বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের আগাপাছতলা

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সনাতন গর্ত তাঁতে কাজ করছেন তাঁতিরা। ছবি: আলোচ্য বইয়ের সৈজন্যে
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সনাতন গর্ত তাঁতে কাজ করছেন তাঁতিরা। ছবি: আলোচ্য বইয়ের সৈজন্যে

তাঁতশিল্পের বয়স নাকি মানবসভ্যতার প্রায় সমসাময়িক! কথাটা শুনে প্রথমেই আক্কেলগুড়ুম হলো নাকি? সাধারণ যেকোনো পাঠকই এই তথ্যে খানিকটা চমকে উঠতে পারেন। তবে বয়নশিল্পের আগাপাছতলা বিশ্লেষণ করে, সরেজমিনে সমীক্ষার ভিত্তিতে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প শিরোনামে শাওন আকন্দ যে ঢাউস কিতাবটি রচনা করেছেন, সেখানে মানবসভ্যতার সঙ্গে তাঁতশিল্পের যোগাযোগ প্রসঙ্গে বইয়ের প্রথমে ‘তাঁতশিল্পের উদ্ভব ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক পর্বে সবিস্তারে যে কথাগুলো লেখা হয়েছে, তার চুম্বক অংশে চোখ বোলালে পাঠকের চমকানি খানিকটা থিতু হতে পারে বলে মনে হয়। উপরোক্ত প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের একপর্যায়ে মানুষ প্রথমে বুননকৌশল শেখার নেপথ্যে প্রকৃতি পর্যবেক্ষেণের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। বিশেষত, মাকড়সার জাল তৈরি, পাখির বাসা তৈরি ইত্যাদি দেখে মানুষ বয়ন বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা লাভ করেছিল বলে অনুমান করা হয় (বিভিন্ন কিংবদন্তি বা লোকগাথায় এই ধারণার সমর্থন খুঁজে পাওয়া যায়)।’

এভাবে নানা তথ্য-উপাত্তের সমাবেশ ঘটিয়ে, বিচিত্র বিষয়-আশয় বিশ্লেষণপূর্বক অতঃপর বলা হয়েছে, নব্য পলীয় যুগে অর্থাৎ ৭০০০ বা ৮০০০ অব্দের আগেই বুননকৌশল আবিষ্কার হয়েছিল। পৃথিবীর প্রাচীন বুননের নিদর্শন পাওয়া গেছে পেরুর একটি গুহায়। এর নিকটবর্তী সময়ে উত্তর আমেরিকা ইরাক ও মিসরেও বুননকৌশলের প্রমাণ পাওয়া যায়।

তো, বইটির নাম যেহেতু বাংলাদেশের তাঁতশিল্প, তাই স্বাভাবিকভাবেই এটা জানার ইচ্ছা জাগে যে ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁতের এই কৌশল কবে প্রযুক্ত হয়েছিল?

প্রশ্নটির জবাব অনুসন্ধানে যেতে হবে সিন্ধু সভ্যতায়। লেখকের ভাষ্যে, ‘এই সভ্যতার মানুষ যে তুলা ও পশুর লোম থেকে সুতা তৈরি করত এবং তা দিয়ে বস্ত্রবয়ন জানত, তা জানা গেছে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে। পৃথিবীতে এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরোনো সুতি বস্ত্রের সন্ধান এখানেই পাওয়া গেছে।’

লেখার অপেক্ষা রাখে না, বইটি গবেষণা লব্ধ। উপরন্তু ২০০৭ থেকে ২০১১ অব্দি ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এই ভূখণ্ডের তাঁতশিল্প নিয়ে লেখক যে গবেষণা করেছেন, আলোচ্য পুস্তকটি তার ফল। শাওন আকন্দের বরাতে জানা যায়, এই তিন বছর সময়কালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি তাঁতসমৃদ্ধ অঞ্চলে তিনি ঘুরেছেন। এখানকার তাঁতিদের সঙ্গে যেমন কথা বলেছেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, নিরীক্ষণ করেছেন এই শিল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা; তেমনি ঘেঁটে দেখেছেন ওই অঞ্চলের তাঁতের ঐতিহ্য।

>

বাংলাদেশের তাঁতশিল্প

শাওন আকন্দ

প্রচ্ছদ: ইশরাত জাহান, প্রকাশক: দেশাল, ঢাকা, প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ৪৩৩ পৃষ্ঠা, দাম: ২৪০০ টাকা।

