তাঁর রচনা ও চিন্তাচেতনার ধারা

চট্টগ্রামে মাইজভান্ডারি সংগীত। ছবি: প্রথম আলো
চট্টগ্রামে মাইজভান্ডারি সংগীত। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের প্রখ্যাত লেখক ছৈয়দ আহমদুল হকের মধ্যে আমরা পাই পাণ্ডিত্য, ইতিহাসবোধ, দার্শনিকের গভীরতা এবং সৃজনশীল কবির কাব্যশৈলী। এই শেষোক্ত গুণটির বিচ্ছুরণ তাঁর রচনায় প্রবল এবং এর ফলে তিনি সংগত কারণেই অগণিত পাঠকের হৃদয়ে ‘বাংলার রুমি’ হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে গেছেন।

আজকের উপমহাদেশ তথা বিশ্ব একটি অস্থিরতা, হিংসা ও অবিশ্বাসের পরিবেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই পটভূমিতে বাংলাদেশের রুমি সোসাইটি যে ছৈয়দ আহমদুল হকের মরমিয়াবাদাচ্ছন্ন ও রুমি ভাবাক্রান্ত রচনাবলিকে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষায় সুফিসন্তদের নিয়ে বা রুমিকে নিয়ে চিন্তামূলক লেখালেখির যথেষ্ট অবকাশ আছে। এই প্রেক্ষাপটে ছৈয়দ আহমদুল হক সাহেবের রচনাবলি বাংলাদেশ তথা পূর্ব ভারতের সাহিত্য ও সংস্কৃতির মানবিক মুখটিকে উন্মোচিত করতে সহায়ক হবে, এই আশা রাখি।

ছৈয়দ আহমদুল হক যথার্থই অনুধাবন করেছেন যে এই উপমহাদেশের ভাবান্দোলনের ইতিবৃত্ত রচনায়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় এসে পড়ে সুফিসন্ত বা আউলিয়াদের কথা। কেবল মধ্যযুগ নয়, আধুনিক উপমহাদেশকে চর্চা করতে গেলেও এ কথা সত্যি প্রমাণিত হয়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, রাজা রামমোহন রায়, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বাউল ও মাইজভান্ডারি সম্প্রদায়, মীর মশাররফ হোসেন, দাদ আলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে সুফি ভাবাদর্শের কাছে ঋণী। অনেকে বলেন যে পারস্য ও পাঞ্জাবি সাহিত্যেরও শ্রেষ্ঠ প্রেরণা হলো এই সুফি ভাবাদর্শ। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অনেক ব্রহ্মার কাছে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যদিও তিনি রামমোহনোত্তর যুগে ওই ব্রাহ্ম আন্দোলনকেই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। সেই আপাত-রক্ষণশীল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও কিন্তু সমসাময়িক শিক্ষিত হিন্দু বা ব্রাহ্মদের মতো ভালো ফারসি জানতেন এবং পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের কবিতা পাঠ করে তাঁর দিনের সূচনা হতো।

একবিংশ শতাব্দীতে, যখন বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে দেখতে পাই অসহিষ্ণুতা, হিংসা, সংকীর্ণতা, অবিশ্বাস এবং যখন দেখি সুফিবাদ, যা মানবতার জয়গান গায়, তা আক্রান্ত, সেই প্রেক্ষাপটে কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত দেবেন্দ্রনাথকেও উদার মনের এক মানুষ হিসেবে মনে হবে। মানুষ আজ প্রতিবেশীর ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বুঝতে চায় না, তাই প্রতিবেশ আজ বিপন্ন। এই বিপন্ন প্রতিবেশকে রক্ষা করতে মানবতার যে বৃহত্তর প্রয়াস, তার এক উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব আমরা দেখতে পাই ছৈয়দ আহমদুল হকের তথা ‘বাংলার রুমি’র অসামান্য সৃজনশীল রচনায়। সুফিবাদ-বিচ্ছুরিত সে রচনায় বাংলা পাঠক ঋদ্ধ হবেন। মোকাবিলা করতে সক্ষম হবেন ধর্মীয় সংকীর্ণতার, অসহিষ্ণুতার।

অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতায় বাংলার রুমির রচনায় গুরুত্ব পেয়েছে সুফিদের ওহাদাত-উল-ওজুদ তত্ত্ব। বেদ-উপনিষদের সর্বেশ্বরবাদের সঙ্গে এই তত্ত্বের মিল আছে। উপমহাদেশের সুফিবাদের ইতিহাসে দেখা যায় যে এই তত্ত্বটিই অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। মধ্য এশিয়ায় বা পশ্চিম এশিয়ায়, যেখানে একদিন সুফিসন্তদের উৎপত্তি হয়েছিল, সেখানে কিন্তু আধুনিক যুগে, বিশেষত, ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এই তত্ত্বেরও গুরুত্ব কমে গেছে এবং সেই সঙ্গে ওই অঞ্চলে সুফিসন্তদের সামাজিক তথা ধর্মীয় প্রভাব হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। একই কথা বলা যায় উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সমাজ সম্পর্কে।

