এটা মনিকা

ফোন বাজে। এটা মনিকা। আমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি তোমার বউয়ের সাথে ঝগড়া করো?’

আমি বুঝতে পারি, ঠিক এই মুহূর্তে ওর মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া চলছে।

মনিকা আমার উত্তরের অপেক্ষা করে না; বলে, ‘ঝগড়া না করে তোমরা থাকতে পারো না?’ বলেই লাইন কেটে দেয়।

মনিকা ফোন করলে আমার বুকের ভেতরে কী জানি হয়। গল্প-উপন্যাসের লেখকেরা যেটাকে রোমান্স বলে, আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে—এটা সে ধরনের কিছু নয়। কারণ আমার বয়স ৩৫ আর মনিকার মাত্র ১৬। আজ ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ, আগামী মাসের কোন তারিখে যেন তার এসএসসি পরীক্ষা। তারিখটা সে বলেছিল, কিন্তু আমি ভুলে গেছি। আমার শুধু মনে আছে, মনিকা এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।

সে এক অদ্ভুত মেয়ে। আমি তার বাপ-চাচার বয়েসী, তবু সে আমাকে তুমি বলে, যেন আমি তার সমবয়সী বন্ধু। আমাকে ভাই বা আঙ্কেল বলে না, স্রেফ নাম ধরে ডাকে, আর খুব ডিম্যান্ডিং স্বরে নানা রকমের হুকুম করে। যেমন, ‘কাল সকাল ঠিক সাড়ে সাতটায় তুমি আমারে ফোন দিবা।’

পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় আমার ঘুম ভাঙে না, ভাঙে সাড়ে আটটায়। আমি সকাল নটায় ফোন করলে মনিকা ফোন ধরে না, ধরেন তার মা। তিনি আমার পরিচয় জানতে চান; আমি আমার এক বন্ধুর নাম করে বলি যে আমি মনিকার রফিক আঙ্কেল, মনিকা বাসায় আছে কি না।

মা বলেন, ‘আপনি আবার কোন রফিক আঙ্কেল, কোথা থেকে বলতেছেন, কী ব্যাপার...’ ইত্যাদি।

আমি আর কিছু বলতে পারি না, নিজেকে চোর চোর মনে হয়, চুপ করে থাকি। আমার চুপ করে থাকা মনিকার মাকে রাগায়, তিনি ধমকাতে আরম্ভ করেন, ‘এই ছোকড়া, বলো তুমি কে। লুকাবা না, বলো মনিকার সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে হলো।’

আমি বলি, ‘দেখেন ম্যাডাম, আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক ভদ্রলোক, সমাজের সম্মানিত নাগরিক, আমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলা আপনার উচিত হচ্ছে না।’

মা তখন আরও রেগে বলেন, ‘বুড়া ধাড়ি একটা লোক হয়ে আপনি আমার বাচ্চা মেয়েটার পিছে লেগেছেন কেন?’

আমি বলি, ‘আমি তো লাগি নাই, মনিকাই আমাকে কাল ফোন করে হুকুম দিল কাল সকালে তুমি এই নাম্বারে আমারে ফোন দিবা।’

তখন ভদ্রমহিলার চিৎকার শোনা যায়, ‘মনিকা! এই শয়তানের বাচ্চা..., ’ ইত্যাদি।

দুই.

দুপুরে মনিকা আমাকে ফোন করে বলে তার মা তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে তার নানুর বাড়ি চলে গেছে; বলে গেছে যে সে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না। আমি বলি তার মা বিকালের মধ্যেই ফিরে আসবেন, কোনো সন্দেহ নাই। তখন সে বলে সে নিজেও জানে তার মা ফিরে আসবে কিন্তু তাদের সংসারে শান্তি আর ফিরে আসবে না।

‘শান্তির পায়রা আমাদের বাসা থিকা পলায় গেছে গা! না, না, ওইটারে বিড়ালে খাইছে।’

সে বলে। তার কিশোরী কণ্ঠে প্রাপ্তবয়স্কের শ্লেষপূর্ণ হাসি টের পাওয়া যায়।

আমি জিজ্ঞাসা করি, কী নিয়ে তার মা ও বাবার মধ্যে ঝগড়া হয়েছে। মনিকা বলে যে এক মহিলা তার বাবাকে ফোন করেছিলেন। আমি জানতে চাই ওই মহিলা কি তার বাবাকে প্রায়ই ফোন করেন? মনিকা আমাকে আচমকা ধমক দেয়, ‘তুমি আমার আব্বু-আম্মুর প্রাইভেট ম্যাটারে নাক গলাইতে আসতেছ ক্যান?’

