বুদ্ধদেব বসু, দময়ন্তী ও তিন সকালের স্মৃতি

নিজের বাড়িতে দময়ন্তী বসু সিং (৯ জানুয়ারি ১৯৪০—১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ )। ছবি: সংগৃহীত
নিজের বাড়িতে দময়ন্তী বসু সিং (৯ জানুয়ারি ১৯৪০—১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ )। ছবি: সংগৃহীত

আমি যদি হই ফুল, হই ঝুঁটি-বুলবুল   হাঁস

মৌমাছি হই একরাশ,

তবে আমি উড়ে যাই, বাড়ি ছেড়ে দূরে যাই,

ছেড়ে যাই ধারাপাত, দুপুরের ভূগোলের              ক্লাশ।

তবে আমি টুপটুপ নীল হ্রদে দিই ডুব  রোজ,

পায় না আমার কেউ      খোঁজ।

তবে আমি উড়ে-উড়ে ফুলেদের পাড়া ঘুরে

মধু এনে দিই এক          ভোজ।

হোক আমার এলোচুল, তবু আমি হই ফুল লাল,

ভরে দিই ডালিমের ডাল।

ঘড়িতে দুপুর বাজে, বাবা ডুবে যান কাজে,

তবু আর ফুরোয় না আমার সকাল।

কবি নরেশ গুহ বন্ধু বুদ্ধদেব বসুর কন্যা দময়ন্তী বসু অর্থাৎ ছোট্ট রুমিকে নিয়ে লিখেছিলেন এই অসামান্য কিশোর কবিতা ‘রুমির ইচ্ছে’। এই কবিতার ছোট্ট মেয়েটি দেখে দুপুর বাজতে না বাজতে কাজে ডুবে যায় তার বাবা; কিন্তু তার নিজস্ব চপল, কিশোর-ঘড়িতে ফুরোয় না প্রিয় সকাল। সেদিনের সেই ছোট্ট রুমিই হলেন দময়ন্তী বসু সিং, যিনি প্রয়াত হয়েছেন সম্প্রতি।

একাধারে লেখক-প্রকাশক-সম্পাদক শৌখিন চিত্রশালার পরিচালক ড. দময়ন্তী বসু সিংয়ের জন্ম ১৯৪০ সালের ৯ জানুয়ারি। প্রতিভা বসু ও বুদ্ধদেব বসুর কনিষ্ঠা এই কন্যার রবীন্দ্রনাথ প্রদত্ত নাম ‘কাকলি’। শিল্পস্বর্ণোজ্জ্বল পরিবারের ঘরোয়া মঞ্চ থেকে নিউ এম্পায়ার হল কিংবা বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের বৃহৎ মঞ্চে ছোটবেলাতেই অভিনয় করেছেন দালিয়া, লক্ষ্মীর পরীক্ষা, শেষরক্ষা, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি নাটকে। বাবার সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার ‘সানন্দ কেরানি’ হিসেবেও কাজ করেছেন, কবিতার জগতে দময়ন্তী সেভাবে নিমগ্ন হননি; যদিও স্মৃতি তাপ ভালোবাসা নামে একটি কবিতার বই আছে তাঁর।

ছোটবেলা থেকেই হয়ে উঠেছেন বাংলা সাহিত্যের চরিত্র। বাবার কবিতা-গল্প-উপন্যাস ‘প্রথম দুঃখ’, ‘জলে থাকে মাছ’, ‘যা চাও তাই’, ‘পরির গল্প’ ‘রুমির পত্র-বাবাকে’, তিথিডোর-এ ভাস্বর হয়েছেন তিনি। বাবার কাছ থেকে পাওয়া তাঁর অমূল্য সব চিঠি বাংলা পত্রসাহিত্যে যোগ করেছে অভিনতুন মাত্রা। উচ্চশিক্ষার জন্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধদেব বসু প্রতিষ্ঠিত তুলনামূলক সাহিত্যবিভাগে ভর্তি হয়ে পারিবারিক শিক্ষক বাবাকে লাভ করেন বিশ্ববোধের বন্ধুরূপে। যাদবপুর থেকে স্নাতকোত্তর শেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান। এখান থেকেই টি এস এলিয়টে ভারতীয় প্রভাব বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন, যা বই হয়ে প্রকাশ পায় ১৯৭৮ সালে।