তাই বইয়ের মোট বারোটি অধ্যায়ের (অধ্যায়কে লেখক অভিহিত করেছেন ‘পর্ব’ নামে) মধ্যে প্রথমে আলোচিত হয়েছে পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে তাঁতশিল্পের উদ্ভব প্রসঙ্গে, দ্বিতীয় পর্বে আছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সোনালি অতীতের বিবরণ, তৃতীয় পর্বের আলোচনা বিস্তারিত হয়েছে সুতাকে কেন্দ্র করে, চতুর্থ পর্বের বিষয় রঞ্জনশিল্প, পঞ্চম পর্বে রয়েছে সূচনালগ্ন থেকে অদ্যাবধি বিভিন্ন তাঁতযন্ত্রের উদ্ভব ও বিবর্তনের রূপরেখা, ষষ্ঠ পর্বে বলা হয়েছে তাঁতিদের বৃত্তান্ত, বয়নপদ্ধতি নিয়ে কথা আছে সপ্তম পর্বে, অষ্টম পর্বে আছে বাংলাদেশের তাঁতবস্ত্রের নকশাসংক্রান্ত আলোচনা, নবম পর্বের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে তাঁতশিল্পের বাজার, বিক্রয় ও বিপণন প্রসঙ্গ, দশম পর্বে আছে তাঁতিদের সাক্ষাৎকার, একাদশ পর্ব বিস্তারিত হয়েছে তাঁতশিল্পের পরিবর্তন ও এর ভবিষ্যৎকে আশ্রয় করে এবং বইয়ের শেষ অর্থাৎ দ্বাদশ পর্ব হলো পরিশিষ্ট অংশ।

ওপরে এই যে বইয়ের অধ্যায়গুলো সম্পর্কে এক লাইনে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা, তারও সংগত ও বাস্তবসম্মত কারণ আছে বৈকি। আদতে বইটির প্রতিটি অধ্যায় এতই পরিব্যপ্ত ও তথ্যবহুল, স্বল্প পরিসরের পরিচিতিমূলক এই আলোচনায় কোনো একটি অধ্যায় সম্পর্কে কথা পাড়তে গেলে অন্য অধ্যায় সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার অবকাশই মিলবে না। ফলে কেবল নাম উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকা আরকি।

তবে আমাদের বিবেচনায়, প্রকাণ্ড এই পুস্তকের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো দশম পর্বভুক্ত তাঁতিদের সাক্ষাৎকারগুলো। এই সাক্ষাৎকার আবার ভাগ করা হয়েছে দুটি ভাগে। প্রথম ভাগে রয়েছে ২৩ জন তাঁতির কথামালা, আর দ্বিতীয় ভাগে স্থান পেয়েছে কয়েকজন শিক্ষিত নকশাবিদ, গবেষক ও শহুরে উদ্যোক্তার কথোপকথন। সব মিলিয়ে সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের নিরেট বর্তমান। আর এর ভবিষ্যৎ রূপরেখা সম্পর্কে তবে কী বলা হয়েছে পুস্তকে?

বলা হয়েছে, বিলুপ্ত হয়ে গেছে মসলিন। (এতে নতুন মসলিন বিষয়ে কোনো কথা নেই। অনুমান করা যায়, বইয়ের গবেষণা-পরিধি ২০১১ পর্যন্ত হওয়ায় সংগত কারণে নতুন মসলিনের আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি)। তাঁতশিল্প ও তাঁতিদের আগের দিনকালও গত। তবু এই শিল্প থাকবে, একটু পরিবর্তিতভাবেই থাকবে: আগে যেমন এ শিল্প ছিল একান্তই তাঁতিদের আওতায়, অদূর ভবিষ্যতে তা আর থাকবে না; তাঁতের কারখানা থাকবে, ঘরের তাঁত থাকবে না। তাঁতিরা তখন ওই সব কারখানায় কাজ করবেন কেবল শ্রমিক হিসেবে।

বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের এই নতুন পরিবর্তন ভালো না খারাপ হবে, সেটি জানার জন্য অবশ্য বইয়ের পৃষ্ঠায় নয়, তাকিয়ে থাকতে হবে আগামী সময়ের দিকে!