বাঙালি লেখকের জীবিকা

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী
অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

দুনিয়ার সবচেয়ে বঞ্চিত শ্রমজীবীদের একজন বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যিক। প্রায় প্রবাদের মতো করে বলা এ কথা শুনে পাশ থেকে তাঁর সমকালীন কবিবন্ধু হয়তো মুচকি হাসেন, কিন্তু মেনে নেন। মেনে না নিয়ে উপায় নেই। মেধা আর প্রতিভা নামের শব্দ দুটোকে পাশে সরিয়ে রেখে, কায়িক শ্রম বলো আর শক্তি বলো তা কাহিনিগদ্যের লেখককে দিতে হয় বিস্তর, মজুরের সঙ্গে সেখানে তাঁর ফারাক নেই। কিন্তু পাওনার বেলায় ভাঁড়ার প্রায় ঢু ঢু! কবি-কথাশিল্পী কি নাট্যকার প্রত্যেকেই ‘শিল্প’ সৃষ্টির কথা ভেবে কাটামুণ্ডুর দিবাস্বপ্নে যতই বিভোর হোন, একদম ব্যতিক্রম বাদে তাঁর গ্রাসাচ্ছাদন যে লেখা দিয়ে হবে সে উপায় তো নেই। তাঁর বইটি যত মূল্যবান বলে বাঙালির জনারণ্যে প্রচারিত হোক, হোক ম্যাগনাম ওপাস তথা মাস্টারপিস কিংবা ক্ল্যাসিক কি ধ্রুপদি—এমন বাহারি সব তকমাধারী। বিভিন্ন সময়ের এমন কয়েকটি বইয়ের নাম যদি এক নিশ্বাসে নেওয়া যায়, দেখা যাবে তা থেকে ওই লেখকের প্রাপ্তি কোনোভাবেই লেখাকে জীবিকা বলে ভাবার সুযোগ দেয়নি। মহাপৃথিবী কিংবা ঢোঁড়াই চরিতমানস, লালসালু, কালো বরফ অথবা জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা—এই কাতারে নাম করার মতো বইয়ের সংখ্যা একেবারে কম নয়। কোনো কোনোটির লেখা হিসেবে মর্যাদাবান হতে সময়ও লেগেছে বেশ। যদি কিছু জুটেও থাকে, তবু সে লেখা থেকে প্রাপ্ত গালভারী সম্মানদক্ষিণায় রচয়িতার জীবন চলবে না। তাই লেখাচর্চার পাশাপাশি একটি উত্তম জীবিকার সন্ধান করতে হয়েছে সৃষ্টিশীল বাঙালি লেখককে।

লেখাকেই জীবিকা করে নিয়েছিলেন বাংলা ভাষার প্রধানতম যে গদ্যলেখক, সেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপলব্ধিই তো এই: ‘লেখক নাম করা না হলেও যে ভাষায় একখানা বই ভালো বলে নাম হলে হাজার হাজার কপি হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়, সেই ভাষার লেখককে স্বভাবতই জীবিকার জন্যে চিন্তা করতে হয় না।’ তাঁর এই রচনাটির নাম ‘লেখকের সমস্যা’। এই সমস্যা তিনি হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন। তাঁর মতো করে বোঝেননি আর কোনো বাঙালি লেখক। একেবারে জীবন দিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে বোঝা যাকে বলে। অথচ লেখক হিসেবে তিনি যখন ‘খানিক’টা নামকরা, বয়স মাত্র ২৮, তখনই (১৯৩৬) তো লিখে ফেলেছেন বাংলা ভাষার চারটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস—দিবারাত্রীর কাব্য, জননী, পদ্মানদীর মাঝি ও পুতুল নাচের ইতিকথা। কিন্তু তাতে বাংলা কাহিনিগদ্যের (হয়তো) উন্নতি হয়েছে, কিন্তু বিক্রমপুরের মালপদিয়ার মানিক বাড়ুজ্জের লাভ হয়নি কিছুই। তবু লেখাকেই জীবিকা করার চেষ্টা করে গেছেন তিনি। তাই শেষ জীবনে তাঁর উপলব্ধি বড় করুণ—চারটে ডালভাতের ব্যবস্থা না রেখে কোনো বাঙালি লেখক যেন লিখতে না আসে।

তার মানে, গ্রাসাচ্ছাদনই বড় সমস্যা, চারটে ডালভাতের জোগাড়! এ জন্য লেখাকেই জীবিকা করে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয় কোনো বাঙালি লেখকের পক্ষে। হয়তো সম্ভব। একটি-দুটি সফল উদাহরণ উঁকি মারে। নামও নেওয়া যায় চাইলেই। সেজন্য সেই লেখককে লিখতে হয়েছে দিস্তেকে দিস্তে। তাতে ‘ভালো’ লেখার পাশে আবর্জনাও বেড়েছে বিস্তর। কিন্তু মানিকের ওই উপলব্ধি তো পশ্চিম দুনিয়ার কোনো কোনো ভাষার লেখককে মাথায় রেখে। সেখানে একখানা ভালো বইয়ের লেখককে আর করতে হয় না কিছুই। তারপর লেখাই তাঁর একমাত্র ধ্যান।