মার্কিনমুলুকে পড়তে গিয়ে দময়ন্তী যেমন প্রিয় পরিবার থেকে বিচ্ছেদের বেদনায় দীর্ণ হতে শুরু করেন, বিপরীতে তেমনি এই প্রবাস-পরবাস তাঁর জীবনে বাবার অসাধারণ সব চিঠির অমূল্য খনি প্রাপ্তির সুযোগ এনে দেয়। ১৯৬২-৭৪ কালপর্বে প্রাপ্ত শ তিনেক চিঠির মধ্য থেকে নির্বাচিত ১৭৮টি চিঠি দময়ন্তীর টীকাভাষ্য ও স্মৃতিসূত্রসমেত ১৯৮৮-৮৯-এ দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আর জুন ২০০৬-এ বুদ্ধদেব বসুর চিঠি: কনিষ্ঠ কন্যা রুমিকে শিরোনামে গ্রন্থরূপ পায়, যা অন্তর্গত মহার্ঘ্যতায় ইন্দিরা দেবীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র-এর চিঠিগুচ্ছের সঙ্গেই তুলনীয়। তাঁর নিজের ভাষায়:

ধারাবাহিক চিঠির মাধ্যমে যত সহজে মনের বিনিময় হয়, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা-সুখদুঃখ-সাংসারিক সমস্যা ইত্যাদির আলোচনা যত হৃদয় খুলে হওয়া সম্ভব, তা কখনোই দৈনন্দিন দেখাশোনায় অন্তত পিতা-পুত্রীর হয় না। আমি যে বাবাকে ক্রমাগত পত্রবিনিময়ের মধ্য দিয়ে পেয়েছিলাম, গভীরভাবে জেনেছিলাম তাঁর মন, শরিক হতে পেরেছিলাম তাঁর সুখদুঃখের মুহূর্তের, তা আমি পরিবার থেকে শারীরিক দূরত্বে বহু বছর থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম বলেই।...মরমী পাঠক অনায়াসে অনুভব করবেন এই পত্রগুচ্ছ নেহাতই পিতা–পুত্রীর বার্তা বিনিময় নয়—এই চিঠিপত্রের মধ্য দিয়েই তিনি আমার অপরিণত মনকে পরিণত করেছেন, শিক্ষিত করেছেন, প্রবাসী মেয়েকে অহরহ সংযুক্ত রেখেছেন প্রিয়জনদের সঙ্গে-যাতে সে একাকিত্বে কষ্ট না পায়, বিচ্ছিন্নবোধ না করে।

কী আছে এই চিঠির ঝাঁপিতে না বলে, বলতে হয় কী নেই এই বইয়ের সোনাঝরা পত্র-পরিসরে!

৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬-তে কন্যাকে লিখছেন বুদ্ধদেব:

ডটপেন আমার জন্য যা আনবি তার মধ্যে কয়েকটা লাল থাকে যেন, প্রুফ দেখার পক্ষে লালটাই সুবিধে। পিরানদেল্লো, ইবসেনের শেষের দিককার নাটক, সবই আমার ছিলো, হয় চুরি হয়েছে, নয় কোনো মূর্খ উদারতার মুহূর্তে দান করেছিলাম। এখন আবার বিজ্ঞ পিঁপড়ের সঞ্চয় করতে চাচ্ছি আসন্ন শীতের জন্য।

৮ এপ্রিল ’৬৮-তে কলকাতার আবহাওয়ায় বসে যৌবনের ফেলে আসা ঢাকার হাওয়া স্মরণে লিখছেন:

এবারে কলকাতার আশ্চর্য আবহাওয়া চলছে—বৈশাখ এসে গেল, এখনো সত্যিকার গরম পড়লো না। বিশেষত এই নাকতলায় যে-রকম মলয়-সমীরণের প্রাদুর্ভাব চলছে সেটা আমার পক্ষে অত্যন্ত বিস্ময়কর। মনে হয় পুরানা পল্টন ছাড়ার পরে এ প্রাকৃতিক বায়ু সঞ্চালন আর পাইনি।