ছৈয়দ আহমদুল হকের বই
ছৈয়দ আহমদুল হকের বই

উপমহাদেশের, এমনকি পাশ্চাত্যেরও একাধিক ঐতিহাসিক মনে করেন যে সুফিসন্তগণ শরিয়তের বদলে কেবল তরিকতে জোর দেন। এটা একেবারেই ঠিক নয়। শরিয়তের সঙ্গে তরিকতের কোনো মৌলিক বিরোধ নেই। সুফিবাদের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর আছে। উপমহাদেশের লব্ধপ্রতিষ্ঠ সুফিগণ শরিয়তকে বাদ দিয়ে তরিকত, মারিফত বা হকিকতে যাওয়ার কথা বলেননি। একদা বাদাউনবাসী নিজামুদ্দিন আউলিয়ার গভীর শাস্ত্রজ্ঞান ছিল। তাঁর মুর্শিদ শেখ ফরিদ সম্পর্কেও একই কথা বলা চলে। বিখ্যাত চিশতি সন্ত নিজামুদ্দিনের শৈশবের শিক্ষা ওই বাদাউনেই সম্পন্ন হয়। এই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের বক্তব্যকেও সমর্থন করে। কারণ, বাদাউন ছিল উপমহাদেশের ইসলামশাস্ত্র চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। নিমাজুদ্দিনের প্রাথমিক ইসলামশাস্ত্র পাঠ এই বাদাউনেই ঘটেছিল। এ ক্ষেত্রে তাঁর মায়েরও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ভূমিকা। তবে এ কথা ভাবারও কোনো কারণ নেই যে সব সুফিসন্তই শেখ ফরিদ বা নিজামুদ্দিনের মতো শাস্ত্রজ্ঞ ছিলেন। শেখ ফরিদ বা নিজামুদ্দিনকে বাশরা (যাঁরা শরিয়ত পালন করেন) সুফি বলা চলে। আর যেসব সুফি শরিয়তের ধার ধারেন না, তাঁদের বলা হয় বেশরা। অগতানুগতিক কলন্দরিয়া সুফিদেরও অনেক সময় বেশরা বলা হতো। কলন্দরগণ ভ্রাম্যমাণ। যার ফলে বিবিধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তাঁদের ঘটে, যার অনিবার্য পরিণতি হলো এই যে তাঁদের মধ্যে একটি সহজাত ঔদার্যবোধ ও নমনীয়তা সঞ্চালিত হয়। বহুত্ববাদীরা মিশ্র সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেন। এটা করতে তাঁদের বিশেষ সমস্যা হয় না। সমন্বয়, সহিষ্ণুতা ও সৃজনশীল সহাবস্থানের প্রতি কবি জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমির ইতিবাচক ঝোঁকের কথা অনুধাবন করতে গেলে তাঁর কলন্দরিয়া মুর্শিদের ওই সম্ভাব্য গুণাবলির কথা স্মরণ রাখা দরকার। তা ছাড়া পারস্যের কবি রুমিকেও ঘটনাচক্রে স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন করতে হয়েছে। সেই সূত্রে বহু জাতিগোষ্ঠী, ভিন্ন ধর্ম ও ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সান্নিধ্যে তিনি এসেছেন, যা মানবসভ্যতা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সম্বন্ধে তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই অভিজ্ঞতা তথা প্রজ্ঞার প্রতিফলন তাঁর ধ্রুপদি তথা কালজয়ী সাহিত্যে আমরা প্রত্যক্ষ করে ঋদ্ধ হই, আপ্লুত হই। উপমহাদেশ তথা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার প্রেক্ষাপটে তাই রুমি চর্চাকে সাহিত্যিক পুনর্বাসন দিয়ে বাংলার রুমি আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন।