কিন্তু, সে ধ্যানে বাঙালি লেখক যোগী হতে পারেননি কখনোই। উনিশ শতকে ঈশ্বর গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আর দীনবন্ধু মিত্র সাংবাদিকতা বা সরকারি চাকরি করেছেন। এঁদের উল্টো বিন্দুতে আছেন মাইকেল মধুসূদন। কলমে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব ছিল না, কিন্তু চাকরির ধাত হয়তো কখনোই অর্জন করতে পারেননি এই মহাকবি। এর পরে মীর মশাররফ হোসেন অথবা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—জমিদারনন্দন হলেও জমিদারি দেখাশোনাই তাঁদের প্রায় জীবিকা করে নিতে হয়েছে। তবু গ্রাসাচ্ছাদন বিষয় না হলেও লেখাই যে একমাত্র কাজ—এমন পথ কখনো বাঙালি লেখকের জন্য মসৃণ ছিল না। তা ছাড়া রাজসভার লেখকের দিন তো সেই ঘোরতর ব্রিটিশ ঔপনিবেশের কালে আর ফিরিয়ে আনার উপায় নেই। সম্ভবত শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিশ শতকের প্রথম দিক থেকে জনপ্রিয়তা ও লেখাকে জীবিকা করার প্রথম বড় উদারহণ। একুশ শতকে তাঁর দোসর হুমায়ূন আহমেদ।

একটা অমলধবল চাকরির খোঁজ বাঙালি লেখককে করতেই হয়, অন্তত দু-দণ্ড শান্তিতে লেখার জন্য। কিন্তু সেখানেই যত অপচয়। রোদঝড়জলের একজন মানুষ যদি দিনের আটটি ঘণ্টা স্রেফ গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য ব্যয় করেন, তারপর শরীর আর মনের সেই শক্তি কীভাবে থাকে, যা তাঁকে কলম চালানোর ক্ষমতা জোগায়। সেদিক থেকে ভাবলে বাঙালি লেখকের পরিশ্রমের অন্ত নেই। সেই জন্য অন্তত দুটো পেশার প্রতি এই লেখকদের ঝোঁক গোড়া থেকেই। একটি সাংবাদিকতা, অন্যটি শিক্ষকতা। লেখা আর পড়ার কাছাকাছি থাকার জন্য তিনি এ দুটোর একটি বেছে নেন। তা-ও যে সবার ভাগ্যে খুব সুখকরভাবে জুটেছে তাই-বা বলা যায় কী করে?

বুদ্ধদেব বসু কি সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো ডাকসাইটে ছাত্রও কি চাকরিজীবনে সহসা থিতু হতে পেরেছেন? শিক্ষকতায় তাঁরা কখনোই স্বস্তিতে ছিলেন না, বলতে গেলে। বুদ্ধদেব লিখেছেন, বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে তাঁর কলমের নিব ঘষে। যদিও মুজতবা আলীর বিষয়টা একটু উল্টো। প্রথম লেখা দেশে বিদেশে থেকেই তিনি বিখ্যাত। কিন্তু শিক্ষকতা বা সরকারি চাকরি—কোথাও তাঁকে স্বস্তি দেয়নি। ওদিকে চাকরি যখন থাকত, তখন কলম চালাতে চাইতেন না তিনি। বলতেন, দেরাজে পয়সা থাকলে লিখব কেন। যদিও লিখেই তাঁকে চলতে হয়েছে জীবনের অনেকগুলো দিন, তাই অর্থকষ্ট পিছু ছাড়েনি। জীবনানন্দ দাশ বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে চাকরির আগে বারবার অনিশ্চয়তার ভেতর দিয়ে গেছেন, পরেও গেছেন। সংবাদপত্রে কাজ করেছেন। এমনকি অর্থকষ্ট ঘোচাতে উপন্যাস লিখেছেন, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ছাপতে দেননি। বেকারত্বের মলিন দিনগুলো ভরিয়ে তুলেছেন অমলিন সব গল্প-উপন্যাসে, একান্তে আর নিভৃতে।

