সুলতানের মামুন, মামুনের সুলতান

সত্তর থেকে আশির দশক—এই দশ বছরে নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় তোলা এস এম সুলতান
সত্তর থেকে আশির দশক—এই দশ বছরে নাসির আলী মামুনের ক্যামেরায় তোলা এস এম সুলতান

বাংলাদেশের শিল্পীকুলে এখন আর খুব বেশি কেউ নেই যাঁকে জীবন-শিল্পী বলা যায়। খবর যতটুকু কানে আসে, তা হলো, শিল্প নিজেই নাকি জীবন-শর্তের মধ্যে আর থাকতে চাইছে না। অথবা জীবনের পরিসর এতদূর চলে যাচ্ছে যে তার নাগাল পাওয়া শিল্পীর জন্য আর কোনো সহজ ব্যাপার না। যাহোক, কালের যাত্রার এই করুণ মুহূর্তে তবু দুয়েকটা নাম টলমল করে ওঠে। এঁদের মধ্যে বাংলামুলুকের মহান চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান, অন্যজন ক্যামেরার কবি নাসির আলী মামুন রয়েছেন।

পনেরো ধরে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে চলছে নাসির আলী মামুন এবং এস এম সুলতানের জীবন দেখা জীবন চেনার রহস্য প্রদর্শনী। প্রদর্শনীতে কর্তা সেজেছেন মামুন আর সুলতান মামুনের সন্ধানবস্তু। মাধ্যম আলোকচিত্র।

প্রদর্শনী কক্ষে প্রবেশ করলে এমনই এক লুকোচুরি খেলার আভাস পাওয়া যায়। তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে এই খেলা দেখার আনন্দ ঢাকাবাসীর ভাগ্যে খুব কমই ঘটে। কেন তা বলছি।

আলোকচিত্রশিল্পী নাসির আলী মামুন শিল্পী এস এম সুলতানের পেছনে লেগে আছেন গত শতকের সেই ৭০ দশক থেকে। প্রদর্শনীর ছবিগুলো তোলা হয়েছে ৮০–র দশকের শুরুর মধ্যে। মানে ১০ বছর নাসির আলী মামুন লেগে ছিলেন শিল্পী সুলতানের পেছনে। এই ১০ বছরকে মামুনের ছবি-সাধনার স্নাতক কাল বলা যায় হয়তো। যাঁর জীবনচর্চা করতে মামুন ক্যামেরা নামক যন্ত্র নিয়ে নড়াইলকে মোকাম করেছিলেন, তিনি দেহ বিবেচনায় এখন গতকাল। কিন্তু মামুনের ছবিতে আলোছায়ার এক অপরূপ-লোকে আমাদের দেখার সৌভাগ্য হয় এই সুলতান বাঁশি বাজাচ্ছেন, কি গ্রাম্য বাজারে হেঁটে চলেছেন, অথবা বিড়ালগুচ্ছকে আহারসেবা করাচ্ছেন। মামুনকে শিল্পী সুলতান তাঁর সংসারটিকে দেখার জন্য যে আবেগসমান মনের ঘর-সংসার ছেড়ে দিয়েছেন, তা কজনের ভাগ্যে জোটে? সুলতানের জবানে, মামুন নাকি তাঁর গভীর গোপনতম প্রদেশটিকে স্পর্শ করেছিলেন। এক সহজ মানুষ খোঁজ পেয়েছিল আরেক সহজ মানুষের সামান্য মানুষের।

কী ছিলেন সুলতান? সুলতান আদ্যোপান্ত মানুষ ছিলেন। যে প্রচল জীবনের লোভ–লালসা ছেড়ে শিল্পের ভেতর দিয়ে কোথাও পৌঁছেছিলেন সুলতান, তখন তিনি আর নিছক শিল্পী নন। বরং এক উত্তীর্ণ মানুষ।

প্রদর্শনীতে কিছু কিছু ছবি আছে, যেগুলোতে চট করে সুলতানকে দেখা যাবে না। মামুন যেমন নিরিখ বেঁধে সুলতানকে ক্যামেরার ফুটোস্কোপ দিয়ে দিনের পর দিন খুঁজেছেন, দর্শককেও সেরকম ছবির ভেতর থেকে নজরোদ্ধার করে নিতে হয় সুলতানকে। আমি এ জন্যেই বিষয় ও বিষয়ীর লুকোচুরির কথাটা বলতে চেয়েছি।

আলোকচিত্রের কারিগর মামুন কিন্তু সাদাকালোর নির্বিশেষে সুলতানের মরমি জগৎ আবিষ্কার করছেন। ছবি যখন দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, এ ছবি কোনোভাবেই রঙিন হতে পারত না। সাদাকালো এইসব ছবি মুগ্ধ হয়ে আমরা দেখি, দেখি কোথাও আড়ালে ক্যামেরা হাতে মামুনকেও। দেখি, সুলতানের ঘর। দেখি, তার পড়োবাড়ির ভাঙা ইটের ছায়া। দেখি, তাঁর মায়াবী চোখ। বলিরেখা দেখি তাঁর। একটু পিছিয়ে এসে আমরা সুলতানের মুখে আবিষ্কার করি রেনেসাঁস যুগের কারও মুখ। কখনো দেখি, অপরূপ এক নারী জেগে আছে তাঁর মুখে। বাংলার ভাবের মধ্যে একটা গাঢ় ব্যাপার আছে। বাংলার ‘মানুষ-ধারণার’ একটা গোপন শর্ত, একই অঙ্গে দুই ভাব। পুরুষভাব। নারীভাব। যে শিল্পীর নারীভাব নেই, তা যেকোনো মাধ্যমই হোক, শিল্পসহ তাঁর জীবন অসম্পূর্ণ রয়ে যায় যেন। সুলতান-মামুন প্রেমের এই পরিস্ফুটন তাই আনন্দের।

অনেক অনেককাল পর এই অনুষ্ঠান আমার কাছে তাই এত মূল্যবান। আরও একটা মূল্যবান ঘটনা এই প্রদর্শনীর বদৌলতে আমরা পেয়েছি, তা হলো, সুলতানবিষয়ক ছবিগুলো দিয়ে স্মৃতিমেদুর নজরকাড়া একটি অ্যালবাম। প্রকাশিত হয়েছে এ উপলক্ষেই। প্রদর্শনী চলাকালীন এই অ্যালবামের ছাড়মূল্য মাত্র ২০০০ টাকা, যা আমাদের এই যুগলের লুকোচুরি খেলা দেখার স্থায়ী দর্শক করে দিতে পারে।

তাই বলছিলাম, শিল্প নিছক শিল্প নয়, শিল্প হলো জীবন, এক নিবিড় অনুসন্ধান। সেই অনুসন্ধানে ব্রত নাসির আলী মামুন তাই জীবন-শিল্পী, বাংলার লোক-আত্মা খুঁজে ফেরা এস এম সুলতানও সেই জীবন–শিল্পী। অথবা শিল্পের মনুষ্য জীবন। দুইয়ের ভেতর এক।

গত ২০ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া এই প্রদর্শনী শেষ হবে আজ ৫ অক্টোবর।