আমি আমার নাক প্রত্যাহার করি।

কিন্তু মনিকা নিজেই আবার বলে যে ওর মা ওর বাবাকে ইতর বলে, লম্পট বলে আর ওর বাবা ওর মাকে বলে, ‘তোমার ভালো না লাগলে তুমি চলে যাও।’

তারপর সে বলে তার ছোট ভাই ক্যাডেট কলেজে পড়ে। সে বড়ো হয়ে আর্মি অফিসার হতে চায়। আর্মি অফিসার হলেই সে পারবে তার বাবাকে টাইট দিতে।

আমি গুরুতর ভঙ্গি করে জিজ্ঞাসা করি তার বাবা কি ঢিলা হয়ে গেছে যে তাকে টাইট দেওয়া দরকার।

মনিকা আমার জিজ্ঞাসার উত্তর না দিয়ে জানতে চায়, আমি কী সিগারেট খাই। কিন্তু আমি উত্তরে কিছু বলার আগেই সে বলে এক কার্টন বেনসন সিগারেট সে আমাকে গিফট করবে, কারণ কয়েক কার্টন সিগারেট কারা জানি তার বাবাকে ঘুষ দিয়েছে। সে মনে করে, ঘুষের সিগারেট তার বাবা একা খাবেন এটা অন্যায়; বরং দিয়ে-থুয়ে খাওয়া ভালো।

আমি হেসে মিথ্যা বলি, ‘আমি তো সিগারেট খাই না।’

মনিকা আমাকে ভর্ৎসনা করে বলে, ‘এহ্! তুমি তাইলে কেমন পুরুষ?’ তারপর সে আমাকে বলে সিগারেটের গন্ধ তার ভালো লাগে। তার বাবা সিগারেট খায়, তার মা বকাঝকা করে, আর সে নাকি তার বাবাকে বলে, ‘আম্মুর কথায় পাত্তা দিবা না আব্বু, তুমি সিগারেট খাবা।’

তিন.

খুব ভোরে মনিকা আমাকে ফোন করে বলে আগের দিন সে দুই লাখ টাকার মালিক হয়েছে। ‘নতুন, চকচকা এক হাজার টাকার দুইটা বান্ডিল, বুঝলা?’ সে বেশ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, ‘পিনগুলান এত শক্ত যে ডেঞ্জারাস! রক্তারক্তি হয়ে যেতে পারে।’

আমি প্রমাদ গুনি, ‘সর্বনাশ! এত টাকা তুমি কোথায় পেলে? কীভাবে পেলে?’

মনিকা হেসে বলে কোথায় পাওয়া গেছে, কীভাবে পাওয়া গেছে—এসব কোনো ব্যাপার নয়। কথা হচ্ছে টাকাগুলো খরচ করতে হবে, কীভাবে তা করা যায় সেই বুদ্ধি আমাকে বের করতে হবে।

‘তুমি এই টাকা নিশ্চয়ই চুরি করেছ।’

‘আরেন্না! আব্বুরে ব্ল্যাকমেইল করছি।’

‘কী?’

‘হইছে কী, শোনো। কারা জানি আব্বুকে এক ব্যাগ টাকা দিয়া গেছে। এক হাজার টাকার দশটা তোড়া। আমি দেখে ফেলছি, আব্বু বলে ওই ঘরে যাও। আমি বলি আমাকে দুইটা তোড়া দিতে হবে।’

‘তুমি মিথ্যা বলছ, মনিকা। সত্যি করে বলো, টাকাটা কীভাবে পেয়েছ।’

‘এ, এ! তুমি কোন জজ-ব্যারিস্টার আসছ যে তোমার কাছে আমারে মিথ্যা কইতে হইব?’

আমি ধন্দে পড়ে গেলাম।

একটু পরে মনিকা বলে, ‘আমি তোমারে একটা তোড়া দিতে পারি। তুমি নিবা?’

‘কেন দিবা?

‘নিবা কি না বলো।’

‘নিব না। আর শোনো, তুমি আর আমাকে কক্ষনো ফোন করবে না। ঠিক আছে?’