গত শতকের তিরিশ দশকের লেখকেরাই প্রথম লেখকজীবনকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অর্জিত চাকরির অনুগামী করে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছেন। অনেকেই ছিলেন মেধাবী ছাত্র। কেউ কেউ সচ্ছল পরিবারের সন্তান। অমিয় চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, বিষ্ণু দে—এঁদের কেউ শিক্ষক ও আমলা ছিলেন, কারও কিছু করার প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু জমিদারবাড়ির ছেলে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এঁদের তুলনায় উল্টো, পেটে বিদ্যেও ছিল তাঁর কম। তাই যখন লিখে দিন চলে না, পরিবার থেকে দূরে কলকাতায় একা, তখন বোম্বে টকিজে কাহিনি রচনার জন্য মোটা বেতনের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, লেখা ছাড়া অন্য জীবিকা তিনি গ্রহণ করবেন না। জগদীশ গুপ্ত আদালতের টাইপিস্ট ছিলেন। সাংবাদিকতা করেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। সেখানে খুব সচ্ছলতার মুখ দেখেছেন তা নয়, তবে তাঁর কাব্যগ্রন্থের বিক্রির রেকর্ড আজও বিস্ময়কর। পরে গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য গান লেখাই ছিল তাঁর জীবিকা। সেই পর্বে আয়-রোজগার ভদ্রস্থ, কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি কেড়ে নেয় তাঁর সুদিন। তাঁর বন্ধু শিবরাম চক্রবর্তী মেসে থেকে, জীবিকার খোঁজকে তোয়াক্কা না করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় জমিদারি স্টেটে চাকরি ও স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তাঁর আত্মভোলা জীবনাচরণ কখনো লেখা আর জীবিকার দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি। আবুল মনসুর আহমদের জীবিকা ছিল সাংবাদিকতা ও আইন পেশা। বিচিত্র জীবিকায় ছিলেন অনেকেই। বোম্বে টকিজের কাহিনিকারের কাজ হয়তো লেখকের জন্য খানিকটা অনায়াস জীবিকাই। কিন্তু জরাসন্ধ জেলার ছিলেন। সুবোধ ঘোষ প্রথমজীবনে বাসের হেলপার, ট্রাক ড্রাইভার আর সার্কাসের ক্লাউনের কাজ করেছেন, পরে বিখ্যাত সাংবাদিক। অবধূত সন্ন্যাসী হওয়ার পরে লিখতে শুরু করেন, তাই তাঁর ক্ষেত্রে জীবিকার বিষয়টি নেই। গোপাল হালদার শিক্ষকতা করেছেন, অচিন্ত্য সেনগুপ্ত মুন্সেফ ছিলেন; প্রেমেন্দ্র মিত্র সাংবাদিকতা, চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন জীবিকা হিসেবে। মেধাবী ছাত্র নীরোদচন্দ্র চৌধুরী কখনো একটানা নির্দিষ্ট কোনো জীবিকায় ছিলেন না। এই পর্বের লেখকদের প্রায় কেউই কখনো জীবিকায় খুব থিতু ছিলেন তা-ও নয়। সে অনিশ্চয়তা কখনো তাঁদের পিছু ছাড়েনি। লীলা মজুমদার আর আশাপূর্ণ দেবীর হয়তো কোনো জীবিকা গ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি।

তাঁদের তুলনায় দেশভাগের আগে ও পরের লেখকদের অনেককেই জীবিকার প্রশ্নে সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করেছেন। হয়তো, ততদিনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপদেশ ও পরিণতি তাঁদের সামনে উদারহণ। আরও হতে পারে, ব্রিটিশরাজের পতন ও দেশভাগের পরে উভয় বাংলায় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ সময়ের লেখকের অনেকেই সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদেও চাকরি করেছেন। কেউ কেউ প্রথম পর্বে সাংবাদিকতা দিয়ে জীবন শুরু করেছেন। কেউ সারা জীবনই সাংবাদিক ও শিক্ষক। অরুণ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিমল মিত্র, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আবু রুশদ, অসীম রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, শওকত ওসমান, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, রশীদ করীম—এঁরা সরকারি চাকরি, সাংবাদিকতা আর শিক্ষকতা করেছেন। কমলকুমার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা করেছেন, পরে শিক্ষকতা।

গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য মুখ বুজে জীবিকার দাসত্ব করে গেছেন তাঁরা। লেখাকে যে তাঁদের একমাত্র কাজ ভাববেন, উপায়ই নেই। তা থেকে আয়ের এমন কোনো সুযোগ ছিল না যে আর কিছু করবেন না। এতে তাঁদের জীবনীশক্তি ক্ষয় হয়েছে প্রচুর। লেখায় কম মনোযোগ দিতে পেরেছেন। ব্যতিক্রম সমরেশ বসু। প্রথম যৌবনে তিনি নকশাকারের চাকরি ও সবজি বিক্রির মতো কাজ করলেও পরবর্তীকালে লেখাকেই জীবিকা হিসেবে নেন। সে জন্য শুরুর দিকে তাঁকে অসহনীয় দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

