারও প্রেমে থাকতে পারে। মনে হতো ও একটা জন্তুর মতো, ওর কুকুরটার মতো।
এক সকালে মিসেস হেরেইরা এলেন, খুব শান্ত স্বরে বললেন, ‘আমি ঠিক করেছি চলে যাব।’
মা বিচলিত হয়ে জানতে চাইলেন, ‘আবার কী হলো?’
‘গত রাতে ও কুকুরটাকে আমার গায়ে তুলে দিয়েছে। ওকে দেখে মনে হলো না ও বুঝতে পারছে যে ও আসলে কী করছে। ও হাসেওনি। আসলে ও পাগল হয়ে যাচ্ছে, এক্ষুনি চলে না গেলে আমাকে মেরে ফেলবে।’
‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘আমার স্বামীর কাছে।’
‘উনি পত্রিকায় ওসব ছাপার পরও?’
‘হেনরি একটা ছেলেমানুষ, ও ভেবেছে আমাকে ভয় দেখাতে পারবে। কিন্তু আজ আমি ফিরে গেলে আমাকে পেয়েই সে খুশি হয়ে যাবে।’
কথাটা বলার সময় মিসেস হেরেইরাকে কঠোর দেখাল। অন্য রকম।
‘এত নিশ্চিত হবেন না। উনি টোনিকে চেনেন?’
মিসেস হেরেইরা হাসলেন খ্যাপাটেভাবে, ‘টোনি হেনরিরই বন্ধু ছিল। হেনরি একদিন ওকে বাসায় নিয়ে এল। টোনি তখন ভীষণ অসুস্থ। হেনরি অমনই। এমন মানুষ আমি কখনো দেখিনি, সারাক্ষণ ভালো কাজ করতে চায়। পরোপকার আর পরিচ্ছন্নতা ওর ধ্যানজ্ঞান।’
মা বললেন, ‘জানেন মিসেস হেরেইরা, আমার মনে হয় আপনার জীবনটা আমার মতো হলে কত ভালো হতো। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে হয়ে যেত, আর এসব হাবিজাবি শুনতে হতো না কারও। এসব প্রেম-ভালোবাসা, যত্তসব ফালতু প্যানপ্যানানি।’
মিসেস হেরেইরা কেঁদে ফেললেন।
‘দেখুন, আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাটা বলিনি। আমি দুঃখিত।’
মিসেস হেরেইরা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘না, না, সে জন্য নয়।’
মাকে হতাশ দেখাল।
মিসেস হেরেইরা কাঁদতেই থাকলেন। শেষে বললেন, ‘আমি দুই সপ্তাহের মতো খাবার রেখে যাচ্ছি টোনির জন্য।’
মা বললেন, ‘টোনি বড় মানুষ। এত চিন্তার কিছু নেই।’
মিসেস হেরেইরা চলে গেছেন। টের পেয়ে টোনি কুকুরের মতো গজরাল, শিশুর মতো হাউমাউ করল। তারপর মাতাল হলো। সব সময়ের মতো মাতাল নয়, সে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছাল যে, মনে হলো রামই ওকে চালাচ্ছে। কুকুরের কথাও সে ভুলে গেল, কুকুরটা বহুদিন না খেয়ে থাকল। হোঁচট খেতে খেতে আর কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াল টোনি, মিসেস হেরেইরার খোঁজে। বাড়ি ফিরে কুকুরের ওপর চড়াও হলো। শোনা গেল কুকুরের গর্জন আর গোঙানি।
শেষে কুকুরটাও তেড়ে এল। কোনোভাবে সে ছুটতে পেরেছিল। টোনির হুঁশ ফিরল তখন। কুকুরটা ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে, পালাল।
একদম ফাঁকা ঘরে জাজিমের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকত ও, চারদিকে কেবল রামের বোতল আর সিগারেটের মাথা।
আরেকটা ‘বিক্রি হবে’ সাইনবোর্ড ঝুলল আমগাছে। গোটা পাঁচেক বাচ্চাওয়ালা এক লোক বাড়িটা কিনে নিল।
মাঝেমধ্যে টোনি আসত ভয় দেখাতে। টাকা চাইত, রাম চাইত, আর রেডিওটাও। বলত, ‘অ্যাঞ্জেলোর রেডিওটা তোমরা নিয়েছ। ভাড়া দাও। মাসে দুই ডলার। এখনই দুই ডলার দাও।’
ছোটখাটো নতুন মালিক উত্তর দিত না ভয়ে।
টোনি আমাদের দিকে চেয়ে হেসে বলত, ‘কী খোকারা, তোমরা তো অ্যাঞ্জেলার রেডিওর কথা জানো, তাই না? এখন লোকটা কী বাজাচ্ছে তাহলে?’
দু-তিন মাস পর মিলিয়ে স্ট্রিটে আসা বন্ধ করে দিল টোনি।
বহু বছর বাদে টোনিকে আমি আবার দেখলাম। আরিমা যাচ্ছিলাম, ল্যাভেন্টিলের কাছে দেখলাম একটা ট্রাক চালাচ্ছে সে। সিগারেট টানছিল। শুধু ওর সরু হাত দুটোর কথাই মনে আছে আমার।
আর এক রোববারে, বহুদিন এড়িয়ে চলার পর, ক্যারেনেগের দিকে যাওয়ার সময় ক্রিস্টিয়ানির বাড়ির পাশ দিয়ে গেলাম।
মিসেস ক্রিস্টিয়ানি কিংবা মিসেস হেরেইরা শর্টস পরে বাগানের ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। খোলা ফটক দিয়ে দেখলাম একটা উর্দিপরা চাকর লাঞ্চের টেবিল সাজাচ্ছে।
গ্যারেজে একটা কালো গাড়ি ছিল, নতুন, বড় একটা গাড়ি।
অনুবাদ: উম্মে ফারহানা