রুমির জন্মস্থান (ওয়াতনে পয়দায়িশ) ছিল বলখ। মধ্যযুগে একসময়ে এই বলখ ছিল বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলনকেন্দ্র। এই বলখ আবার ছিল ব্যাকট্রীয় গ্রিকদের রাজনৈতিক কেন্দ্র বা মারকজ। এই প্রাচীন স্থানটির সঙ্গে আবার জরথুস্ত্রের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। এই বলখ আবার ছিল সুফি ভাবান্দোলনের পীঠস্থান। উপমহাদেশের কাওয়ালির জনক তথা তুতিয়ে হিন্দ নামে বিখ্যাত আমির খসরু প্রকৃত অর্থে এই বলখেরই লোক। খসরুর মুর্শিদ ছিলেন খ্যাতনামা চিশতি সুফি নিজামুদ্দিন আউলিয়া, যিনি নিজে ছিলেন সামার (সুফিসংগীত) সমঝদার। সুলতানুল মশায়েখ নিজামুদ্দিন খসরুকে আঞ্চলিক ভাষায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান বজায় রাখতে উপদেশ দেন। বাংলার রুমিও বাংলা ভাষায়, অর্থাৎ আঞ্চলিক ভাষায় মরমিয়াবাদী সাহিত্যচর্চা করে সেই জনমুখী ধারাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছেন। মাতৃভাষায় ভাব প্রকাশ করা ও সাহিত্যচর্চা করা কিন্তু নবজাগরণেরও বৈশিষ্ট্য। যেকোনো জাতির মতো বাঙালির আত্মপরিচয়ের অন্বেষণের সঙ্গে এই মাতৃভাষাপ্রীতির নিবিড় যোগ আছে, যা ভাষা আন্দোলনের সময় একটি নতুন মাত্রা লাভ করেছিল। মধ্যযুগে পারস্যের নবজাগরণ উপমহাদেশেও তরঙ্গ সঞ্চার করেছিল। সেই নবজাগরণের অন্যতম দূত ছিলেন জালালুদ্দিন রুমি, সাদি, খৈয়াম, হাফিজ প্রমুখ। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ হঠাৎ করে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই শেষ হয়ে যায়নি। ডেভিড ককের মতো বিখ্যাত ঐতিহাসিক মনে করেন, নবজাগরণের বর্ণচ্ছটা সত্যজিৎ রায়দের মতো ব্যক্তিদের মধ্যেও দেখা গেছে। এই প্রেক্ষাপটে সুফি সাহিত্য তথা বাংলা ভাষায় রুমি চর্চা করে বাংলার রুমি সেই বৃহত্তর নবজাগরণের ধারাকেই জাগরূক রেখে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন, ঋদ্ধ করেছেন।

ছৈয়দ আহমদুল হক (২ সেপ্টেম্বর ১৯১৮—৫ সেপ্টেম্বর ২০১১)
ছৈয়দ আহমদুল হক (২ সেপ্টেম্বর ১৯১৮—৫ সেপ্টেম্বর ২০১১)

মরমিয়াবাদ-উদ্বুদ্ধ ছৈয়দ আহমদুল হক তাঁর গবেষণালব্ধ সৃজনশীলতায় একটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছেন, যা কল্পনাশক্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। জালালুদ্দিন রুমির মৃত্যুর পর মুসলমান, ইহুদি, খ্রিষ্টান—সবাই শোকজ্ঞাপন করেছেন। আসলে তিনি শাস্ত্রজ্ঞানে পণ্ডিত হয়েও মানবতার মর্মবাণী তাঁর অসামান্য কাব্যিক সৃজনশীলতায় প্রচার করেছিলেন। মাইজভান্ডারি ফকিরগণও তো এই মানবতার কথাই বলেন, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেন। তাই তাঁদের গান-বাজনার আবেদন কেবল চট্টগ্রামের ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বিস্তৃত হয়েছিল নগরাঞ্চলেও; বিশেষত, এমন চিন্তকদের মধ্যে, যাঁরা হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের গুরুত্ব বুঝতেন। তাই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে মাইজভান্ডারি ফকিরগণ পরিচিত ছিলেন এবং সম্ভবত এখনো চলমান আছেন। ওলি-আউলিয়াদের সৃষ্টিতত্ত্ব তথা নূরমোহাম্মদি তত্ত্ব জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে মাইজভান্ডারিদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। এই উদার, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা মানবতার পটভূমিতে মাননীয় ছৈয়দ আহমদুল হকের রচনায় মাইজভান্ডারিদের স্থান পাওয়াটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মাইজভান্ডারিদের পোশাক, আচার-আচরণ অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির পোশাক-পরিচ্ছদ বা আচার-আচরণ থেকে পৃথক ছিল। এই পার্থক্য ছিল অনুধাবনযোগ্য। যেমন তাঁরা লম্বা চুল রাখতেন ও হুঁকা পান করতেন। যদিও তাঁদের মরমিয়াবাদী গান-বাজনা মানুষের অন্তর স্পর্শ করে যেত। তাঁরা ছিলেন বাংলার লোকায়ত তথা গ্রাম্যজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।

বাংলার রুমির কৃতিত্ব হলো যে তিনি কেবল ধ্রুপদি ইসলামীয় ঐতিহ্য, যা ফারসি ও উর্দু ভাষার মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে, তাকে নিয়েই তৃপ্ত থাকেননি। তাঁর মানবতা তথা মরমিয়াবাদ-উদ্বুদ্ধ সৃজনশীলতা বিস্তৃত হয়েছে বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে। এই উপলব্ধি ছিল বলেই রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে আমরা একটি বাউলগান পাচ্ছি বা অন্যত্র কবীরকে নিয়ে দেখতে পাই কবির আগ্রহ। বাংলার রুমির অনুরূপ উপলব্ধি, যা তাঁর রচনাবলিকে সমৃদ্ধ করে, তা আমাদের শ্রবণে-মননে পাঠক্রমে বিচ্ছুরিত হোক, মানবসমাজের কল্যাণ হোক।