জীবনের উপান্তে এসে চক্ষুপীড়ায় ক্লিষ্ট বুদ্ধদেবের কন্যাকে পাঠানো চিঠির অনেকটা জুড়ে যখন থাকে গ্যেটে, তখন বুঝতে হয় পিতা-পুত্রীর সম্পর্ক দৈনন্দিনের ম্লানিমা উজিয়ে স্নাত ছিল জ্ঞানের গভীর নির্ঝরে:

তুই যে সেবার কলকাতায় গ্যেটের আত্মজীবনীটা কিনলি, সেটা তোর পড়া হয়ে থাকলে আমার জিম্মায় রাখতে পারবি কিছুদিন? ডাকে পাঠাস না, এর পরে যখন আসবি সঙ্গে নিয়ে আসিস। যতদূর মনে পড়ে, বইটার অক্ষর আমার পক্ষে পাঠযোগ্য হবে—চোখ বাঁচাবার জন্য নেহাৎ না-ঠেকলে ছোট অক্ষর পড়ি না আজকাল—আর আত্মজীবনী ইত্যাদির সুবিধে এই যে-কোনো পৃষ্ঠা যে-কোনো দিন খানিকটা পড়ে নেয়া যায়।.... গ্যেটে ভুলিস না, দোহাই।—বাবা।

দময়ন্তী জানাচ্ছেন, বাবার প্ররোচনায় আমেরিকার ছাত্রজীবনকে কেন্দ্র করে একটি ছোট উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি, যদিও তা প্রকাশ পায়নি কোনোদিন।

 ‘ওয়াশিংটনে র চিঠি’ শিরোনামে অনিয়মিত লেখার ক্ষেত্রেও ছিল বাবার নিরন্তর পত্রপ্রেরণা।

কন্যা দময়ন্তীকে লেখা পিতা বুদ্ধদেব বসুর চিঠি। ছবি: সংগৃহীত
কন্যা দময়ন্তীকে লেখা পিতা বুদ্ধদেব বসুর চিঠি। ছবি: সংগৃহীত

১৮ মার্চ ১৯৭৪-এ প্রয়াণের সপ্তাখানেক আগে ১১ মার্চ প্রিয় কনিষ্ঠা কন্যাকে বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন জীবনের সর্বশেষ চিঠি, ‘কাজের স্তূপ জমে আছে, আমি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি’ এমন মর্মছোঁয়া সূচনাবাক্যে। বাস্তবের নানা মারে পর্যুদস্ত পিতার প্রয়াণকে দময়ন্তী উপলব্ধি করেছেন ‘তমসাহত কক্ষপথ থেকে অমৃতসূর্যের সন্ধানে’ যাত্রারূপে।

দময়ন্তী নিজের প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ থেকে তাঁর সংযোজন, সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব বসুর আমাদের কবিতাভবন, ভোজনশিল্পী বাঙালি, দুই খণ্ডে বুদ্ধদেব বসুর অগ্রন্থিত গদ্য ‘কবিতা’ থেকে এবং বাংলাদেশ থেকে বুদ্ধদেব বসুর আত্মজৈবনিক (বাতিঘর, ২০১৮)।

পেশায় অধ্যাপক দময়ন্তী একসময় উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। মার্কিন দেশ থেকে ভারতের কানপুর—নানা স্থানে পঁয়ত্রিশ বছরের প্রবাসপর্ব কাটিয়ে ১৯৯৬-এ ফের থিতু হন প্রিয় কলকাতায়; রাসবিহারী এভিনিউ-২০২ কবিতাভবন আর নাকতলার স্মৃতিগন্ধ গায়ে মেখে প্রবেশ করেন জীবনের নতুন পর্বে। মা প্রতিভা বসু তাঁরই প্রেরণায় লিখলেন মহাভারতের মহারণ্যে। মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটাও ছিল বাবার মতোই—বন্ধুত্বপূর্ণ। বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর জন্মশতবর্ষ উদ্‌যাপনে তিনিই ছিলেন অগ্রণী নেতা ও কর্মী। দময়ন্তী জানাচ্ছেন, মায়ের মহাভারতের মহারণ্যে এবং তাঁর প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’র জন্মকথা:

আমি তখন কানপুর, আইআইটিতে। শিবনারায়ণ রায়ের জিজ্ঞাসা পত্রিকার একটা সংখ্যায় দেখলাম মায়ের প্রবন্ধ, ‘নায়িকা সত্যবতী’। দেখলাম, প্রতিভা বসু ভীষণ নতুন কথা বলছেন। আমি কলকাতায় এসে মাকে বললাম, তুমি অসাধারণ প্রবন্ধ লিখেছ। কিন্তু তোমার বক্তব্য এত অল্প কথায় বললে হবে না। ২০০০ টাকা মাকে দিয়ে বললাম এটা অগ্রিম, এই বইটি দিয়ে আমি প্রকাশনা শুরু করব। মা তো তখন হাসলেন, কিন্তু অচিরেই লিখতেও শুরু করলেন। বেশ কিছু মাস পরে বললেন, ‘আমি তো অনেক পাতা লিখে ফেলেছি তোকে এডিট করতে হবে।’ এডিটিং শুরু করলাম। সত্যিই এই বই দিয়ে আমার প্রকাশনা সংস্থা ‘বিকল্প’ শুরু। (সূত্র: এই সময়, কলকাতা, ৮ মার্চ ২০১৫)

২০০২-এ তিনি ‘বিকল্প আর্ট গ্যালারি’ নামে চিত্রশালা চালু করেন। ২০০৩-এ ‘বিকল্প’ থেকে সেলিনা হোসেনের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নিঃশব্দ বিপ্লব: বাংলাদেশের নারীমুক্তির তিন দশক বইটি। পিতৃমাতৃভূমি বাংলাদেশের নারীদের অভাবনীয় অগ্রগমন এই বইটি সম্পাদনায় প্রাণিত করেছিল তাঁকে। দময়ন্তীর জন্মের বছর ১৯৪০-এ তাঁর পিতা প্রকাশ করেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতার বই পদাতিক আর দময়ন্তীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয় সুভাষের শেষ কবিতাবই ফকিরের আলখাল্লা; এভাবে অতীত ও নতুন সময়ে সেতুবন্ধ নির্মাণের কাজ করে গেছেন তিনি।

দুই.

আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হয়ে আছে দময়ন্তী বসুর সঙ্গে তাঁর সল্টলেকের বাড়িতে তিন সকালের আড্ডার স্মৃতি। ২০১৫-তে সৈয়দ শামসুল হক সম্মাননাগ্রন্থ–এর জন্য লেখা চাইতে কথাপ্রকাশ-এর প্রকাশক জসিম উদ্দিন ভাই আর আমি প্রথম গিয়েছি তাঁর দুয়ারে; আর ফিরে এসেছি একরাশ ভালোলাগার অনুভব নিয়ে। আমি তাঁর মায়ের বাড়ি বিক্রমপুরের হাঁসাড়া গ্রামে গিয়েছি শুনে বলছিলেন মা-বাবার কাছ থেকে শোনা পুববাংলার গল্প—পল্টন, ওয়ারি, বনগ্রাম লেন, বকশিবাজার, ইন্দিরা রোড, বিক্রমপুর—এসব তাঁর মনের কোণের পাড়া আর গ্রাম হয়ে আছে যেন। এরপর আরও দুবার যাওয়া হয়েছে তাঁর কাছে, কবিবন্ধু জিয়া আর অরুণাভের সঙ্গে। সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি অনন্য স্মৃতিগদ্য ‘সৈয়দ দা’। বলছিলেন, কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়া তরুণ সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা-পঙ্‌ক্তি ‘ইয়াজদানি মারা গেছে বিমান পতনে’ এখনো আলোড়ন তোলে মনে। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী আর বেলাল চৌধুরীর কথাও এল ফিরে ফিরে দ্বিতীয়বারের সেই আড্ডায়।

এই তো সেদিন অর্থনীতিবিদ-লেখক অশোক মিত্রের চলে যাওয়ায় বেদনাহত কলমে লিখলেন ‘হাতে কৃষ্ণচূড়া নিয়ে মাঝরাতে কড়া নাড়তেন কবিতাভবনে’ শিরোনামে এক অসামান্য স্মৃতিলেখা। আর এর কিছু পরেই ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এক বিরল সারস্বত যুগের বহু স্মৃতির বকুলরেখা বিছিয়ে নিজেও পাড়ি দিলেন অনন্তের কৃষ্ণচূড়া-দেশে।