কিন্তু এর ঠিক পরের প্রজন্মে বিষয়টা একটু অন্য রকম। এখনো সে ধাতের আঁচ আছে। লেখকদের অনেকেই মেধাবী। কারও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ফলাফল তাক লাগানো। সেই ফলের ভার কখনো কখনো কর্মজীবনে পড়েছে। অর্থাৎ দেখা গেছে শুরুর দিকে লেখক হিসেবে তাঁর অর্জনকে ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে জীবিকা। সেখানে তাঁর উন্নতিও হয়েছে, কিন্তু আর কখনোই সাহিত্যের মূল¯স্রোতে সেভাবে ফিরে আসতে পারেননি। আবার হতে পারে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় যাঁরা লিখতে শুরু করেন, সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অন্য ক্ষেত্রে মনোযোগের সুযোগও ছিল। কিংবা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে মনোযোগী হয়েছেন। এ সময়ের বেশির ভাগ লেখকই পূর্বসুরিদের মতো সাংবাদিকতা ও শিক্ষকতাকে জীবিকা হিসেবে নেন। খুব ব্যতিক্রম অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কেউ। তিনি পরে শিক্ষকতা করলেও, একসময় জাহাজে খালাসির কাজ করেছেন। মহাশ্বেতা দেবীও তাই। শিক্ষকতায় থিতু হলেও জীবনে একসময় ফেরিওয়ালার কাজ করতে হয়েছে তাঁকে। আবার সৈয়দ শামসুল হক চলচ্চিত্রসংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে নিজেকে সচল রেখেছেন দীর্ঘকাল। মাহমুদুল হক রত্ন-পাথর চিনতেন, সোনার ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ও পশ্চিমবাংলায় সমকালীন লেখকদের প্রায় সবাই শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সরকারি প্রশাসনিক পদে চাকরি করেছেন অনেকেই।

বাঙালি লেখককে জীবিকা হিসেবে যে পেশাই নিতে হোক, তাঁর ব্যক্তিগত অনিচ্ছার কোনো শেষ নেই। পেশায় তিনি যত সফলই হোন, সেখানে তাঁর শক্তির অনেকখানিকই চলে যায় এ কথা সব সময়ই তাঁর মুখে উচ্চারিত হতে থাকে। জীবনানন্দ দাশ বা বুদ্ধদেব বসু যখন চাকরিতে থিতু হয়েছেন, তখনো কিন্তু সে জন্য যে লেখায় ব্যাঘাত হচ্ছে এমন কথা মৃদুস্বরে উচ্চারিত হয়েছে তাঁদের মুখে। ‘পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি!’

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে ডায়েরিতে দিনযাপনের হিসেবের সঙ্গে লিখেছেন যে একটি গল্প বা উপন্যাস লিখে কত টাকা পাবেন; অথবা একটা উপন্যাস ভেঙে কয়েকটি গল্প আকারে ছাপতে দিলে বেশি পাবেন না কম পাবেন—এতে তাঁর চরম সংকট ধরা পড়ে। এদিকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ডায়েরিতে লিখেছেন, কলেজের এমন সব কাজ তাঁকে দেওয়া হয়েছে যে তিনি লেখার সময়ই বের করতে পারছেন না। অথচ লেখার জন্য সময়ের তাঁর ভীষণ প্রয়োজন। এখানে প্রায় দম নিতে না পারা মানুষের মতো অসহায়ত্ব তখন তাঁর। কিন্তু এই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসই বলতেন যে তিনি সার্বক্ষণিক লেখক। অর্থাৎ জীবিকাসহ অন্যান্য কাজে সময় ব্যয় হয় ঠিকই, আসলে তখনো লেখার সময়টাকে বের করতে চান, তাই লেখা তাঁর কাছে সার্বক্ষণিক।

আবার এমন তো হতে পারত, হতে পারে, একটি নিশ্চিত জীবিকা বাঁচিয়ে দিয়েছে লেখকের জীবন। জীবিকা তাঁর কাজের সময়ের বড় অংশ নিয়ে নেয় ঠিকই, কিন্তু জীবন চালানোর সচ্ছলতাও তো দেয়। সে কথা ভাবলে কেন যেন মনে হয়, মেধাবী ছাত্র কায়েস আহমেদ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে যেভাবে ত্যাগ করেছেন, যদি সেভাবে আত্মঘাতকেও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারতেন? কিন্তু তা-ও যে তিনি পারেননি তা হয়তো জীবিকার প্রশ্নেই!

বঞ্চিত বাঙালি লেখক তাই কেন যেন কখনো খুঁজে পাবেন না তাঁর প্রকৃত জীবিকা। সে জীবিকা অর্থ আর কীর্তির বাইরে কেবল সচ্ছলতার জন্য বিপন্ন বিস্ময় হয়েই থাকবে!