‘হি হি! তুমি একটা ভীতুর ডিম!’

‘আমি কিন্তু সিরিয়াস! তোমার সাথে আমার কোনো পরিচয় নাই। কোনোদিন ছিল না।’

‘বুইড়া শালা, তোমারে আমি ভাড়াটে খুনি দিয়া খুন করামু।’

চার.

মনিকা আবার ফোন করে। এবার বলে, আগের রাতে তাদের বাসায় কয়েকটা সন্ত্রাসী এসেছিল। তারা তার বাবার কাছে চাঁদা চায়। তিন লাখ টাকা দিতে হবে, নইলে তারা মনিকাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। তার বাবা সন্ত্রাসীদের বলে তারা ভুল জায়গায় এসেছে, আরও কী কী সব বলে। সেসব কথা শুনে সন্ত্রাসীরা দেখে যে তাদের ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, এখন তারা গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারে। এই সাবোটাজের দায়ে তারা মনিকাদের ড্রয়িংরুমের ভেতরেই নিজেদের মধ্যে মারামারি করে পরস্পরের নাক ফাটায়; তারপর মনিকার বাবার কাছে হাতজোড় করে মাফ চেয়ে চলে যায়।

এইসব বলার পর মনিকা আমাকে বলে, ‘কিন্তু তুমি ডরাইয়ো না। আব্বু তোমারে কিছু কইব না।’

‘মানে?’

‘তুমি জানো, তুমি কত ইনোসেন্ট?’

‘কী বলো এইসব?’

‘ও, শোনো শোনা! আমাদের বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন নেওয়া হইছে। আমি একটা মেইল অ্যাকাউন্ট খুলছি।

মনিকাএইটিনাইনঅ্যাটইয়াহুডটকম। লেখে নাও। লেখে নাও।’

‘লেখার দরকার নাই। আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।’

‘কী? এর মধ্যেই মুখস্থ হয়ে গেল? বলো তো, আমার ই-মেল অ্যাড্রেসটা কী?’

‘মনিকাএইটিনাইনঅ্যাটইয়াহুডটকম।’

‘গুড বয়! আজই আমারে একটা মেল করবা।’

‘আচ্ছা।’

‘মেলে কী লেখবা?’

‘হাই! দিস ইজ এ টেস্ট মেল!’

‘নো। তুমি লেখবা, মনিকা, আই লাভ ইউ!’

‘এই পাজি মেয়ে! জানো আমার ছেলের বয়স কত?’

‘তোমার ছেলেরে দিয়া আমার কী কাজ?’

‘তুমি একদিন আমাদের বাসায় আসো, আমার ছেলের সাথে তোমার পরিচয় করায়ে দিব।’

‘তোমারে যা বলা হইলো তাই করবা। ঠিকাছে?’

মনিকা ধাম করে ফোন রেখে দিল।

পাঁচ.

রাত সাড়ে বারোটায় মনিকার ফোন: ‘মেল তো করো নাই। করলা না ক্যান?’

আমি তাকে বলি তার এখন লেখাপড়ায় মন দেওয়া উচিত, কারণ অল্প কিছুদিন পরেই তার ম্যাট্রিক পরীক্ষা। সে আমাকে বলে ভালোভাবে লেখাপড়া করা ভালো কাজ নয়, কারণ তাদের পাশের বাড়ির এক ছেলে আগের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ভেড়া বনে গেছে। সে আর বাড়ির বাইরে বের হওয়ার সাহস পায় না, কারণ রাস্তায় সন্ত্রাসীরা গোলাগুলি করে। আমি তাকে বলি ম্যাট্রিকে ভালো রেজাল্ট করায় ছেলেটার কোনো দোষ নাই; দিনেদুপুরে রাস্তায় প্রকাশ্যে গোলাগুলি হলে যেকোনো স্বাভাবিক মানুষ ভয় পেতে বাধ্য।

আমার ব্যাখ্যা তার ভালো লাগে না। সে জেদের সুরে বলে, সে আর লেখাপড়া করবে না। ম্যাট্রিক পরীক্ষাও দিতে যাবে না।

আমি তাকে বলি, সেটা হবে নিজের পায়ে কুড়াল মারা।

সে বলে, পড়াশোনা তার ভালো লাগে না।

আমি জানতে চাই, তার কী ভালো লাগে।

সে বলে, কিছুই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে তার মরে যেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু কীভাবে মরবে বুঝতে পারে না। সে আমার কাছে জানতে চায়, আত্মহত্যা ছাড়া মরে যাওয়ার কী উপায় আছে। আমি বলি, সে রকম কোনো উপায় আমার জানা নাই।

তখন মনিকা রাগ করে বলে, ‘তোমারে নিয়া আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নাই, বুঝলা? লিভ মি অ্যালোন!’

