এক মলাটে তিন জীবনী

বুদ্ধদেব বসু। ছবি: সংগৃহীত
বুদ্ধদেব বসু। ছবি: সংগৃহীত

জীবনী তিনটি হলেও জীবনীকার কিন্তু একজনই; সেই একজন আবার জীবনী লিখেছেন এক ব্যক্তির; সেই ব্যক্তি জীবনীকার নিজেই। লোকটি স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু। সেই বসু, যিনি জীবদ্দশায় বাংলা সাহিত্যের কর্তৃত্ব নিজের হাতে রেখেছিলেন বহু দশক ধরে—বাঙাল লোকটির কর্তৃত্ব খাস কলকাত্তাই তরুণেরা বেশ সাগ্রহেই মেনে নিয়েছিলেন; আর মৃত্যুর এতগুলো বছর পরও যিনি নিজের প্রতি আমাদের আগ্রহ অটুট রাখতে পেরেছেন। আমরা কথা বলছি বুদ্ধদেব বসুর তিন খণ্ড আত্মজীবনী নিয়ে। আমার ছেলেবেলা, আমার যৌবন, আমাদের কবিতাভবন নামের জীবনী তিনটি সম্প্রতি আত্মজৈবনিক নাম দিয়ে এক মলাটে ছেপেছে বাতিঘর। এটা বেশ আশ্চর্যের যে বসুর জীবনীগুলো এর আগে একত্রে প্রকাশিত হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর প্রতি আমাদের—বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের—তুরীয় আগ্রহের প্রমাণ দিচ্ছে আলোচ্য প্রকাশনাটি। আমার হাতে আত্মজৈবনিক নামের যে সংকলনটি আছে, সেটি প্রকাশিত হয়েছে এ বছর এপ্রিল মাসে। অক্টোবর মাসেই বেরিয়েছে দ্বিতীয় মুদ্রণ। মানছি, বইটির প্রকাশনা-সৌকর্য বেশ উঁচুমানের। মানছি, বসু-কন্যা দময়ন্তী বসু সিংয়ের একটি ভূমিকা বইটির গুরুত্ব বাড়িয়েছে—পৃষ্ঠা দুয়েকের হলেও ভূমিকাটি জীবনী তিনটির প্রবেশক হিসেবে কাজের, কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় মুদ্রণের জন্য এ কারণগুলো মোটেই যথেষ্ট নয়। বুদ্ধদেব বসুর নাম-মহিমাই এর মূল কারণ। বোঝা যায়, বসুর প্রতি আমাদের আগ্রহ এখনো যথেষ্ট মাত্রায় বহাল আছে।

তিনটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথমে জীবনস্মৃতি—একে বলতে পারি তাঁর সাহিত্যিক জীবনী; পরে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি প্রবন্ধে আত্মপরিচয়—নিজের কাব্যপরিচয়ের এবং ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পরিচয়ের এক তুরীয় পসরা; শেষে ছেলেবেলা—অতীত ও ভাষা নিয়ে তুখোড় নিরীক্ষা। বুদ্ধদেব বসু, ক্রমের দিক থেকে কোনো মিল না থাকলেও, অনুমান করতে বাধা নেই, রবীন্দ্রনাথের তিন খণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে খণ্ড বিভাজনে মিল থাকলেও ভাবের দিক থেকে দুজনের অমিলটাই বেশি। বুদ্ধদেব সাহিত্য করতেন ও পড়তেন সাহিত্যের ইতিহাসের পথ ধরে, রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসকে একেবারেই পাত্তা না দিয়ে। তাঁর জীবনী তিনটিতেও সেই দৃষ্টিভঙ্গির একচ্ছত্র প্রতাপ। সাহিত্যকেই জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান করে আপাদমস্তক বিশুদ্ধ সাহিত্যিক জীবনযাপনের এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। জীবনীগুলোতে সেই জীবনের প্রত্যক্ষ অভিব্যক্তি দেখি। ফলে তিনটি জীবনীকেই বলতে পারি সাহিত্যিক জীবনী। ছেলেবেলায় দেখি তার প্রস্তুতিপর্ব। নিশ্চিত করে বলা যায়, ওই বেলায় তিনি সাহিত্যিক হওয়ার জন্য সব কাজকর্ম করেননি। কিন্তু পরিণত বয়সের স্মৃতিচারণে নিশ্চয়ই ছোটবেলার ওই স্মৃতিগুলোই তাঁর কাছে বেশি উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছিল, যেগুলোকে তিনি কোনো না কোনোভাবে পরের সাহিত্যিক রুচি ও তৎপরতার পরিপূরক মনে করেছিলেন। আমার যৌবন–এ প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে পাই তৎপরতার বিবরণী, যে তৎপরতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান সাহিত্যিক এবং তাঁর কালের প্রধান সাহিত্য-অভিভাবকে পরিণত করেছিল। অসম্পূর্ণ আমাদের কবিতাভবন–এ তৎপরতার হদিশ আছে, তবে এর আকর্ষণীয় দিক সংশ্লিষ্ট সাহিত্যিক-শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সঙ্গে বসুর সম্পর্কের বয়ান।

>

প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক: বাতিঘর, চট্টগ্রাম
প্রকাশকাল: এপ্রিল ২০১৮
২১৬ পৃষ্ঠা
দাম: ৪৫০ টাকা।

বুদ্ধদেব বসুর জীবনীগুলো তাঁর সুখপাঠ্য গদ্যের আদর্শ নমুনা হিসেবে পড়া চলে। বসুর পাঠক মাত্রই জানেন, তাঁর গদ্য পড়া এক আরামদায়ক অভিজ্ঞতা। বেশ গুছিয়ে লিখতেন তিনি, যে ধরনের গোছগাছ আমরা একাডেমিক ধাঁচের লেখায় পেয়ে থাকি; সৃষ্টিশীল রচনার কিছু স্বভাবগুণ, যেমন সাবলীল বর্ণনা বা গল্প বলার ক্ষমতা, সঙ্গত কারণেই তাঁর কলমে ঠাঁই নিয়েছিল; আর তাঁর গদ্যশৈলীর উল্লেখ তো করতেই হয়, যা পাখির পালকের মতো হালকা আর গতিশীল। জীবনী তিনটি উপাদেয় হয়ে ওঠার আরেক কারণ ব্যাখ্যা করা যায় বসুর বরাত দিয়েই। নিজের সমালোচক সত্তা সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, যা কিছু তাঁর কাছে উপাদেয় মনে হয়েছে—সাহিত্য বা অন্য উপভোগ্য সম্ভার—তার স্বাদ তিনি বিলাতে চেয়েছেন পাঠকদের মধ্যে। আত্মজীবনী তিনটি এ ধরনের উদাহরণে ভরপুর।

আরও তিন ধরনের পাঠকের জন্য আত্মজৈবনিক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য হবে বলে ধারণা করি। এক. যাঁরা সাহিত্যিক এবং সাহিত্যকর্মী হিসাবে প্রস্তুতি নিতে চান; দুই. যাঁরা বাংলা কবিতার সদর ও অন্দরের অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রত্যাশা করেন; তিন. যাঁরা বাংলা কাব্যধারায় বিদ্যমান প্রভাবশালী কাব্যাদর্শের প্রধান প্রচারক হিসেবে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সংলাপে লিপ্ত হতে চান।

এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার জন্য বইটির প্রকাশক নিশ্চয়ই ধন্যবাদ পাবেন।