আমি বলি, ‘আচ্ছা।’

মনিকা আরও রেগে উঠে বলে, ‘আচ্ছা কী, আঁ? আচ্ছা কী?’

‘আয়্যাম লিভিং ইউ অ্যালোন।’

ছয়.

দুপুরে মনিকা আমার অফিসে চলে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে নগদ এক লাখ টাকা। এক হাজার টাকার একটা তোড়া রাখে আমার টেবিলের ওপর। তারপর মুখ তুলে আমার মুখের দিকে চেয়ে বলে, ‘এটা তোমার ড্রয়ারের মধ্যে রাখো।’

আমি রাগী চোখে ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকি। মনিকা তা লক্ষ করে, কিন্তু পাত্তা দেয় না।

হঠাৎ বলে, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি রাজি?’

আমি হাসতে থাকি। চোখ পিটপিট করে বলি, ‘তোমার আম্মুর বয়স কত?’

‘তুমি বিয়ে করবা আমারে, আমার আম্মুরে না।’

‘তোমার আব্বুর কী খবর?’

‘শিট্!’

‘কী?’

‘বুলশিট্!’

বাবাকে গালিটা দিয়েই সে ঝট্ করে ঘাড় গুঁজে মাথাটা নিচু করে চুপ মেরে গেল। কাঁধ পর্যন্ত ছড়ানো চুলের রাশি সামনের দিকে এসে ঝুঁকে পড়া মুখমণ্ডল ঢেকে নিচের দিকে নেমে ঝুলতে লাগল। নিশ্বাসের তালে তালে ওর কিশোরী কাঁধ দুটো মৃদু ওঠানামা করছে। হঠাৎ ঘরের এয়ারকন্ডিশনারটি সরব হয়ে উঠল। তারপর শোনা গেল ইলেকট্রনিক দেয়ালঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার শ্লিক শ্লিক শব্দ।

অনেকক্ষণ পর মনিকা মাথা তুলল। মুখের ওপর থেকে চুল সরিয়ে তাকাল আমার মুখের দিকে। ওর চোখ দুটো লাল, ভেজা। এখন ওকে কিশোরী মনে হচ্ছে না।

‘তুমি তাহলে রাজি না?’ ওর জিজ্ঞাসার ভঙ্গি সিরিয়াস।

আমি চুপচাপ ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

মনিকা ওর পার্স খুলে মোবাইল ফোন বের করে ফোনবুক থেকে একটা নাম্বার বাছাই করে আমার দিকে ফোনটা এগিয়ে ধরে বলল, ‘এইটা আব্বুর নাম্বার। তুমি তারে ফোন দাও। ফোন দিয়া বলো, মহিউদ্দিন সাহেব, আমার বয়স ফিফটি ফাইভ, আপনার একমাত্র মেয়ে মনিকা আমাকে বিয়ে করতে চায়...সে এখন আমার পাশে, আমার হাত ধরে আছে...’

মনিকা মোবাইল ফোনটা টেবিলে রেখে আমার ডান হাতের ওপর একটা হাত রাখল, ‘...তুমি বলো, মহিউদ্দিন সাহেব, আপনার মেয়ে আর আমি এখন কাজি অফিসে যাচ্ছি...’ মনিকা একটু থামল, একটা দম নিয়ে বলল, ‘না, তুমি বলো, মহিউদ্দিন সাহেব, আপনি আপনার মেয়ের বয়সী যে হোরটাকে...’ মনিকা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, ‘...হ্যাঁ, তাই বলো, জাস্ট এই শব্দটাই ইউজ করবা...তারপর বলবা, আপনি যদি এক ঘণ্টার মধ্যে আপনার ওয়াইফের কাছে ফিরে না যান, তার হাত ধরে মাফ না চান...’

মনিকা মাথা নিচু করে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ল।